আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গতকাল জবানবন্দি দিয়েছেন রাজধানীর চানখাঁরপুলের বাসিন্দা মো. মনিরুজ্জামান ও মো. টিপু সুলতান। তারা দুজনই গত বছরের ৫ আগস্ট চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ জবানবন্দি দেন ১২তম সাক্ষী মো. টিপু সুলতান ও ১৩তম সাক্ষী মো. মনিরুজ্জামান। পরে এ দুই সাক্ষীকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী রবিবার দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম, বি এম সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান প্রমুখ। এর আগে সকালে কারাগার থেকে এ মামলার গ্রেপ্তার চার আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ। তারা হলেন শাহবাগ থানার সাবেক ওসি (অপারেশন) মো. আরশেদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন মিয়া, মো. ইমাজ হোসেন ইমন ও মো. নাসিরুল ইসলাম। এ মামলার পলাতক চার আসামি হলেন সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিব, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল।
পুলিশের গুলি লাগে সামনে থাকা জুনায়েদের মাথায় : বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে মালামাল সরবরাহকারী মো. মনিরুজ্জামান তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘গত বছর জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আমি ও আমার ছেলে তৌফাউজ্জামান ৪-৫ দিন অংশগ্রহণ করি। ৫ আগস্ট সকালে আমার ছেলে আমাকে না বলে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তখন খুব গোলাগুলি হচ্ছিল। আমি ছেলেকে খুঁজতে বের হয়ে নিমতলী যাই। বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে ছেলেকে ফোন করলে সে নিমতলীর কাছাকাছি আছে বলে জানায়। আমি গোলাগুলির জন্য রাস্তা পার হতে পারছিলাম না।’ জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে আমি ও আমার ছেলে খলিফাপট্টি এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দিই। আমরা চানখাঁরপুলের দিকে এগোচ্ছিলাম। তখন পুলিশ গুলি করতে করতে আমাদের দিকে আসে। পুলিশের গুলি আমার সামনে থাকা জুনায়েদ নামে একজন আন্দোলনকারীর মাথায় লাগে। ৩-৪ জন আন্দোলনকারী জুনায়েদকে রিকশায় তুলে মিটফোর্ড (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেদিন বিকালের দিকে জানতে পারি গুলিবিদ্ধ জুনায়েদ মারা গেছে।’ তিনি বলেন, ‘সেদিন বেলা ২টা থেকে আড়াইটার দিকে জানতে পারি শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। সেদিন চানখাঁরপুল এলাকায় ৫-৬ জন আন্দোলনকারী পুলিশের গুলিতে নিহত হন। আমি এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সবার বিচার চাই।’
গুলি ইয়াকুব ও ইসমামুলের পেট দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায় : জবানবন্দিতে ঢাকা নিউমার্কেটে কাপড়ের দোকানের কর্মচারী মো. টিপু সুলতান বলেন, ‘গত বছর জুলাই মাসের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আমার নৈতিক সমর্থন ছিল। আমার বাসা নাজিমউদ্দিন রোডে। ৫ আগস্ট বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে লংমার্চ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য বাসা থেকে বের হয়ে চানখাঁরপুলে বোরহানউদ্দিন কলেজের সামনে অবস্থান নিই। ওই সময় আন্দোলনে আমাদের সঙ্গে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও অংশগ্রহণ করেন। আমরা বোরহানউদ্দিন কলেজের গেটের সামনে পৌঁছালে পুলিশ চানখাঁরপুল মোড় থেকে আমাদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলি করে। আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই।’
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘পরবর্তীতে শুনতে পাই আমার এলাকার বড় ভাই ইয়াকুব নাজিমউদ্দিন রোডে সোহাগ হোটেলের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আমি সেখানে গিয়ে দেখি ইয়াকুব ভাইয়ের পেট দিয়ে গুলি লেগে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেছে। তার ভুঁড়ি বের হয়ে যায়। জাহিদ নামের একজন তার টি-শার্ট খুলে ইয়াকুবের গুলিবিদ্ধ ক্ষতস্থানে বেঁধে দেন। তারপর একজন আন্দোলনকারী ইয়াকুবকে একটি অটোরিকশায় তুলে মিটফোর্ড (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) হাসপাতালে নিয়ে যান। শুনেছি সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’ জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বোরহানউদ্দিন কলেজের কাছাকাছি অবস্থান করতে থাকি। পুলিশ গুলি করতে করতে বোরহানউদ্দিন কলেজের গেট পর্যন্ত চলে আসে। পুলিশ আমাকে লক্ষ্য করে গুলি করলে সেই গুলিটি আমার পাশে থাকা আন্দোলনকারী ইসমামুলের পেটে লেগে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। ইসমামুলকে আমি অটোরিকশায় উঠিয়ে দিলে আরেক আন্দোলনকারী তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। তাকে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে জানতে পারি যে, তিনি তিন দিন পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। ওইদিন চানখাঁরপুলে ছয়জন আন্দোলনকারী পুলিশের গুলিতে নিহত হন। আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’ গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে আনাস, মোস্তাকিম, ইয়াকুব, ইসমামুলসহ কয়েকজন পুলিশের গুলিতে নিহত হন।