দেশে একদিকে মরণব্যাধী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলছে। অন্যদিকে ঢাকামুখী মানুষের যাত্রা যেন থামানো যাচ্ছে না। শনিবার থেকে পোশাক কারখানাসহ নানা কলকারখানা খুলে দেয়ায় ঢাকা ও গাজীপুরমুখী এখন জনস্রোত।
কেউ রিক্সা, অটোরিকশা বা সিএনজিতে রওনা দিয়েছেন। আবার কেউবা পায়ে হেঁটেই কর্মস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আর এমন চিত্র ঢাকামুখী মহাসড়কের। শুক্রবার দুপুরের পর থেকে মানুষের ঢল নামে মহাসড়কে।
এদিকে করোনাভাইরাসের হটস্পট হিসেবে পরিচিত গাজীপুর জেলাজুড়ে লকডাউন (অবরুদ্ধ) অবস্থা জারি করা হয়েছে আরও আগেই। জরুরি সেবা ও বিশেষ কিছু খাতের প্রতিষ্ঠান ছাড়া এখানকার সব বন্ধ আছে। বন্ধ গণপরিবহনও। করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে এভাবে সবকিছু বন্ধ থাকলেও শুক্রবারের চিত্রটা ছিল উল্টো। সামাজিক দূরত্ব বজায়ের সব নির্দেশনাকে পায়ে মাড়িয়ে গাজীপুর ও ঢাকা অভিমুখে এসেছেন হাজার হাজার শ্রমিক। বেশিরভাগ শ্রমিকই চাকরি বাঁচাতে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানান।
শুক্রবার মহাসড়কের এমসি বাজার, নয়নপুর, স্কয়ার মাস্টার বাড়ি, মাওনা চৌরাস্তা, ভবানীপুর, গড়গড়িয়া মাস্টার বাড়ি ও জৈনা বাজার এলাকায় কারখানামুখী শ্রমিকদের এ স্রোত দেখা যায়। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে রাস্তায় টহলরত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এ পরিস্থিতি সামাল দিতে যেন হিমশিম খাচ্ছিল।
করোনার বিস্তাররোধে সরকারি ছুটির সঙ্গে সঙ্গে গত ২৫ মার্চ থেকে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে শিল্পাঞ্চলখ্যাত গাজীপুর থেকে প্রথমবার কয়েক লাখ শ্রমিক তাদের গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান। কিন্তু এর কিছু দিনের মাথায় কারখানা খোলার খবরে ফের গাজীপুর অভিমুখে ছোটেন শ্রমিকরা। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় পায়ে হেঁটে, রিকশায়, খোলা ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে তুমুল ভোগান্তি সয়ে আসেন তারা। পরে কারখানা বন্ধের খবরে আবার সেই ভোগান্তি সয়েই অনেকে বাড়ি ফিরে যান। সবশেষ গত ২৫ এপ্রিলও শ্রমিকদের ঠিক একইরকম ভোগান্তি সয়ে গাজীপুরে ফিরতে দেখা যায়।
শুক্রবারও একইভাবে মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকায় কর্মস্থলমুখী শ্রমিকদের ঢল দেখা যায়। অনেককে দেখা যায় ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, প্রাইভেটকার, অটোরিকশা, ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল, সিএনজি ও ভ্যানগাড়িতে চড়ে ফিরতে। যদিও এজন্য কয়েকগুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে তাদের। অবশ্য কিছু কিছু স্থানে শ্রমিকদের আটকাতে তৎপর দেখা যায় পুলিশকে। খোলা ট্রাক ও পিকআপে করে যারা ফিরছিলেন তাদের বিভিন্ন চেক পয়েন্টে আটকেও দেয় পুলিশ। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয় নারী শ্রমিকদের। অনেকে কোন দিকে যাবেন, সেই দ্বিধায় ক্ষোভ-হতাশা প্রকাশ করেন সংবাদকর্মীদের সঙ্গে।
কারখানামুখী শ্রমিকদের ভাষ্যমতে, সামনে ঈদ। এখন চাকরিতে যোগদান না করলে বেতন পাওয়ার অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। পড়তে হবে ছাঁটাইয়ের আশঙ্কায়। করোনা সংক্রমণের দিন শেষ হয়ে গেলে কর্মসংস্থানের সংকটও তৈরি হতে পারে। সেজন্য এতো ঝুঁকি এতো ভোগান্তি সত্ত্বেও তারা ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন।
স্বামী-সন্তান নিয়ে কোনাবাড়ী এলাকায় ভাড়া থেকে একটি কারখানায় কাজ করেন আকলিমা আক্তার। করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুতে সন্তান-স্বামীসহ বাড়িতে গিয়েছিলেন। এবার সন্তানকে শাশুড়ির কাছে রেখে স্বামীকে নিয়ে এসেছেন। পথিমধ্যে দুর্ভোগ-ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে তাকে। কারখানা খোলার খবরে কিছুপথ হেঁটে, কিছু পথ রিকশাযোগে অতিরিক্ত ভাড়ায় এসেছেন। সামনে ঈদ, এখন কাজে যোগ না দিলে বেতন দেবে না কর্তৃপক্ষ। তাই কষ্টের মধ্যেও কারখানায় যোগ দিতে ফিরছেন তিনি।
এ বিষয়ে কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতরের গাজীপুরের উপ-মহাপরিদর্শক ইউসুফ আলী জানান, গাজীপুরে নিবন্ধিত ছোট-বড়-মাঝারি কারখানা রয়েছে চার হাজার ৭৬৫টি। করোনাকালের আগে চালু ছিল দুই হাজার ৩৬৮টি। এর মধ্যে বিজিএমইএ-বিকেএমইএ’র নিয়ন্ত্রণাধীন কারখানা ৮৬২টি। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন কয়েক লাখ শ্রমিক। গত ২৬ এপ্রিল কিছু কারখানা খোলা হলেও শনিবার থেকে বাকি কারখানগুলো চালু করার কথা রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় দুর্ভোগ নিয়েই শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে ফিরতে হচ্ছে।
গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গাজীপুরে লকডাউন চলছে। বিভিন্ন দিক বিবেচনায় এরই মধ্যে জেলার শিল্প-কারখানাগুলো আগামীকাল (শনিবার) খোলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। কারখানাগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা মানা হচ্ছে কি-না তার প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হবে।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল