রাজধানীর রামপুরায় ঝিলের ওপর নির্মিত একটি দোতলা টিনশেড ঘর দেবে গিয়ে একই পরিবারের তিনজনসহ ১২ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জনই নারী।
নিহতরা হলেন-নিজাম উদ্দিন (৪৫), তার স্ত্রী কল্পনা (৪৫), ছেলের বউ রোকসানা (২১), মিজানুর রহমান (৩০), হারুনুর রশীদ (৫৬), সাইফুল ইসলাম (১৪), জাকির হোসেন (৩৫), সাজেদা (৪৯), ফারজানা (১২), জ্যোৎস্না (৪০), রুনা (১৫) ও অজ্ঞাত একজন পুরুষ। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আহতদের স্থানীয় হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।
এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, গতকাল বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে মালিবাগ চৌধুরীপাড়া মাটির মসজিদ এলাকার বউবাজার ঝিলের ওপর তৈরি দোতলা টিনশেড ঘরের নিচ তলার পুরোটাই কাদার নিচে দেবে গেছে। এতে পানিতে ডুবে এবং চাপা পড়ে ১২ জনের মৃত্যু হয়। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মর্গে পাঠিয়েছে। অতিরিক্ত জেলা মেজিস্ট্রেট শহিদুল ইসলামকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। ৩ থেকে ৫ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ঢাকা জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে গতকাল রাতে এ কথা জানান। এ ছাড়া আহত ও নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ৫ ও ২০ হাজার টাকা অর্থ সহায়তা দেওয়ার কথা জানান তিনি। টিনের ঘর কারা বানিয়েছে তা তদন্ত করে বের করা হবে। আর এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জনান তিনি।
মর্মান্তিক এ ঘটনায় মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় ঝিলপাড় এলাকা। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে এলাকার আকাশ-বাতাস। কেউ হারিয়েছেন সন্তান, কেউ বাবা-মা, আবার কেউ স্ত্রী-পুত্র-কন্যা। দুর্ঘটনার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে রাতেই নিহতদের আত্মীয়স্বজন রাজধানী ও এর বাইরে বিভিন্ন জায়গা থেকে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। এ ঘটনার জন্য অনেকেই ঘরের মালিক বা যারা ভাড়া নিতেন তাদের অবহেলাকে দায়ী করেছেন। আবার অনেকেই টিনশেড ঘরে বসবাসকারীদের অসচেতনাকেও দায়ী করেছেন। টিনশেডে বসবাসকারী ও নিহতদের সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। দেখা যায়, দোতলা টিনশেড ঘরটির নিচতলা পুরো অংশই পানির মধ্যে কাদায় দেবে যায়। গভীর রাত পর্যন্ত দুটি ক্রেন দিয়ে উদ্ধার কাজ চালাচ্ছিল ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালক এ বি এম নুরুল হক জানান, ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের ৬টি ইউনিট উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছে। কয়েকজন ডুবুরি নামানো হয়। এ ছাড়া স্থানীয় লোকজন উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করে। পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন জানান, ঝিলের ওপর তৈরি দোতলা টিনশেডের ২০টি ঘরে লোকজন থাকত। এর মধ্যে নিচ তলার পুরোটাই ঝিলের কাদায় দেবে গেছে। প্রাথমিকভাবে একই পরিবারের তিনজনসহ ১২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীও রয়েছেন। ভিতরে আরও অনেকে আটকে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ওই বাড়ির মধ্যে মোট ২২টি কক্ষ ছিল। প্রতিটি কক্ষে এক একটি পরিবারের বসবাস ছিল। কোনো কোনো পরিবারে সদস্য সংখ্যা ৪, আবার কোনো কোনো পরিবারে ৮ থেকে ১০ জন সদস্য বসবাস করত। ঘরটির একবারে বামপাশে টয়লেট, রান্নাঘর ও গোসলখানা। ওগুলো বাদে বাকিগুলো বসবাসের কক্ষ।
ডিসি আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, টিনশেড ঘরগুলোর মালিক স্থানীয় যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান। ঘটনার পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। পুলিশ তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে। ঘরগুলো বৈধ না অবৈধ বিষয়টি দেখার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। যেহেতু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে সেহেতু আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জানা গেছে, নিজাম ওই টিনশেড ঘরের নিচ তলায় থাকতেন। তার বাড়ি বরগুনার ২ নম্বর ইউনিয়নে। নিজাম আখের রস বিক্রি করতেন। স্ত্রী কল্পনা আক্তার, ছেলে সবুজ ও তার বউ রোকসানা আক্তারকে নিয়ে নিজাম টিনশেড ঘরে ভাড়া থাকতেন। ঘর দেবে গেলে তারা কাদা পানিতে আটকা পড়েন। নিজাম ঘটনাস্থলে মারা যান। কল্পনা ও রোকসানাকে খিলগাঁও খিদমাহ হাসপাতালে ভর্তি করার পর তাদের মৃত্যু হয়। মিজানের বাড়ি ঝালকাঠির রাজাপুরে। তিনি রিকশা চালাতেন।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, বাঁশ ও টিনের তৈরি এ বাসস্থানটি দেবে যাওয়ার পর পরই হেলে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের ৬টি ইউনিট উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। বেশ কয়েকজন ডুবুরিও নামানো হয়। এ ছাড়া রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবক ও স্থানীয়রা উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করেছেন। রামপুরার বউবাজার ঝিলের মধ্যে স্থানীয় প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে ঘরগুলো তৈরি করে। তারা বাড়তি আয়ের উদ্দেশে সরকারি অনুমোদন না নিয়েই ঘরগুলো তৈরি করে। ঘরগুলোতে নিম্ন আয়ের লোকজন বসবাস করেন। বাঁশের সাঁকো তৈরি করে চলাচল করা হতো। টিনের ঘরের বাঁশ পানিতে পচে দুর্ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয়রা জানান, বউবাজারের ঝিলটি রেলওয়ের জমি। স্থানীয় যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান রেলওয়ের কাছ থেকে কোনো প্রকার অনুমতি না নিয়েই ঘরগুলো নির্মাণ করেন। ঘরগুলো অনেক আগ থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এ ছাড়া ওইসব ঘরে বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন ছিল অবৈধ। ঝিলটি দখল করতে আশপাশেও টিনের অনেক ঘর তৈরি করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা।