চুরির অপবাদ দিয়ে গাজীপুরের একটি কারখানায় হৃদয় (১৯) নামের এক শ্রমিককে রশি দিয়ে বেঁধে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। মারধরের ১ মিনিট ১৬ সেকেন্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার সেই দৃশ্য গা শিউরে ওঠার মতো। এ সময় আশপাশের লোকদের বলতে শোনা যায়, ‘এত করে পিটানো হইছে, (তারপরও) কিছুই হয় নাই, মরে নাই।’ নিহত হৃদয় টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার শুকতার বাইদ গ্রামের আবুল কালামের ছেলে। তিনি গ্রিনল্যান্ড লিমিটেডে মেকানিক্যাল মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন।
২৮ জুন রাতে চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার ১১ নম্বর গোহট দক্ষিণ ইউনিয়নের চাপাতলী গ্রামে মমতাজ বেগম নামের ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধকে ঘরে ঢুকে কুপিয়ে হত্যার পর লাশ রান্নাঘরের পাশে পাতার স্তূপে ঢেকে রাখা হয়েছিল। নিহত মমতাজ ওই গ্রামের বাচ্চু কোম্পানির স্ত্রী। পুলিশ এখনো হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি।
শুধু ওপরের দুটি ঘটনা নয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক ঘটে চলছে এমন মর্মস্পর্শী হত্যাকাণ্ড। মানুষের নিষ্ঠুরতা ও পাষণ্ডতার মাত্রা অতীতের যে কোনো সময়কে হার মানাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, পান থেকে চুন খসলেই ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছেন তারা। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে বেড়েছে নারী নির্যাতনের ঘটনাও। খোদ পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের গত পাঁচ মাসে ১ হাজার ৫৮৭টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। গত বছরে এই সময়ে ছিল ১ হাজার ২৬৫টি। চলতি বছরের গত পাঁচ মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ৯ হাজার ১০০টি মামলা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ হাজার ৭৮৭টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত খুনের ঘটনায় মামলা ছিল ৩ হাজার ৪৩২টি। আর নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা ছিল মোট ১৭ হাজার ৫৭১টি।
সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট সক্রিয় না হওয়ায় সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধী চক্র। আইনের শাসনের দুর্বলতা থেকে যাওয়ার কারণে নারী ও শিশু এখানে বড় টার্গেটে পরিণত হয়েছে দুর্বৃত্তদের।
গত রবিবার সকালে বরিশাল-ভোলা মহাসড়কের পাশ থেকে হাত-পা বাঁধা, পলিথিনে মোড়ানো এক নারীকে জীবিত উদ্ধার করেছে বন্দর থানা পুলিশ। পরে তাকে শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভুক্তভোগী ওই নারীর মা জানান, তার মেয়ের জামাই ভোলায় ব্যবসা করেন। সেখানে যাওয়ার জন্য শনিবার বিকালে বাসা থেকে বেরিয়ে বরিশাল নদীবন্দরে গিয়েছিলেন। লঞ্চ মিস করে বাসায় ফেরার পথে সে অপহরণের শিকার হয়। তার শরীরে কোনো দাহ্য পদার্থ ঢেলে দেওয়া হয়, যার ফলে তার চামড়ায় ফোসকা পড়েছে।
এদিকে দেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সর্বত্র। গত ১৪ এপ্রিল নাটোরের বড়াইগ্রামে প্রথম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণ শেষে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর মুখ ঝলসে দেওয়া হয়। ১৮ এপ্রিল কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে দুর্বৃত্তরা শিকল দিয়ে বেঁধে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক গৃহবধূ। এর আগে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিনে গাজীপুরের শ্রীপুরে আরেকটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। একই দিনে ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলায় পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার হন মোজাম্মেল হক মানিক নামের এক শিক্ষক। মাগুরায় আট বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনার মাত্র ৮২ দিনের মাথায় কুমিল্লার মুরাদনগরে সংখ্যালঘু নারীকে ধর্ষণ এবং নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। অভিযোগ আসছে, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন নারী, শিশু ও তাদের অভিভাবকরা। যদিও মুরাদনগরের ওই ঘটনাটি প্রকৃতপক্ষেই ধর্ষণ নাকি পরকীয়ার ঘটনা তা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) গতকাল জুন মাসের এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলছে, চলতি জুনে দেশে ধর্ষণ ও গণপিটুনিতে হত্যার সংখ্যা বেড়েছে। দলবদ্ধ ধর্ষণসহ নারীর প্রতি নির্যাতনও কমেনি এ মাসে। শারীরিক নির্যাতন, নিগ্রহ বেড়েছে। গত মে মাস থেকে দেশে অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহতের সংখ্যাও কমেনি। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী জুন মাসে ৩৬৩টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৬৩টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণ ও হত্যা ৪টি। এ ছাড়া ধর্ষণের শিকার হয়েছে সাতজন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারী। গত মে মাসে দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ৫৯টি। তাদের পরিসংখ্যান বলছে, জুন মাসে অন্তত ৪১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১০ জন নিহত ও ৪৭ জন গুরুতর আহত হয়েছে। গণপিটুনির শিকার ৩০ জনকে আহতাবস্থায় পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী শাহদীন মালিক বলেন, দেশে মব সৃষ্টি করে সহিংসতার ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। এতে মানুষও হত্যা করা হচ্ছে। এসব ঘটনা আসলে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার ফল। সরকারের ভিতরে নানা মতের মানুষ রয়েছেন। তাদের মতের পার্থক্যের জন্যই সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যেখানে নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই, রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান, মুহূর্তেই খোলশ বদলে অন্য দলে ঢুকে যাচ্ছে সেখানে অনেক কিছুই সম্ভব হয়। সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন হলো- আমরা তো অ্যাসিড নিক্ষেপের মতো ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। তাহলে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না কেন? তিনি আরও বলেন, গণমাধ্যমে উঠে আসলে কিছু ঘটনার গুরুত্ব বেড়ে যায়। তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ নিয়ে ধামাচাপা পড়ে যায়। তবে রাষ্ট্র কি জানে না আদালতে কী পরিমাণ ধর্ষণের মামলা বছরের পর বছর ধরে পড়ে আছে? এক্ষেত্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, মহিলা অধিদপ্তর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব ক্ষেত্রে কী করছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার এখনো অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে সাধারণ মানুষকে। অতীতে নারীর ওপর সহিংসতার ঘটনার বিচার যদি দ্রুততর সময়ের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হতো তাহলে মুরাদনগর কিংবা শিশু আছিয়ার মতো ঘটনা ঘটত না। সরকারের এক্ষেত্রে অনেক গাফিলতি আছে।