গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানে ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার হত্যাকাণ্ডের পর ইসলামিক স্টেট (আইএস) দায় স্বীকার করেছে বলে টুইটারে বার্তা দেন রিটা কাৎস নামের এক ইরাকি বংশোদ্ভূত মার্কিন নারী। সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ'র পরিচালক। ৩ অক্টোবর রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও এবং ২৪ অক্টোবর রাতে পুরান ঢাকার হোসেনী দালানে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার দায় আইএস স্বীকার করেছে বলেও প্রচার করেন ওই নারী। প্রশ্ন উঠেছে কে এই রিটা কাৎস। কীভাবেই বা তিনি আইএস'র কোন বিবৃতি ছাড়াই এসব ঘটনায় জঙ্গি সংগঠনটির সংশ্লিষ্টতার ঘোষণা দিচ্ছেন?
এদিকে আইএস যে এসব ঘটনার দায় স্বীকার করেছে সে বিষয়ে কোনো সূত্রের উল্লেখ করেননি 'সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ'র পরিচালক রিটা কাৎস। আর এসব ঘটনায় দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সূত্র হিসেবে সাইট (Search for International Terrorist Entities-SITE) ইন্টেলিজেন্সের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে।
মানবজাতির জন্য হুমকি হয়ে ওঠা নৃশংস জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস যেকোনো হামলার পর তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইট বা জিহাদি সাইট বা সংবাদমাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানোর মাধ্যমে ঘটনার দায় স্বীকার করে। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ড ও তাজিয়া মিছিলে হামলার দায় স্বীকারে সংগঠনটির এ ধরনের কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি।
সবশেষ সোমবার সৌদি আরবের একটি মসজিদে দুর্বৃত্তরা আত্মঘাতী বোমা হামলা চালালে তিনজন নিহত হন। যা পরবর্তীতে টুইটারে দায় স্বীকার করে আইএস। ২০১৪ সালে সংগঠনটি আমেরিকান সাংবাদিক জেমস ফলের শিরশ্ছেদের দায় স্বীকার করে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি পাঠায়। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও প্রচার করা হয় ইউটিউবে। কিন্তু বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত ঘটনাগুলোয় আইএস এমন কোন বিবৃতি বা টুইট করেনি। তাহলে কেন উঠছে আইএস প্রসঙ্গ? কেন এসব ঘটনার মূল হোতার বিষয়ে বিশ্ব মিডিয়াকে নির্ভর করতে হলো সাইট ইন্টেলিজেন্সের ওপর?
সরকার ও হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নিয়োজিত সংস্থাগুলো দাবি করছে, দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ড ও তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলায় আইএস'র সম্পৃক্ততা নেই।
গত শনিবার হোসেনী দালানে বিস্ফোরণের দুই ঘণ্টার মধ্যে আইএস দায় স্বীকার করেছে বলে সাইট ইন্টেলিজেন্স টুইট করে (the 3rd operation claimed by #ISIS in #Bangladesh in less than a month)। আর ভোর ৫টা ৩৫ মিনিটে রি-টুইট করেন রিটা কাৎস।
ওই টুইটের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়। অনেকে সাইট ইন্টেলিজেন্সের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একজন এমনও লিখেছেন- 'আমি বুঝতে পারি না, আইএস কেন বিষয়গুলো প্রথম তোমাদেরকেই জানায়? কেনইবা তারা কোনো বিবৃতি দেয় না?
এদিকে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, সাইট ইন্টেলিজেন্স যে তথ্য প্রচার করেছে তা সঠিক নয়। আর আইএস কোন মাধ্যমে দায় স্বীকার করেছে সে বিষয়টি জানাতে রিটা কাৎসের সঙ্গে ই-মেইলে জানতে চাওয়া হয়েছে।
এর আগে ২০১৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম ছিল এমন- সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ আসলে কারা, যারা জিহাদিদের আগে 'সটলফ' ভিডিও প্রচার করেছে?
ওই রিপোর্টে বলা হয়, আমেরিকান সাংবাদিক স্টিভেন জোয়েল সটলফের শিরশ্ছেদের ভিডিওটি জিহাদিদের আগে সাইট ইন্টেলিজেন্স প্রকাশ করেছে। ২০১৪ সালে ২ সেপ্টেম্বর আইএস সটলফকে হত্যা করে।
এর আগে গত বছরের আগস্টে জেমস ফলে নামে এক মার্কিন সাংবাদিককে গলা কেটে হত্যার ভিডিও প্রকাশ করে আইএস। দুই বছর আগে ওই সাংবাদিক সিরিয়ায় নিখোঁজ হন।
এদিকে রিটা কাৎস'র ব্যক্তিজীবন, কর্মজীবন ও সংস্থার ব্যাপারে তথ্য নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সাবেক পরিচালক জোশ ডেভনের সঙ্গে সাইট ইন্টেলিজেন্স গড়ে তোলেন রিটা। যদিও ডেভন পরে এটি ছেড়ে দেন।
আগে প্রকাশ্যে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কাজ করেছেন রিটা। কাজ করেছেন মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর (এফবিআই) সঙ্গেও। অনর্গল আরবি ভাষায় কথা বলতে পারার কারণে ছদ্মবেশে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’র হয়েও কাজ করেছেন তিনি।
১৯৬৩ সালে ইরাকের বসরায় জন্মগ্রহণ করেন রিটা। মোসাদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ১৯৬৯ সালে সাদ্দাম হোসেনের সরকার রিটার বাবাকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়। রিটাসহ তিন শিশু সন্তান নিয়ে তার মা পালিয়ে যান ইরানে। সেখান থেকে পাড়ি জমান ইসরায়েলে। রিটা প্রথমে চাকরি করেন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীতে।
এরপর প্রতিরক্ষা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি, ইতিহাস আর মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ে ডিগ্রি নেন। ১৯৯৭ সালে চিকিৎসক স্বামীর সঙ্গে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। তবে জাল ভিসার কারণে সেখানে তিনি আটক হন।
১৯৯৭ সালেই যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে চাকরি পান রিটা। হলিল্যান্ড ফাউন্ডেশন নামের একটি গ্রুপ হামাসের পক্ষে কাজ করছে- বিষয়টি নজরে এনে গোয়েন্দাগিরিতে অবস্থান পোক্ত করেন।
২০০২ সালে ইরাক আক্রমণের আগে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলমানদের ওপর কড়া নজরদারি শুর হয়। এ সময় রিটা ও ডেভন মিলে ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ’ গড়ে তোলেন। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও তা অনলাইনে ফাঁস করাই সংস্থাটির মূল কাজ। আল-কায়েদা নেটওয়ার্ক, আইএস নেটওয়ার্ক, হামাস, ইসলামিক জিহাদ ও হিজবুল্লাহ নিয়ে তার প্রতিষ্ঠান নিয়মিত প্রচারণা চালিয়ে থাকে।
বিডি-প্রতিদিন/২৭ অক্টোবর ২০১৫/ এস আহমেদ