সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া প্রদেশে মাউন্ট কার্স্টেনজ পিরামিড শৃঙ্গ জয় করে দেশে ফিরেছেন মুসা ইব্রাহিম। তার এই অভিযান এবং তাকে নিয়ে উঠা বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে সোমবার ক্যাপিটাল এফএম-এর সঙ্গে খোলামেলা জবাব দিয়েছেন দেশের প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী। নাফিজ রেদোয়ানের উপস্থাপনায় এসময় আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি, যেগুলো প্রায়ই তাকে ঘিরে উচ্চারিত হয়।
মুসা ইব্রাহিম বলেন, এভারেস্টে জয়ের পর অাফ্রিকার মাউন্ট কিলিমানজারো পর্বতে গিয়েছি। আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত এটি। যা উত্তর-পূর্ব তাঞ্জানিয়াতে কেনিয়ার সাথে সীমান্তে অবস্থিত। কিলিমানজারো একটি মৃত আগ্নেয়গিরি। এর কিবোর জ্বালামুখ সর্বদাই বরফে আবৃত থাকে। ১৯ হাজার ৩৪০ ফুটের মতো উঁচু। ১০ দিনের মতো সময় লেগেছে এ পর্বতারোহণে।
তারপর রাশিয়ার মাউন্ট এলব্রুস গিয়েছি, রাশিয়ার ককেশাস পার্বত্য অঞ্চলে জর্জিয়ার সীমান্তে অবস্থিত পাঁচ হাজার ৬৪২ মিটার (১৮৫১০ ফুট) উচ্চতায় ইউরোপ মহাদেশের সবচেয়ে উঁচু পর্বত মাউন্ট এলব্রুস।
অস্ট্রেলিয়ার কসিয়াসকো পর্বতারোহণ করেছি, এটির উচ্চতা প্রায় ৭ হাজার ৩২০ ফুট।
মুসা ইব্রাহিম বলেন, এরপর নর্থ আমেরিকা মাউন্ট ড্যানালিতে আরোহণ করা হয়েছে। ড্যানালি জয় খুবই কঠিন একটা কাজ ছিল, কারণ কোনো শেরপা সাথে ছিল না। প্রচুর ঠাণ্ডা ছিল, বরফ জ্বাল দিয়ে পানি গরম করতে হয়েছে, তুষার ঝড়, বরফে ঢেকে যেত টেন্ট (তাবু)। একটু পরপর পরিষ্কার করে দিতে হয়েছে, নামার সময় বরফের ফাটল আছে কিনা তা বুঝতে বেশ কষ্ট হয়, কারণ আমাদের উঠার ট্রেইল নষ্ট হয়ে যায়। ৯ দিন লেগেছে উঠতে। আর ফেরাসহ মোট ১৫ দিন।
সবশেষ গত মাসে ইন্দোনেশিয়ার মাউন্ট কার্স্টেনজ পর্বতারোহণ করলাম। ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া প্রদেশে এটি অবস্থিত, প্রায় ১৬ হাজার ফুট উচু। ট্র্যাকিং খুবই দুর্গম ছিল। গাইড বলেছে, ৫ দিন সময় লাগবে। প্রথম তিনদিন টিকতে পারলে সামনে এগিয়ে যাওয়া যাবে, রেইন ফরেস্টের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। যেখানে সারা দিন-রাত বৃষ্টি হচ্ছে। পথ খুবই পিচ্ছিল কর্দমাক্ত। গাছের শিকড়ের ওপর পা দিয়ে খুব সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হয়। পা মচকানোর সম্ভাবনা ছিল প্রচুর। প্রথম দুই দিনের পথ তিনদিন লাগলো, মোট ছয় দিন লেগেছে।
আমাদের সঙ্গে যে গাইড ছিল তিনি বলল, আপনি মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন, সেটা এখানে ভুলে যান। তার নাম রোমি, সে এ পর্যন্ত ৭০ বার ওই পর্বত আরোহণ করেছে, আরেকজন ছিল নরেন, সে ২৮ বার। রেইন ফরেস্টের কোন পথে যাব তা আমরা জানতাম না। সাড়ে ১৩ হাজার ফুট ওপরে ছিলাম আমরা। সেখান থেকে সামিটে যেতে হবে। রাত ২টায় রওনা দেওয়ার কথা থাকলেও রাত সাড়ে তিনটায় রওনা দিলাম। ঘণ্টা খানিক পর সূর্যের দেখা মিলল। তারপর আবার রওনা, ১১টা ৪৫ মিনিটে পৌঁছালাম চূড়াতে।
