আনন্দ-উত্তেজনার ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই। সেই সঙ্গে শুরু হয়ে যাবে রাতজাগার প্রহর। একদিকে রাত জেগে টিভিতে খেলা দেখা অন্যদিকে দিনের বেলায় দৈনন্দিন কাজকর্ম। একসঙ্গে দুটি কাজ ২-৪ দিন চালানো গেলেও টানা এক মাস চালানো বোধ হয় সম্ভব নয়। দিনের বেলা ঘুমিয়ে রাতের ঘুম পুষিয়ে নেওয়ার কাজটি আর ক’দিনই টেনে নেওয়া যায়! রাত জেগে খেলা দেখার এই প্রভাব পড়ে দিনের কাজে। আর পছন্দের টিম যদি হেরে যায় তখন নেতিবাচক প্রভাবে আক্রান্ত হয় মনও।
বিশ্বকাপ শুরু হলে ফুটবল প্রেমিকদের অনেককেই ঘুমাতে দেখা যাবে বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে। ক্লান্তিতে ঝিমুতে ঝিমুতে রিকশায় চড়ে অনেকেই সকালে পৌঁছবেন কাজের গন্তব্যে। ঘুম তো আর বলে-কয়ে আসে না। তাই ক্লান্ত শরীর সুযোগ পেলেই ঢলে পড়তে চাইবে বিশ্রামের কোলে।
রাতজাগার প্রভাব কাটাতে: রাতজাগা শরীরের এই ক্লান্তি কাটাতে ফলের রস সবচেয়ে ভালো কাজে দেয়। এ ছাড়া এক গ্লাস পানিতে ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজও খেয়ে নিতে পারেন। আর শরীরটাকে একটু মেলে ধরে, নিতে পারেন গোটাদশেক গভীর শ্বাস।
রাতজাগার পরের দিন লাঞ্চটাও সারতে হবে সাদামাটাভাবে। কয়েক টুকরো সালাদ, সামান্য ভাত কিংবা রুটির সঙ্গে কিছুটা সবজি অথবা মাংস থাকতে পারে। তবে কোনোভাবেই যেন দুপুরের খাবারটি ভরপেট না হয়। এতে ঘুম কম পাবে এবং স্বস্তিতে সেরে নেওয়া যাবে দিনের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে বেশিক্ষণ টেকা যাবে না। ঘুম এলে সুযোগ মতো ঘুমিয়ে নিতে হবে।
দিবানিদ্রা ও গভীর শ্বাস: ঘুমুতে আপনাকে হবেই। তাই সুযোগ পেলেই ঘুমিয়ে নেবেন সুবিধা মতো সময়ে। একেবারে ডিপস্লিপ দিতে পারলে আরও ভালো। শুয়ে গভীরভাবে লম্বা শ্বাস নিতে হবে এবং ছাড়তে হবে। এত করে কম সময়ে শরীরে বিশেষ করে মস্তিষ্কে অক্সিজেন যাবে এবং শরীর তরতাজা লাগবে। আর কোনো কারণে মাসজুড়ে ঘুম কম হলে শরীরে বিশেষ কোনো ক্ষতি না হলেও কাজকর্মের পারফরম্যান্স যে খারাপ হবে। কাজে মন বসবে না, মেজাজ খারাপ থাকবে, শরীরে ঝিমুনি আসবে, মাথাব্যথা থাকতে পারে। এ অবস্থায় গাড়ি ড্রাইভ করা ঠিক হবে না।
টিভি দেখার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: গরম-ঘাম-অনিদ্রা এবং ক্রমাগত টিভি দেখার কারণে ঘাড়ব্যথা, মাথাব্যথা হতে পারে। গরমের অস্বস্তি এড়াতে রাতের গোসল কিছুটা স্বস্তি এনে দিলেও একটু-আধটু সর্দি লেগে যেতে পারে। এ সময়ে মাথাব্যথার জন্য একটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেটই যথেষ্ট। সঙ্গে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে হাত-পা ধুয়ে নিলে শরীরটা ভালো লাগবে। তবে যাদের মাইগ্রেনের ব্যথা রয়েছে তাদের কথা আলাদা, সে ক্ষেত্রে স্ট্যামেটিল ও প্যারাসিটামল জাতীয় ট্যাবলেট একটি করে একসঙ্গে খেয়ে নিয়ে আলোহীন ঘরে বিশ্রাম নিতে হবে। কম ঘুমের জন্য মাইগ্রেন হলে সেক্ষেত্রে ব্যথার ওষুধ খেয়ে লাভ হবে না। তখন ঘুমটাও লাগবে। অনেকেরই ধারণা একটানা রাত জেগে খেলা দেখলে চোখের ক্ষতি হতে পারে। আসলে এ ধারণা ঠিক নয়। তবে চোখে কিছুটা ব্যথা হতে পারে। এক্ষেত্রে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন টিভি সেটটা অন্তত ৭-৮ ফুট দূরে থাকা উচিত। টিভি সেট রাখতে হবে চোখ যে উচ্চতায় রয়েছে একই উচ্চতায়। ঘাড় উঁচু-নিচু করে খেলা দেখতে গেলে ঘাড়ের ব্যথায় অবস্থা কাহিল হয়ে যেতে পারে। ঘাড়ের এই ব্যথা চলে যেতে