রংপুর বিভাগের বিভিন্ন স্থানে গত ১৩ দিনে ১৪ জন নারী ও পুরুষ ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলাতেই গণপিটুনির শিকার হয়েছেন ৮ জন নারী ও পুরুষ। গণপিটুনির শিকার অধিকাংশই মানসিক ভারসাম্যহীন ও অসহায় ব্যক্তি।
এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রংপুর রেঞ্জ পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন শোভাযাত্রা, লিফলেট বিতরণ গণসংযোগসহ বিভিন্ন ধরনের তৎপরতা চালানো হচ্ছে। ডিআইজি জনসাধারণকে অপরিচিত কাউকে সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশে খবর দেয়ার আহবান জানিয়েছেন।
পুলিশ, হাসপাতাল এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ জুলাই সোমবার রংপুর বিভাগের নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার কাশিয়াম বেলাপুকুর ইউনিয়নে খাদেমুল ইসলাম (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেন স্থানীয় জনতা। এর একদিন পর ১৭ জুলাই একই উপজেলার বাঙ্গালিপুর ইউনিয়নের চৌমুহুনী বাজারে রহমতুল্ল্যাহ (৫২) নামে এক বৃদ্ধব্যক্তিকে ছেলেধরা সন্দেহে মারপিট করে গুরুতর আহত করা হয়। পরের দিন ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার একই উপজেলার খাওমিধুপুর ইউনিয়নের মালিপাড়ায় সহিদুল ইসলাম (৫০) নামে এক বাকপ্রতিবন্ধীকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেন স্থানীয় জনতা।
এ ঘটনার দুইদিন পর ২১ শে জুলাই রবিবার রাতে একই উপজেলার কামার পুকুর আদানীর মোড় খিয়ার জুম্মা কাজীপাড়া পাড়া এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে নারীসহ ৪ জনকে গণপিটুনি দেয় এলাকাবাসী। এরা হলেন দিনাজপুরের আব্দুল মালেক, নীলফামারী সদরের হেলাল হোসেন, গাইবান্ধার মো. গফুর ও বরিশালের মেরিয়ান।
একই দিনে লালমনিরহাট সদরের খোচাবাড়ি মৌজার ডাইলপট্রি এলাকায় বাকপ্রতিবন্ধি নারীকে (৪৫) গণপিটুনি দেয়া হয়। ওই নারী কলাবাড়ি রেলওয়ে বস্তিতে বসবাস করতেন। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। একই দিনে সকালের দিকে আদিতমারী উপজেলার সাপ্টিবাড়ি বাজারে বস্তাসহ মানসিক ভারসাম্যহীন এক পুরুষকে (৩৫) ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেয় জনতা।
পরের দিন ২২ শে জুলাই সোমবার পঞ্চগড় সদর উপজেলার এলএসডির মোড় এলাকায় মানসিক ভারসাম্যহীন সাজেদুল ইসলাম (২৫) নামে এক যুবককে ঘোরাফেরা করতে দেখে এলাকাবাসী আটক করে মারপিট করে। পরে ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ওই যুবককে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। পরে আহত ওই যুবকের পরিচয় পাওয়া গেলে পুলিশ তার আত্মীয় স্বজনদের জিম্মায় দেন।
একই দিনে কুড়িগ্রামের উলিপুরে বুড়াবুড়ি ইউনিয়নে ছেলেধরা সন্দেহে বাবু (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি দেয় জনতা। ওই দিনে নীলফামারীর সৈয়দপুরের বোতলা গাড়ি ইউনিয়নের সোনাখুলি বক পাড়ায় শশুড় বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হন দুলাল মিয়া (৪০)। পরে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে এসে পরিবারের জিম্মায় দেন।
এদিকে, ২৪ শে জুলাই বুধবার ঠাঁকুরগাওয়ের পীরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের ইন্টারনেট ব্রডব্যান্ড সংযোগ প্রদানকাজে নিয়োজিত ইফনুস আলী হাওলাদার (২৪) নামে এক টেশনিশিয়ানকে ছেলেধরা সন্দেহে মারপিট করে এলাকাবাসী। পরে এই ঘটনায় ঠাঁকুরগাওয়ের হোসেন চাঁদপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামাল হোসেনকে আটক করে পুলিশ। একই দিনে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবককে (৩৮) আটক করে এলাকাবাসী। পরে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করায়।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন এর রংপুর মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু জানান, গুজব একটি মারাত্বক অপরাধ। গুজবে কান দেওয়া যাবে না। ছেলেধরা গুজবে যারা নিহত হয়েছেন যারা আহত হয়েছেন তাদের অধিকাংশই মানসিক ভারসম্যহীন। যেখানে এ ধরনের মানুষ সবার আনুকূল্য পায়, সেখানে তারা গণপিটুনির শিকার হন-বিষয়টি খুবই ভয়ংকর। এই জায়গা থেকে আমরা উত্তরণ করতে না পারলে বড় ধরনের সামাজিক বিপর্যয় হয়ে যাবে। পুলিশ ইতোমধ্যে বিভিন্ন ধরণের ইনিশিয়েটিভ নিয়েছে। তিনি বলেন, গণপিটুনির এসব ঘটনায় যাদের উস্কানী বা উদ্যোগ আছে তাদেরকেও খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
রংপুর রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজি দেবদাস ভট্রাচার্য জানান, পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজে মানুষের মাথা লাগবে এমন গুজবের ডালপালা মেলে শেষে গিযে ঠেকেছে ছেলেধরার হাতে। এতে সৃষ্টি হয়েছে অদ্ভত এক পরিস্থিতি। দেখা দিয়েছে ছেলেধরা আতংক। আতংকগ্রস্ত হয়ে সন্দেহের বশে ঘটছে গণপিটুনির ঘটনা। তিনি জনসাধারণের কাছে আহ্বান জানিয়ে বলেন, অপরিচিত এবং সন্দেহভাজন কেউ মনে হলে তাকে গণপিটুনি না দিয়ে আটক করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করুন। তা না হলে বড় ধরনের সামাজিক বিশৃংখলা তৈরি হবে।
ডিআইজি আরও বলেন, ছেলেধরা গুজব ঠেকাতে আমরা আট জেলা এবং রংপুর মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশের বিশেষ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। জনগনকে সচেতন করতে শোভাযাত্রা, লিফলেট বিতরণ, গণসংযোগ,উঠান বৈঠক করছি। বিভাগের প্রতিটি জেলা , থানা, ফাঁড়ির উদ্যোগে এসব করা হচ্ছে। সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগে মানুষ আশ্বস্ত হয়েছেন। একারণে গত ৪/৫ দিন থেকে এই বিভাগের কোথাও এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি। তিনি এ বিষযে গণমাধ্যমের আরও সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল