অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশের মানবাধিকার মানবাধিকার কর্মীরা। তাঁরা বলছেন, মবের কারণে সবাই ভীত, এমনকি আদালত ও মানবাধিকারকর্মীরাও। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের প্রতিনিধি বা রাজনৈতিক দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
গতকাল রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা এসব কথা বলেন। ‘হিউম্যান রাইটস ইন ট্রানজিশন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকটির আয়োজন করে সপ্রাণ।
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সপ্রাণের গবেষক অপ্সরা ইসলাম তন্দ্রা। প্রবন্ধে বলা হয়, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত দেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ৪৯৬টি। এ সময় দেশে খুনের ঘটনা ঘটে ২ হাজার ৮৭৮টি, মব-সন্ত্রাসের ঘটনা ১৯৫টি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ওপর হামলার ঘটনা ৩৫টি, শিশুর ওপর নির্যাতনের ঘটনা ৬৪০টি ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা ৩৫টি। এ ছাড়া শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় ৪৫ নিহত ও ৩০০ জন আহত হয়। সীমান্তে ৩ হত্যাকা এবং ভারত থেকে ২ হাজারের বেশি পুশ ইনের ঘটনা ঘটেছে। প্রবন্ধ উপস্থাপনায় জানানো হয়, মূলধারার গণমাধ্যমগুলো থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। তবে বৈঠকে বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য কতটা ত্রুটিমুক্ত, সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, মানবাধিকার প্রতিবেদনগুলো তৈরি করা হয় বাংলাদেশের গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে অনেক ক্ষেত্রেই সময়, সম্পদ ও নির্ভুলতার অভাব রয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রেস সচিব বলেন, ‘মানবাধিকার বিষয়ে আমি সাংবাদিকতা করেছি ২০ বছরের মতো। একটা বড় সমস্যা মানবাধিকার নিয়ে যাঁরা রিপোর্ট করেন, আপনি নির্ভর করেন প্রধান সংবাদপত্রগুলোর ওপর। ওরা কি আদৌ প্রধান সংবাদপত্র। আপনি যার ভিত্তিতে রিপোর্টটা করলেন, সেই রিপোর্টটা কি সত্যিই আসল? রিপোর্ট কি আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন? ঢাকা ট্রিবিউনের কি ওই রিসোর্সটা আছে একটা ভালো রিপোর্ট করার?’ শফিকুল আলম বলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। সংবাদ মাধ্যমগুলোতে আসা চিত্রের তুলনায় পরিস্থিতি অনেক বেশি ভালো। অনেক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকার খুবই ভালো কাজ করেছে।
সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার একটা বড় কারণ ফেসবুক উল্লেখ করে প্রেস সচিব বলেন, ‘রামু, নাসিরনগর, ভোলা, কুমিল্লা, সুনামগঞ্জের মতো জায়গায় সংখ্যালঘুদের ওপর বড় সহিংসতাগুলোর সূত্রপাত ফেসবুকে। ফেসবুকের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হওয়া উচিত। সহিংসতা ছড়ানো কন্টেন্টের বিরুদ্ধে ফেসবুক কোনো দায়িত্ব নিতে চায় না। ফেসবুকের কারণে আমাদের আজ ১০ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা টানতে হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে ফেসবুকে। অন্তর্বর্তী সরকারের গুম কমিশনের সদস্য এবং মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, ‘যে অভিযোগটা তিনি (প্রেস সচিব) দিয়ে গেলেন, যে আমরা সব পরিসংখ্যান নিই পত্রিকা থেকে।
সরকারের প্রশাসন যে রিপোর্ট করে সেটি সত্যি, আর মানবাধিকারকর্মী এবং সাংবাদিকরা যে রিপোর্ট করেন, সেটার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে- এটিই তো উনি মূল কথা বলেছেন। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে আজ অন্তর্বর্তী সরকারের একজন প্রতিনিধির কাছ থেকে এ ধরনের বয়ান আমাদের শুনতে হলো এবং তিনি বয়ানের উত্তরগুলো না নিয়ে চলে গেলেন।’
গণপিটুনি বা মব ভায়োলেন্সকে স্বাভাবিকভাবে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে নূর খান বলেন, ‘আমার চোখে জামায়াত-বিএনপি যখন নির্যাতিত হয়েছে, আমি তাদের যেভাবে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি, প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছি, রিপোর্ট করার চেষ্টা করেছি। আজ যদি ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো সংগঠন ওই নির্যাতনের শিকার হয়, তাহলে সেটা নিয়ে আমি কথা বলব। এখনকার পরিস্থিতিতে মবের কারণে আমরা সবাই ভীত, এমনকি আদালতও। আপনি সাম্প্রতিক জিনিসগুলো খেয়াল করেন, আদালতে ডিম মবের কারণে কিন্তু সবাই আমরা ভীত, এমনকি আদালতও। মোড়া, লাথি মারা- সবই হয়েছে। আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট বা জজ সাহেবের রুমে ঢোকা হয়েছে মন।
নূর খান বলেন, যেখানে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বা ডাক্তারি রিপোর্ট আমরা পাই না কখনো, পাহাড়ের ঘটনায় সেখানে কি ধর্ষণ হয়নি- এই রিপোর্টটা চলে আসছে বিভিন্নজনের হাতে। কারা দিল। আমরা মানবাধিকারকর্মীরা এই জায়গায় কেন যেন একটু শঙ্কিত, ভয়-ভীতি এখনো কাজ করছে। আগে জড়ো হয়ে আমাকে না ফ্যাসিবাদ বলে দেওয়া করত- র?্যাব উঠিয়ে নেয় কি না, এখন হচ্ছে রাস্তায় কিছু মানুষ জড়ো হয়ে আমাকে না ফ্যাসিবাদ বলে দেয়।
সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে নূর খান বলেন, ‘আনি চাই খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দল যারা জনগণের প্রতিনিধি হয়ে আসবে, তাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে এ ধরনের সরকারের বিদায় নেওয়া উচিত। সবশেষে আবার একটা কথা বলব, সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে ভবিষ্যতে মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনে নামতে হবে।’
গবেষণা করায় সপ্রাণকে ধন্যবাদ জানিয়ে সারা হোসেন বলেন, ২০২৪ সালের আগস্টের পরের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ‘এক বছর ধরে অধিকাংশ মানবাধিকারবিষয়ক আলোচনায় আমরা গত (২০২৪ সাল) আগস্টের ৫ তারিখের আগের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছি। ৫ আগস্টের পরের অবস্থা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা এখন পর্যন্ত হচ্ছে না।’
মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ও প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয় শুধু বিগত সরকারের আমলে নয়, সব সরকারের সম্যাই হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন সারা হোসেন। তিনি বলেন, ‘যেগুলো নিয়ে আমরা আগে কথা বলতে পারতাম, সেগুলো ছিল আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার। এগুলো নিয়ে কথা বলতে খুব একটা অসুবিধা হতো না গত আগস্টের আগে। এখন স্বাভাবিক যে, আমরা রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার নিয়ে কথা বলছি, যেহেতু এগুলো নিয়ে কথা বলা যেত না আগে।’
সারা হোসেন বলেন, ‘এখানে জেলের ভিতরে এখন পর্যন্ত আমরা দেখছি কেউ কেউ মারা যাচ্ছেন। বাংলাদেশের নাগরিক বম জনগোষ্ঠীর বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। কোনো তদন্ত হয়েছে কি না আমি জানি না। আওয়ামী লীগের কয়েকজন কর্মী জেল-হাজতে মারা গেছেন। আমরা বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত নই এবং এটাকে পাত্তাই দিচ্ছি না।’
মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আমরা করছি না বা করতে পারছি না এবং যারা এই অপরাধে অভিযুক্ত, সেই সব বাহিনী দ্বারা আমরা নিজেদের নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা রক্ষা করতে চাচ্ছি, এটা কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার মতো। বিচারবহির্ভূত হত্যা হচ্ছে, কোনো বিচার দিতে পারছেন না। রিসোর্স নেই এবং একই সঙ্গে এতগুলো কমিশন বানানো হয়েছে। কমিশন দিয়ে বাংলাদেশে কোনো দিন কোনো কিছুর সমাধান হয়নি। এখন যে কাজটা করা দরকার, তা একটা জাতীয় নির্বাচনের জন্য যে প্রস্তুতি নেওয়া।