পারে মাথায় ও চোখে। খেলা দেখার সময় শরীরটাকে কীভাবে রেখে খেলা দেখছেন সেটাও ইম্পর্টেন্ট। শরীরের অবস্থানটা ঠিক না থাকলে কোমর ব্যথাও হতে পারে। কোমরের পেছনে একটা কুশন দিয়ে আরাম করে খেলা দেখুন। একেবারে শুয়েও দেখতে পারেন। মাঝেমধ্যে পাশ ফিরে নেবেন। মাঝেমধ্যে উঠে বসবেন। আড়মোড়া ভাঙলেন। এতে ভালো লাগবে। ঘর পুরো অন্ধকার করে টিভি দেখা ঠিক নয়। মশারির মধ্যে বসে টিভি দেখবেন না। যারা নিয়মিত খেলা দেখছেন তারা হাফটাইমের সময় চোখ বুজে শুয়ে থাকলে আরাম বোধ করবেন। অথবা বারান্দায় পায়চারি করতে পারেন।
রাত জেগে খেলা দেখা এবং খাবার দাবার: অনেকেই হয়তো জানেন ভাত খেলে ঘুম পায়। তাই এই সময়টাতে ভাতের পরিবর্তে রুটি খেলে কিছুটা লাভ হবে। তবে পেটে সহ্য হওয়ার একটা ব্যাপার আছে। যে কোনো খাবারই হোক তা খেতে হবে কম করে। বেশি খাওয়া মানে বেশি ঘুম এ কথাটি মনে রাখতে হবে। খাবার দাবারের উল্টোপাল্টা হলে বদহজম হতে পারে। পেটে গ্যাস হতে পারে।
রাত জাগার আরেকটি সমস্যা আছে। রাত জাগলে বারবার ক্ষিধে পায়। ডায়াবেটিস না থাকলে একটু আধটু বাড়তি খাবারে ঝামেলা নেই। ডায়াবেটিস না থাকলে গ্লুকোজ পানি খেতে পারেন। এতে ক্লান্তি ও ক্ষিধে দুটোই কমবে। তবে অনেকেই চা বিস্কুট চিপস্ চানাচুর ইত্যাদি নিয়ে বসেন। বয়স কম হলে এসবের কোনো কিছুতেই সমস্যা হয় না। তবে যাদের পেটে গ্যাস হয় তাদের এগুলো ভেবেচিন্তে খেতে হবে। মুড়ি, পপকর্ন খেলে গ্যাস কম হয়। চানাচুর, চা-কফিতে কারও কারও গ্যাস বাড়তে পারে। তবে সিগারেটে পেটে গ্যাসসহ অনেক ধরনের অস্বস্তি হতে পারে। যে সব খাবারে গ্যাস হয় সেগুলো না খাওয়াই ভালো। রাতে হালকা খাবার খেলে শরীর চাঙ্গা থাকবে। খাওয়ার সময়টা একটু এগিয়ে নিয়ে আসতে পারেন। খাওয়ার পরই ঝিমুনিভাব দেখা যায়, তাই আগে খেয়ে ঝিমুনিভাবটা আগেই কাটিয়ে নিতে হবে।
খেলার সময় ক্ষিধে নিবারণের জন্য বিস্কুট, মুড়ি, পপকর্ন খাওয়া যেতে পারে। রাত জাগলে এসিড নিঃসরণ বাড়ে, অনেকের ঢেঁকুর উঠতে থাকে বুকজ্বলেÑ এটিকে বলে এসিড রিফ্লাক্স। এসব ক্ষেত্রে ইসমোপ্রাজল বা ওমিউপ্রাজল জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে এন্টাসিড জাতীয় ওষুধ খেলেই হয়। তবে একটু বেশি পরিমাণে পানি কিংবা ফলের রস খেলে রাতের খেলা দেখার সময়টি ভালোই কাটবে। খাওয়া যেতে পারে আস্ত ফলও।
রোগ থাকলে বাড়তি সতর্কতা: প্রিয় দলের খেলা দেখার বাড়তি উত্তেজনা হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় ইংলান্ডের দর্শকদের ওপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সেই সময়ে ইংল্যান্ডের সঙ্গে অন্য কোনো দলের খেলার দিন বা তার কয়েক দিনের মধ্যে দর্শকদের অনেকেই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। অন্যান্য দিনের তুলনায় সেবার ইংল্যান্ডের খেলা থাকার দিনে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার শতকরা ২৫ শতাংশ বেড়ে যায়। ২০০২ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে এই সমীক্ষার উপসংহারে বলা হয় প্রিয়দলের খেলা নিয়ে অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও উত্তেজনার কারণে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের মতো দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।