এছাড়া ফেরার পথে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। মুসা ইব্রাহিম বলেন, প্রচণ্ড বাতাস ছিল, ঠাণ্ডায় হাত ফ্রিজ হয়ে আসছিল। ভাগ্যিস ওইদিন সাব জিরো ছিল না, আমার ঘণ্টা খানিক লাগলো। আর আমাদের টিমের নন্দিতা তো ওই দিন অনেক স্লো ছিল, তার সোয়া দুই ঘণ্টা লাগে।
ফেরার পথে বাধ্য হয়ে হেলিকপ্টারের সহযোগিতা নিতে গিয়ে আটকা পড়েছিলাম। পঞ্চম দিনে আমরা অনড় ছিলাম ফেরার জন্য রওনা দিতে। ওই সময় ভাত সিদ্ধ করে লবণ দিয়ে খেয়েছি। চাল শেষ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ফিরতে পেরেছি।
এভারেস্ট ও বাংলা চ্যানেলের জয় নিয়ে ফেসবুকে ট্রলসহ নানা গুজব ছড়িয়েছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুসা ইব্রাহিম বলেন, 'যারা এগুলো নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করেছে, যাদের রিপোর্ট নিয়ে এ ট্রল হয়েছে সেটা একাত্তর টিভির, ২০১৪ সালে একাত্তর টিভি এ রিপোর্ট করেছিল। আর আমার সাঁতার নিয়েও বানোয়াট একটা রিপোর্ট তারা করেছে।
আর আমরা জয় করেছি ২০১১ সালের ৯ মার্চ। এ বিষয়ে আমার বইয়ে অামি লিখেছি, ফেসবুক নোটের মধ্যে উল্লেখ করেছি। নৌকায় উঠেছি, জীবন শঙ্কার মধ্যে পড়েছিল দেখে, আমি নৌকায় উঠেছি। সেটা কখনোই ৫-১০ মিনিটের বেশি নয়। সেটা আমি বহু আগে থেকে বলে আসছি, সেই ২০১১ সাল থেকে। আর সেটাই যদি হয়, তাহলে তাদের রিপোর্টের ভিত্তি আসলে কতটা থাকে?
সেটা একটা প্রশ্ন আমার তাদের কাছে? এবং তারা যে হলুদ সাংবাদিকতা করে, তারা যেন সেই সাংবাদিকতা থেকে বেরিয়ে আসে, আমি বলব তারা যেভাবে আমাদের বহু তরুণ তরুণীকে বিভ্রান্ত করেছে, আমার মনে হয় সেই তরুণ তরুণীদের কাছে তাদের ক্ষমা চাওয়ার একটা সময় এসে গেছে। হলুদ সাংবাদিকতা বলি আর ভুল সাংবাদিকতা বলি, এর মাধ্যমে যে কাউকেই হোক তারা কিন্তু বিভ্রান্ত করতে পারে না।
এটলিস্ট মানুষকে তারা বিভ্রান্ত করতে পারেনি। আমি তাদের কাছে আহ্বান করব যে, মানুষকে তারা যেভাবে বিভ্রান্ত করেছে, সেখান থেকে মানুষকে তারা যেন বের করে নিয়ে আসে।
তারা যদি সাংবাদিকতা করতেই চায়, তাহলে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটুকু ফুটেজ দেখানো হোক। ফুটেজের মেটা-ডাটা পরীক্ষা করা হোক। করে বলা হোক, পরীক্ষা করে বলা হোক আমি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আসলে ট্রলারে ছিলাম কিনা। এবং যখনই ক্যামেরা সামনে এসেছে আমি লাফ দিয়ে পানিতে নেমে ক্যামেরার সামনে হাজির হয়ে বুক ফুলিয়ে বলেছি যে, হে অামি বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিলাম। এটা আমি করেছি কিনা, এটা তারা বলুক। মেটা-ডাটা পরীক্ষা করেই এটা তারা বলুক।
বাংলা চ্যানেলের সঙ্গে আপনিও যে একজন এভারেস্ট বিজয়ী সেখানেও কিন্তু আপনাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করা হয়েছিল? বলা হয় যে, এম এ মুহিত ও নিশাত মজুমদার প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী। আর নেপালের যে এভারেস্ট অ্যাসোসিয়েশনের তালিকা সেখানে নাকি আপনার নাম নেই?
