মামলা বানোয়াট, অভিযোগ অসত্য, শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড’- বাংলাদেশের মামলা বাণিজ্যের পরিস্থিতি এখন এ রকমই। ভুয়া মামলায় ধ্বংস হচ্ছে অর্থনীতি। থেমে গেছে সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। বিচারের আগেই দেশের অর্থনীতিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এখন ফাঁসির দড়িতে ঝোলানোর অপেক্ষা। জুলাই বিপ্লবের পর প্রায় ১৪ হাজার বিভিন্ন রকম মামলা হয়। এর মধ্যে ১২ হাজারের বেশি হত্যা মামলা, হত্যাচেষ্টা মামলা, নানা রকম মনগড়া, মিথ্যা মামলার এক হিমালয় পর্বত সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের থানাগুলোতে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে যে, এই মামলাগুলো মিথ্যা, ভিত্তিহীন এবং এ সমস্ত মামলা আদালতে টিকবে না। সরকারের কেউ কেউ এটাও বলছে, এর ফলে প্রকৃত অপরাধীদের বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। শুধু সরকার নয়, আইনজ্ঞরাও এ ধরনের মামলাগুলোর ব্যাপারে তীব্র সমালোচনা করেছেন। ড. সারা হোসেন একাধিকবার বলেছেন, ‘এই সমস্ত মামলা করে আসল মামলাগুলোকে গুরুত্বহীন করা হচ্ছে।’ অ্যাডভোকেট শাহদীন মালিক বলেছেন, ‘এই সমস্ত ভিত্তিহীন মামলা জুলাই বিপ্লবের চেতনাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। মামলা বাণিজ্যের উৎসব চলছে দেশ জুড়ে।
সরকারের পক্ষ থেকে আইন উপদেষ্টা বলেছেন, ‘মামলা হলেই কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না।’ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, ‘এ ধরনের মামলাকে আমরা নিরুৎসাহিত করি।’ কিন্তু এসব মামলায় হয়রানি, সম্মানহানি চলছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। সরকারের কাজ শুধু কথা বলার নয়, কাজ করা। কিন্তু স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বা আইন উপদেষ্টা শুধু কথাই বলেছেন, ভুয়া মিথ্যা মামলা বন্ধে তারা কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেননি। একটি মামলাও আজ পর্যন্ত প্রত্যাহার করা হয়নি। প্রায় ১৪ হাজার মামলার একটিরও কোনো তদন্ত হয়নি। এসব ভুয়া মামলার আসামি দেড় লক্ষাধিক মানুষ। ব্যবসায়ী, আমলা, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ, বিচারক, চিকিৎসক, সাংবাদিক- কে নয় মামলার আসামি?
মামলার আসামি তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রায় ৩৫ হাজার ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী, বড় শিল্প উদ্যোক্তা থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এখান থেকেই মামলা করার আসল উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে যায়। ব্যবসায়ীদেরকে মিথ্যা মামলার জন্য মামলার টার্গেট করা হচ্ছে, তার প্রধান কারণ হলো চাঁদাবাজি। যারা মামলা করেছেন তারা এই সমস্ত মামলা করার আগে পরে ব্যবসায়ীদের নানা রকমভাবে হুমকি দিচ্ছেন। তাদের কাছে চাঁদা চাইছেন। যখন ব্যবসায়ীরা চাঁদা দিতে অস্বীকার করছেন তখন মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। আর এই সমস্ত মিথ্যা মামলা নিয়ে পুলিশও চাঁদাবাজির মহোৎসবে নেমেছে। মনোবল ভেঙে পড়া পুলিশ হতোদ্যম। কিন্তু এদের মধ্যেই কেউ কেউ এই সুযোগে কিছু পয়সাকড়ি হাতিয়ে নেওয়ায় গভীর মনোযোগী। যার ফলে বাংলাদেশে মামলা এখন একমাত্র রমরমা ব্যবসা। অন্য ব্যবসা থাকুক না থাকুক, মামলা এবং তদবিরের ব্যবসা এখন জমজমাট। এই সমস্ত মামলার সঙ্গে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে আছে মব সন্ত্রাস। বিভিন্ন শিল্প কলকারখানায় হামলা করা হচ্ছে। কলকারখানা জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ব্যবসা পরিবেশ পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছে। এ সমস্ত মামলায় যাদেরকে আসামি করা হয়েছে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, আতঙ্কে ভুগছেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তাদেরকে মিডিয়া ট্রায়ালের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে গুজব ছড়ানোর প্রতিযোগিতা। ফলাও করে হত্যা মামলার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি বা সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির নাম প্রকাশ করা হচ্ছে। বিচারের আগেই তিনি দণ্ডিত। শুধু তাই নয়, এই মিথ্যা মামলার কারণে তার স্বাভাবিক কর্মজীবনে প্রভাব পড়ছে। হাত-পা গুটিয়ে তিনি আতঙ্কের দিন কাটাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে মনগড়া নানা রকম সত্য-মিথ্যা খবর প্রকাশ হচ্ছে এক শ্রেণির পত্রিকায়। একজন বড়, মাঝারি বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ব্যবসা বন্ধ করলে তার যতটুকু ক্ষতি হয়, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় দেশের।
বাংলাদেশের অর্থনীতি পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল বেসরকারি খাতের ওপর। এ ধরনের মামলাগুলো বেসরকারি খাতকে রীতিমতো জেলবন্দি করেছে। ফাঁসির আসামিকে যেমন ‘কনডেম সেলে’ রাখা হয়, ভুয়া মামলায় অর্থনীতির চালিকা শক্তি বেসরকারি খাতকে বন্দি করে রাখা হয়েছে ‘কনডেম সেলে’। সরকারের করণীয় কী? সরকারের পক্ষ থেকে শুধুমাত্র আমাদের কোনো দায় নেই, আমরা মামলা করছি না, এই সমস্ত মামলা মিথ্যা- এটা বললে হবে না। মিথ্যা মামলার দ্রুত তদন্ত করে এসব মামলা থেকে মুক্তি দিতে হবে নিরীহ মানুষকে। অনেক নিরীহ ব্যক্তি এসব মামলায় অভিযুক্ত হয়ে মাসের পর মাস কারাগারে। নয় মাসে একটি মামলারও তদন্ত শেষ হয় না- এটা কি সম্ভব? নাকি সরকার এই মামলাগুলোকে হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে জিইয়ে রাখছে?
এই সেদিন দেখলাম যে, একজন চিত্রনায়িকাকে বিমানবন্দর থেকে আটক করা হলো। তার বিরুদ্ধে হত্যা চেষ্টার মামলা আছে এই অভিযোগ। এমন একটা মামলা তার বিরুদ্ধে করা হয়েছে যে মামলার সময় তিনি দেশে ছিলেন না। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগ, ইন্টারনেটের যুগ। একজন ব্যক্তির অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মুহূর্তের মধ্যে পাওয়া যায়। তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা বা যারা তাকে গ্রেপ্তার করেছে তারা যদি ওই অভিনয়শিল্পীর ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গতিবিধিগুলো লক্ষ্য করতেন, তাহলে দেখতেন যে, ওই সময় তিনি কোথায় ছিলেন, কী অবস্থায় ছিলেন। তার ভিত্তিতে মামলাটি খারিজ করে দেওয়া যেত। কিন্তু তা করা হলো না, বরং তাকে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এই নিয়ে যখন সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড়, তখন সরকার আরেকটি ভুল করল। নিম্ন আদালতে তার জামিনের আবেদন বাতিল করে দিয়ে তাকে জেলে পাঠালেন। আদালতে বিচারক বললেন, ২২ মে এটি পূর্ণাঙ্গ শুনানি হবে। কিন্তু ২২ মের আগেই ২০ মে জামিন হয়ে গেল ঐ শোবিজ তারকার। পুরো প্রক্রিয়াটি থেকে একটি সত্য বেরিয়ে এলো তা হলো আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। সরকার যেভাবে চাচ্ছে সেভাবেই চলছে সব কিছু। অর্থাৎ সরকার চাইলে একজন ব্যক্তিকে ভুয়া মামলায় গ্রেপ্তার করতে পারে। আবার সরকার চাইলে আইনগত প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়েও তাকে জেল থেকে বেরিয়ে আনা যায়। যেমন কদিন আগে হত্যা মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল মাত্র ১০ দিনে। এ যেন এখন সব সম্ভবের দেশ!
আইনগত প্রক্রিয়ার বাইরে অপরাধীকে থানা থেকে বের করে আনার ঘটনাও ঘটেছে। কদিন আগে ধানমন্ডিতে একজন ব্যবসায়ীর বাসা ঘেরাও করল কিছু মব সন্ত্রাসী। প্রকাশনা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ওই ব্যক্তির কাছে তারা চাঁদা চেয়েছিল। কিন্তু ওই ব্যক্তি যখন চাঁদা দিতে অস্বীকার করে তখন কয়েকজন তরুণ বাড়ি ঘেরাও করে। বাড়ির মালিক তখন দ্রুত ৯৯৯ নাইনে ফোন করেন। ৯৯৯ থেকে পুলিশ আসে। পুলিশ সাহসী ভূমিকা নেয়। একপর্যায়ে তারা এই সমস্ত মব সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় ধানমন্ডি থানায়। পুলিশ চাইলে যে সাহসের সাথে মব সন্ত্রাস মোকাবিলা করতে পারে এটি তার একটি প্রমাণ। কিন্তু সেই সাহস দেখিয়ে পুলিশের কী লাভ? পরদিনই এনসিপির একজন নেতা সেখানে চলে আসেন এবং তিনি আসামিদেরকে ছাড়িয়ে নেন। তাহলে আইন কার? বিচার কার? ক্ষমতা যার, পেশি শক্তি যায় তার?
একজন পুলিশ যখন একজন আসামিকে সুনির্দিষ্ট অপরাধে গ্রেপ্তার করে, তখন আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কি তাকে ছাড়িয়ে নেওয়া যায়? কিন্তু সেটি হচ্ছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ চরম আস্থাহীনতায় ভুগছে, চরম উদ্বেগে ভুগছে। এই ব্যবসায়ী কী আর ব্যবসা করবেন? এই ব্যবসায়ীর অবস্থা থেকে অন্য ব্যবসায়ীরা কী করবেন?
আমাদেরকে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতির একটি দেশ। এখানে অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য বেসরকারি খাতকে প্রণোদনা দিতে হয়, তাদেরকে বিকশিত করতে হয়। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ১০ মাস হতে চলল। এই ১০ মাসে কয়বার ব্যবসায়ীদের সাথে অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রধান বৈঠক করেছেন? ব্যবসায়ীদের মতামত সম্পর্কে তারা কী জেনেছেন? একের পর এক ব্যবসার ওপর আঘাত আসছে। সর্বশেষ ভারত স্থলবন্দর দিয়ে বেশ কিছু পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। এর ভয়ংকর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। এই বিরূপ প্রতিক্রিয়া মেটানোর জন্য অবিলম্বে সরকারের উচিত ছিল ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করা। কিন্তু কোথায় কী, ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক না করে তাদের প্রতিনিয়ত হয়রানি করা হচ্ছে। ব্যবসা বন্ধ করে দেশের অর্থনীতিকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আয়োজন চলছে। সরকার কিছু সুশীল বুদ্ধিজীবীদের সাথে আলাপ করে অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান চাইছেন। ব্যবসায়ীরা মাঠে কাজ করতে গিয়ে তাদের সমস্যাগুলো অনুধাবন করেন। তারা জানেন যে বাস্তবতা কী? কিন্তু একজন সুশীল তিনি পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সমাধান খোঁজেন। সুশীলদের বইয়ের সমাধান দিয়ে আর যাই হোক, এরকম চলমান অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান হবে না।
ট্রাম্প যে নতুন শুল্কহার বসিয়েছিলেন, তা তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এখন পরবর্তীতে কী হবে তা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। বিশ্বের অনেক দেশ এখন বাংলাদেশকে ভিসা দিচ্ছে না। সেটা নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা কী? এই সব কিছু নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা চলছে। আর এই উৎকণ্ঠা যদি দূর না হয় তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না কখনোই। একজন ব্যক্তি যদি অপরাধ করে সেই ব্যক্তির অপরাধের ব্যাপারে তদন্ত করতে হবে, বিচার করতে হবে। বিচারের পর তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু এখন বিচার, তদন্তের আগেই শাস্তি কার্যকর করা হচ্ছে। এটি একটি ভয়ংকর প্রবণতা। এই প্রবণতা দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। অবিলম্বে যদি এই মিথ্যা মামলা, হয়রানি মূলক মামলা প্রত্যাহার না করা হয় তাহলে অর্থনীতির ফাঁসি কার্যকর হবে অচিরেই।