বাংলাদেশে ভ্যাট ব্যবস্থার প্রবর্তন, তৈরি পোশাক খাতে ব্যাক টু ব্যাক এলসি, বন্ডেড ওয়ারহাউজ সুবিধা চালুসহ অর্থনীতিতে ব্যক্তি খাতের বিকাশ ও নীতি প্রণয়নে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে প্রয়াত অর্থ, পরিকল্পনা ও বাণিজ্যমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানকে মরণোত্তর সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার রাতে রাজধানীর রেডিসন ব্লু হোটেলে অনুষ্ঠিত বণিক বার্তা ও বিআইডিএসের যৌথ উদ্যোগ ‘গুণীজন সংবর্ধনা’ দেওয়া হয়।
প্রয়াত সাইফুর রহমানের পক্ষে সংবর্ধনা গ্রহণ করেন তার তিন দৌহিত্র নাবিল ইলহান রহমান, এম সাফির রহমান ও এএম বাশির রহমান। সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। বণিক বার্তা ও বিআইডিএসের আয়োজনে এটি সপ্তম ‘গুণীজন সংবর্ধনা’।
অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, গভর্নর থাকাকালে আমি তিনজন অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সাইফুর রহমান সাহেব বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাপারে কখনোই কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করেননি। তার মতো রাজনীতিবিদ ও নীতি নির্ধারক পাওয়া কঠিন।
তিনি বলেন, কর্মজীবনে সাইফুর রহমানের সঙ্গ সব সময় উপভোগ্য ছিল। তিনি ছিলেন এমন একজন বস, যার কাছে যেতে কোনো দ্বিধা সংকোচ কাজ করত না। তিনি সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে তারপর সিদ্ধান্ত দিতেন। ব্যক্তি হিসেবে, রাজনীতিবিদ হিসেবে তথা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তিনি ছিলেন একজন সুন্দরতম মানুষ।
উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, স্বৈরাচার ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার আগে রিজার্ভ খালি করে দিয়ে যায়। এখনো এ পরিস্থিতি দেখছেন। ১৯৯০ সালেও স্বৈরাচার চলে যাওয়ার আগে সবকিছু খালি করে গিয়েছিল। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী হলেন সাইফুর রহমান। তখন রিজার্ভ সংকটে সহায়তা দেওয়ার জন্য আইএমএফের সঙ্গে ইএসএএফ নিয়ে আলাপ হচ্ছিল।
তিনি বলেন, তখন আইএমএফ কর ও রাজস্বের অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ করে বাড়াতে বলা হয়েছিল। একইসঙ্গে বিশ্বব্যাংক থেকে বলা হয় কাস্টম ডিউটি ৭৫ শতাংশ করতে। তখন আমি তিন দিন লাগিয়ে একটা ফিসক্যাল মডেল দাঁড় করিয়ে দেখলাম, বিষয় দুটি সাংঘর্ষিক। কিন্তু সাইফুর রহমানকে আমরা কিছু জানানোর আগেই তিনি বলে দিলেন, এটা করা যাবে না। এমন তীক্ষ্ণ ও অবিশ্বাস্য দিক ছিল তার।
বাণিজ্য এবং বস্ত্র ও পাট উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। কিন্তু সাইফুর রহমান বাংলাদেশের ফিসক্যাল পলিসি, মনিটারি পলিসিসহ বিভিন্ন খাতে যেসব মৌলিক সংস্কার করেছেন, তার ফলে দুর্বৃত্তায়নের মধ্যেও আমরা একেবারে অন্ধকারে নিপোতিত হইনি। যা হওয়ার ব্যাপক সুযোগ ও সম্ভাবনা ছিল। সাইফুর রহমানের মৌলিক ভিত্তিগুলোর কারণে অর্থনীতিকে আমরা দুর্বৃত্তায়নের মধ্যেও বেশ কিছু দূর টেনে নিয়ে যেতে পেরেছি। তারপরে ধস নেমেছে। ধসে যাওয়া অর্থনীতি এখন পুনর্নির্মাণের সময় এসেছে। আমরা আশ্বস্ত করতে চাই যে, আমাদের অর্থনীতি পুনর্নির্মিত হবে, আমাদের সম্পদের সুষম বণ্টন হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, অর্থনীতির স্বাভাবিক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একজন চ্যাম্পিয়নের দরকার হয়। সাইফুর রহমান ছিলেন তেমন একজন চ্যাম্পিয়ন। বাজার ব্যবস্থাপনা, বেসরকারি খাত, রপ্তানি খাত, সংরক্ষণ নীতির চ্যাম্পিয়ন তিনি। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন মুক্তবাজার অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয়েছিল সাইফুর রহমানের মাধ্যমে। সাধারণ মানুষের স্বার্থও দেখতেন তিনি। অনেক সময় ব্যবসায়ীরা উনার সিদ্ধান্তে হতাশ হতেন, অভিযোগ করতেন। কিন্তু তিনি দেশের স্বার্থ সবার আগে দেখতেন। বৈদেশিক ঋণের ওপর তিনি খুব বেশি নির্ভরতা চাননি।
প্রসঙ্গত, এম সাইফুর রহমান ১৯৭৬-১৯৮০ পর্যন্ত বাণিজ্যমন্ত্রী, ১৯৮০-১৯৮২ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী, ১৯৯১-১৯৯৬ পর্যন্ত টেকনোক্র্যাট অর্থমন্ত্রী এবং ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন সাবেক অর্থসচিব ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জাকির আহমেদ খান, বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, বিআইডিএসের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ড. কাজী ইকবাল প্রমুখ।
বিডি প্রতিদিন/কেএ