বিশ্বকাপ নিয়ে আরেক স্প্যানিশ গবেষণায় দেখা গেছে, খেলা দেখার সময় উত্তেজনা টেস্টোস্টেরন নামক হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। খেলা দেখার সময় এই টেস্টোস্টেরন বেড়ে গেলে দর্শক উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে মারমুখী হয়ে ওঠে। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে রাত জেগে খেলা দেখার কারণে সৃষ্ট উত্তেজনায় রক্তে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে মানসিক চাপ আরও প্রকট আকার ধারণ করে। সবকিছু মিলিয়ে খেলা দেখতে গিয়ে রাত জাগলে রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদির কষ্ট কিছুটা বাড়ে। এসব রোগ স্ট্রেসের সঙ্গে সম্পর্কিত। খেলা দেখার সঙ্গে সরাসরি স্ট্রেসের বিষয়টি জড়িত। এই স্ট্রেসের মধ্যে রয়েছে পজিটিভ স্ট্রেস এবং নেগেটিভ স্ট্রেস। প্রিয় দলে বিজয়ের আনন্দ একধরনের পজিটিভ স্ট্রেস। তবে এই স্ট্রেস টানা ৭ দিন চললেই কিন্তু ব্লাডসুগার বাড়বে। বাড়তে পারে ব্লাড প্রেসারও। এ জন্য কোনো ওষুধের ডোজ বাড়ানো ঠিক হবে না। বরং বিশ্রাম নিতে হবে। অসুক-বিসুখ নিয়ে বাঁধনহারা হলে কি চলে? দিনের ৮-৯ ঘণ্টা কাজের পর ৩-৪ ঘণ্টার খেলা দেখা সেরে বাকি সময়টাতে বিশ্রাম নিতে হবে। ঘুমটা যাতে নিরবচ্ছিন্ন হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। যাদের ইপিলেপসি বা মৃগীর সমস্যা রয়েছে তাদের ঘুম কম হলে সমস্যা দেখা দিতে পারে। একইভাবে সমস্যা হতে পারে যাদের গ্লুকোমা রয়েছে তাদের।
তারপরও খেলা দেখুন: মনের ওপর বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রভাব অনেক। প্রিয় দলের বিজয়ে যেমন একজন ফ্যান যেমন খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে, তেমনি পরাজয়ে ততটাই ভেঙে পড়ে মানসিকভাবে। যার সূত্র ধরে অনেক সময় আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে অনেকবার। বিশ্বকাপ ফুটবলের ওপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ২৫ ভাগ ফুটবল ফ্যানই ফুটবলকে তাদের জীবনের একটি অংশ মনে করে। আর এই ফুটবল তাদের মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্বকাপ ফুটবল চলার সময় হাসপাতালগুলোতে মানসিক রোগীর সংখ্যা কমে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, দলবেঁধে ফুটবল খেলা উপভোগের কারণে মানুষের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা গড়ে ওঠে। সেই সঙ্গে একসঙ্গে খেলা দেখার কারণে গড়ে ওঠে সামাজিক সম্পর্ক। ফুটবল খেলা দেখার সময় গড়ে ওঠা এই সামাজিক বন্ধনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। শুধু সমাজই নয়, বিশ্বকাপ ফুটবলকে ঘিরে পরিবারের মধ্যেও নতুন করে বন্ধন গড়ে ওঠে। অনেক পিতামাতাই সন্তানদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খেলা উপভোগ করেন। পরিবারে সবাই মিলে উপভোগ করার এই সময়টি তাদের প্রত্যেকের জীবনেই অতি মূলবান সময় হিসেবে গণ্য করে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ সন্তানদের কাছে বাবা-মা’র সঙ্গে বসে বিশ্বকাপ ফুটবল উপভোগের এই স্মৃতি তার জীবনের স্মরণীয় সুখকর ঘটনা হয়ে সারাজীবন তাকে উদ্বেলিত করবে। গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাবার সঙ্গে ছেলেরা ফুটবল খেলা দেখে থাকেন। খেলা দেখার মাধ্যমে পিতা-পুত্রের মধ্যে সম্পর্কের যে উন্নয়ন ঘটে অন্য কোনোভাবেই এতটা স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীলভাবে তা সম্ভব হয় না। কাজেই ফুটবলের ইতিবাচক প্রভাবে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত হয়, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে শরীরের ওপর।