রাজউকের বোর্ড সভার সদস্যসংখ্যা পাঁচ। কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে বেশির ভাগ বোর্ড সদস্যের ঐকমত্যেই তা হতে হয়। পাস করা প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এই প্রতিষ্ঠানে গত পাঁচ বছরের বোর্ড সভায় ৪০০ ব্যক্তিকে নিয়মবহির্ভূতভাবে তাদের নামে বরাদ্দকৃত প্লটের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলাও করেছে। কিন্তু মামলায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, রাজউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নূরুল হুদাসহ ক্ষমতাবানদের পাশ কাটিয়ে আসামি করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট সচিবকে।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালে ড. খোন্দকার শওকত হোসেন নিজের ও পরিবারের নামে বরাদ্দ পাওয়া প্লটের আয়তন বাড়িয়ে নেন। এ কারণে বর্তমানে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের দায়িত্বে থাকা সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেছে দুদক। অথচ ৪০০ প্লটের আয়তন একই সময়ে একই অনিয়মে রাজউকের বোর্ডসভায় অনুমোদন পায়। বরাদ্দকৃত প্লটের আয়তন যাদের বেড়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন দুদকের একজন কমিশনার ও সচিব, আওয়ামী লীগের পাঁচ মন্ত্রী, ১১ বিচারপতি, আওয়ামী লীগের ১৪ সংসদ সদস্য, পুলিশের আইজি, মন্ত্রিপরিষদসচিবসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা। এমনকি তালিকায় দেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক, সম্পাদকও রয়েছেন। কিন্তু এই অনিয়মে মামলা হয়েছে শুধু তৎকালীন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে।
নিয়ম অনুযায়ী মামলা হওয়ার কথা রাউজকের বোর্ডসভার সব সদস্যের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া রাউজকের সব ক্ষমতা যে মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খানের হাতে ছিল, তার বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান হয়নি। এসংক্রান্ত অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে, এমন ২০ জনের মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমতি দিয়েছে দুদক।
এ বিষয়ে মামলার বাদী ও দুদকের উপপরিচালক যতন কুমার রায় বলেন, 'প্রবাসীকল্যাণসচিবের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন পাওয়ার পরপরই মতিঝিল থানায় পৃথক তিনটি মামলা করা হয়েছে। মামলার অনুমোদন চাওয়া হয়েছিল ২০ জনের বিরুদ্ধে, কিন্তু একজনের বিরুদ্ধে কেন মামলা? জবাবে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।'
সূত্র জানায়, দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা যতন কুমার রায় দীর্ঘ এক বছর অনুসন্ধান করে নূরুল হুদাসহ রাজউকের সাবেক তিন চেয়ারম্যান ছাড়া ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমতি চেয়ে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেন। সেই প্রতিবেদনে রাজউকের সদ্য অবসরে যাওয়া নূরুল হুদা ও সাবেক দুই চেয়ারম্যান মো. শহীদ আলম, মো. আজিজুল হকসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন চাওয়া হয়। কিন্তু কমিশন শুধু প্রবাসীকল্যাণসচিব ছাড়া অন্যদের নাম বাদ দিয়ে মামলার অনুমোদন দিয়েছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'মামলার অনুমোদন চাওয়া হলো একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে, কিন্তু অনুমোদন মিলল একজনের বিরুদ্ধে। এটা কমিশন দ্বিমুখী আচরণ করেছে।'
দুদক সূত্র জানায়, গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব থাকাকালে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে ড. খোন্দকার শওকত হোসেন ছাড়াও যাদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করা হয়েছিল তারা হলেন রাজউকের বর্তমান চেয়ারম্যান নূরুল হুদা, সাবেক দুই চেয়ারম্যান মো. শহীদ আলম ও মো. আজিজুল হক, সাবেক বোর্ড সদস্য কে এ এম হারুন, মো. নাসির উদ্দিন, রেজাউল করিম তরফদার, নাজমুল হাই, বর্তমানে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আখতার হোসেন ভূঁইয়া, বর্তমানে ঢাকা (উত্তর) সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. আনোয়ারুল ইসলাম সিকদার, খাদ্য অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক এম মাহবুব উল আলম, প্রবাসীকল্যাণসচিব খোন্দকার শওকত হোসেনের স্ত্রী ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ড. আয়েশা খানম ও মা জাকিয়া আহমেদসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। প্রায় এক বছর ধরে অনুসন্ধান শেষে গত ১৬ মার্চ প্রতিবেদনটি কমিশনে জমা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে অনেকেরই নাম ছিল, কিন্তু কমিশন তাদের নাম বাদ দিয়েছে। তাদের এফআইআরভুক্ত করা হয়নি। তবে দুদকের তদন্তে ওই সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণাদি পাওয়া গেলে তাদেরও চার্জশিটে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।'
জানা গেছে, দুদকের উপপরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তা যতন কুমার রায় বাদী হয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর মতিঝিল থানায় পৃথক তিনটি মামলা করেন (মামলা নং-৮, ৯ ও ১০)। এর আগে বিকেল ৩টায় কমিশনের নিয়মিত সভায় মামলাটি অনুমোদন দেওয়া হয়। দুদকের উপপরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, 'গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব থাকাকালে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে ড. খোন্দকার শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে অভিযোগে তাঁর সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দিয়েছে দুদক।'
অনিয়মের মাধ্যমে প্লটের আয়তন বৃদ্ধিতে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানসচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেন বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগে মামলাটি করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ হয়রানিমূলক ও ভিত্তিহীন। কারণ একইভাবে রাজউকের বিধি অনুযায়ী চার শতাধিক ব্যক্তি প্লটের আয়তন বাড়িয়ে নিয়েছেন। আমি আশা করব, তদন্তকালে দুদক প্রকৃত অবস্থা বিবেচনায় নেবে। তাহলে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হব।'
খোন্দকার শওকত হোসেন আরো বলেন, 'রাজউকের যাবতীয় কার্যক্রম সরকারের প্রচলিত নিয়ম ও বিধিবিধান অনুযায়ী বোর্ডের সিদ্ধান্তমতো বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। রাজউকের সব প্লট বরাদ্দ, নিলামে প্লট বিক্রি, প্লট পরিবর্তন, আয়তন পরিবর্তনসহ বিভিন্ন বিষয়ে রাজউক আইনের ১০১ নম্বর ধারার ক্ষমতাবলে বোর্ড সভার অনুমোদন নেওয়া হয়। প্লটগ্রহীতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সভার সিদ্ধান্তক্রমে খালি প্লটপ্রাপ্তি সাপেক্ষে প্লটের আয়তন বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে। বরাদ্দকৃত প্লটের আয়তন বৃদ্ধির বিষয়টি রাজউকের একটি চলমান প্রক্রিয়া।'
উল্লেখ্য, ড. খোন্দকার শওকত হোসেন ২০০১ সালে সম্প্রসারিত উত্তরা প্রকল্পে নিজের নামে তিন কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন। সেটা অনিয়মের মাধ্যমে তিন কাঠা থেকে পাঁচ কাঠায় রূপান্তর করেন। সেখান থেকে আবার দুই কাঠা জমি বিক্রি করে দেন। কিন্তু পরে ওই জমি ডেভেলপমেন্টের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়ার সময় পুরো পাঁচ কাঠার আমমোক্তার (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) প্রদান করেন এই সচিব।