জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর মোহাম্মদপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত মাহামুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী গতকাল সাক্ষী দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
আলজাজিরা টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেওয়া এই সাক্ষী তার জবানবন্দিতে বলেন, হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে শেখ হাসিনার একটি ফোনালাপ শুনতে পাই। সেখানে শেখ হাসিনা জানান, তিনি শিক্ষার্থীদের ওপর বোম্বিং করার নির্দেশ দিয়েছেন।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের ৪৯তম সাক্ষী হিসেবে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ এ গতকাল তিনি নিজের এ জবানবন্দি তুলে ধরেন। পরে তাকে জেরা শেষ করেন আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আজকের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে ট্রাইব্যুনাল-১ এ প্রসিকিউশনের ৪৮তম সাক্ষী ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ বাংলাদেশ) প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদকে অবশিষ্ট্য জেরা শেষ করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। জেরার একপর্যায়ে তিনি সাক্ষী জুনায়েদকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের কর্মসূচি ছিল সরকার উৎখাতের মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশ। জবাবে জুনায়েদ আমির হোসেনের বক্তব্য সত্য নয় বলে জানান।
গতকাল সাক্ষ্য গ্রহণের সময় ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম প্রমুখ। দিনের কার্যক্রম শেষে বিকালে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রসিকিউটর তামীম জানান, প্রসিকিউশনের ৪৯তম সাক্ষী সাবরিনা আফরোজ সেবন্তীর সাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমে এ মামলার ঘটনার সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলো। কাল এক বা দুজন ফরেনসিক এক্সপার্ট ও পরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে। এরপরই মামলাটি যুক্তিতর্ক উপস্থাপনসহ পরবর্তী পর্যায়ে যাবে।
শিক্ষার্থীদের ওপর বোম্বিংয়ের নির্দেশ দেন হাসিনা : রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী তার জবানবন্দিতে বলেন, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই শুক্রবার আমার ভাই জুমার নামাজ শেষে বাসা থেকে খেয়ে মোহাম্মদপুর এলাকার নুরজাহান রোডের দক্ষিণ মাথায় আন্দোলনে যায়। পৌনে ৪টার দিকে পুলিশ খুব কাছ থেকে আমার ভাই সৈকতকে গুলি করে হত্যা করে। তখন আমার বাবা আমাদের গ্রামের বাড়ি সন্দীপে ছিলেন। তিনি সেখান থেকে সৈকতের মোবাইলে কয়েক বার ফোন দেন। একজন অপরিচিত ব্যক্তি সৈকতের ফোন রিসিভ করেন এবং আমার বাবাকে জানান, এই ফোনটি যার তিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। আমরা তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা দ্রুত হাসপাতালে আসেন, অন্যথায় লাশও পাবেন না।
সাক্ষী সেবন্তী জবানবন্দিতে বলেন, খবর পেয়ে আমি হাসপাতালে ছুটে যাই। হাসপাতালে আমি আমার ভাইয়ের লাশসহ পাঁচটি লাশ দেখি। আমার ভাইয়ের মাথায় গুলি লেগেছিল। তার মাথায় মোটা রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ ছিল। অপর লাশগুলোর প্রত্যেকের মাথায়, পেটে বুকে গুলির চিহ্ন দেখি। আমি যতক্ষণ হাসপাতালে ছিলাম ততক্ষণ অনবরত গুলিবিদ্ধ আন্দোলনকারীদের হাসপাতালে নিয়ে আসতে দেখি। হাসপাতালের মেঝেতে অনেক রক্ত দেখি। আমার ভাইয়ের মাথা থেকে নির্গত রক্ত একজন ব্যক্তিকে বালতি দিয়ে পানি ঢেলে ধুয়ে দিতে দেখি। ভাইয়ের লাশ দেখে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। আমার মা একা বাসায় থাকায় ফুফাতো ভাইকে হাসপাতালে রেখে আমি বাসার উদ্দেশে রওনা হই। ওই দিন রাত ৯টার দিকে আমার ফুফাতো ভাই হাসপাতাল থেকে সৈকতের লাশ বুঝে নেয়। পরদিন সৈকতের জানাজা শেষে মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডে অবস্থিত জামে মসজিদ কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
অভ্যুত্থানের কর্মসূচি ছিল সরকার উৎখাতের মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশ : জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের কর্মসূচি ছিল আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতের মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশ বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-১ এ সাক্ষীকে জেরায় উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ গতকাল শেখ হাসিনাসহ তিন জনের বিরুদ্ধে করা মামলায় প্রসিকিউশনের ৪৮তম সাক্ষী আলী আহসান জুনায়েদকে জেরার সময় তিনি এমন মন্তব্য করেন।
জেরায় সাক্ষী আলী আহসান জুনায়েদকে আইনজীবী আমির হোসেন প্রশ্ন করেন, আপনাদের এসব (জুলাই গণ অভ্যুত্থানের) কর্মসূচি ছিল সরকারকে উৎখাত করার মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশ। এ কথা সত্য নয় বলে জবাব দেন আলী আহসান জুনায়েদ। আমির হোসেন আরও প্রশ্ন করে বলেন, ফেসবুক প্রোফাইল লাল করা, মার্চ ফর জাস্টিস, ১ আগস্টকে ৩২ জুলাই হিসেবে গণনা করার সিদ্ধান্ত, ৩ আগস্ট সরকার পতনের এক দফা কর্মসূচির ঘোষণা এবং মার্চ টু ঢাকাসহ আপনাদের সব কর্মসূচি ছিল আপনাদের দীর্ঘদিনের লালিত নীল নকশার ফল ও অবৈধ। জবাবে আলী আহসান জুনায়েদ বলেন, এসব কথা অসত্য।