এবার মুসা ইব্রাহিম বলেন, ওইটাই বলছিলাম, আর কি, একাত্তর টিভির যে সাংবাদিক এই রিপোর্টটা করেছেন আর কি, তার মেধা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে? পর্বত আরোহণ তিনি আসলে বুঝেন কিনা! সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। নেপাল মাউন্টেইন অ্যাসোসিয়েশন তাদের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে যে ম্যাগাজিনে এই এভারেস্ট জয়ীদের তালিকা রেখেছে সেখানে ২০১০ সালে বাংলাদেশ থেকে আমরা প্রথম গিয়েছি। নামটা নেই, আমাদের নাম নেই, বাংলাদেশের নাম নেই, বাংলাদেশি কারোরই নাম নেই ওই ম্যাগাজিনে।
আর ২০১১ সালে যিনি গেলেন এম এ মুহিত, তার নামের তালিকাও তো ২০১১ সালের ম্যাগাজিনে নেই। তার মানে কি তিনি ২০১১ সালে যান নাই। আর তাই যদি হয় তাহলে নেপাল মাউন্টেইন অ্যাসোসিয়শনের তথ্যকে আমরা কতটা 'অথেনটিক' ধরব। আসলে এটাকে শুধু আমরা 'অথেনটিক' হিসেবে ধরতে পারি না। আর ২০১০ সালে ২৩ মে আমরা যারা নেপাল দিয়ে না গিয়ে তিব্বত দিয়ে এভারেস্টে উঠেছি।
আমি তিব্বত দিয়ে গিয়েছি। আর তিব্বত দিয়ে যারা এভারেস্টে গেছে তাদের কারো নামই ওই ম্যাগাজিনে নেই, তাহলে তারা যে গেছে সেটা কি মিথ্যা?
আমার সাথে যারা ছিলেন, মন্টেনিগ্রোর তিনজন পর্বতারোহী। এবং সার্বিয়ার একজন পর্বতারোহী, নেপালের একজন পর্বতারোহী তাদের কারোরই নাম নেই। তাহলে তারা কি পর্বতারোহণ করেননি। মানে এভারেস্ট জয় করেননি। তাদের দেশের পতাকা যে তারা নিয়ে গেলেন, মন্টিনিগ্রোর তিনজন মানুষ যে তাদের দেশ থেকে প্রথম গেলেন, তাহলে তাদের নাম কি মুছে যাবে?
এই কারণেই বলছি, যেই সাংবাদিক এই রিপোর্টটা করেছেন। তার মেধা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। এবং তাকে অনুরোধ করব যে তিনি যেন, এই যে বাংলাদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন এভারেস্ট জয় নিয়ে এবং যে বিভ্রান্তি নিয়ে ফেসবুকে মানুষ এখন বেশ কথাবার্তা বলছে, তার কাছে অনুরোধ থাকবে তিনি যেন সত্যটা আসলে কি সেটা যেন সবার কাছে তুলে ধরেন।
বিডি-প্রতিদিন/১২ জুলাই, ২০১৭/মাহবুব/ই জাহান