১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১৪:১২

অমিত গোস্বামীর ‘আন্দামানের আদিবাসী’ এক পুনরাবৃত্ত মোটিফ

ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন

অমিত গোস্বামীর ‘আন্দামানের আদিবাসী’ এক পুনরাবৃত্ত মোটিফ

আমাদের সাংস্কৃতিক অ্যাজেন্ডায় বিজ্ঞান নেই। যদিও ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির পাঠক্রমে ভর্তি করানোর জন্য বাপ-মায়ের তাগিদ দেখলে উল্টোটাই মনে আসতে বাধ্য। ব্ল্যাকবোর্ডের বাইরে বিজ্ঞান প্রায় অস্তিত্বহীন। গল্পের বইয়ের মতো করে কোনও বিজ্ঞানগ্রন্থ কবে শেষ পড়েছেন, এই প্রশ্নের মুখে গরিষ্ঠ সাধারণ শূন্য দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকবেন। 

সমস্যা হল, এটা যে একটা সমস্যা, সেই বোধ তৈরি হয়নি আমাদের ভেতর। বিজ্ঞানের কোনও ভাল বই পড়ার রোমাঞ্চ যে কখনও কখনও উচ্চ মানের থ্রিলারকেও পিছনে ফেলে দিতে পারে, অনুভবে ভেজা প্রেমকাহিনিকে করে তুলতে পারে জোলো অথবা তাতে থাকতে পারে কোনও ট্র্যাজিক কাহিনির তুল্য সক্ষম সূক্ষ্ম শূল, সে কথা পাঠক বড় একটা বোঝে না। তাই অমিত গোস্বামীর লেখা অন্বেষা প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত নৃতাত্ত্বিক আঙ্গিকে লেখা 'আন্দামানের আদিবাসী' পড়ার পরে বুঝলাম যে এই বইটি পাঠের অর্থ হল আন্দাজ কয়েকশো বিজ্ঞানগ্রন্থের নির্যাসে ঋদ্ধ হওয়া। 

আন্দামানে ৬০০০০ বছর আগে সম্ভবত ইথিওপিয়া থেকে আগত কয়েকটি জনজাতি ঘাঁটি গাড়ে। বহির্বিশ্বের সাথে তারা সম্পর্ক রাখতে চায় নি। তাদের অস্তিত্বের কথা আগে জানা গেলেও ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের সাথে এরা সংঘাতে জড়িয়ে যায় কারণ ব্রিটিশরা এদের মাতৃভূমি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে তাদের উপনিবেশ সৃষ্টিতে উদ্যোগী হয়। ব্রিটিশ ও স্বাধীনতা উত্তর ভারতীয়দের সাথে তাদের সম্পর্ক কখনই খুব সুখের ছিল না। শাসক চেয়েছিল তাদের কবজা করতে। সরকারের ওপর নির্ভরশীল করে তাদের বিষদাঁত ভেঙে দিতে। কিন্তু চারটি জনজাতিকে বশ করলেও দুটির ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। বাকি দুই জনজাতির মধ্যে জারোয়ারা তবু বহির্বিশ্বের বন্ধুত্ব স্বীকার করলেও কোনভাবে বশ হয় নি। আর সেন্টিনেলিরা এখনও পুরোন প্রস্তর যুগের বাসিন্দা। তারা বহির্বিশ্বের সাথে কোন যোগাযোগ রাখেনি। এহেন দ্বীপের বিভিন্ন অভিযান ও তাদের সমাজের বিভিন্ন গল্প উঠে এসেছে এই বইয়ে। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জেনেছি, বইয়ে লেখা ঘটনাগুলি পূর্বে অপ্রকাশিত। অ্যানথ্রপলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মহাফেজখানায় রক্ষিত কিছু রিপোর্ট ও বেশিটা নিজ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা বইটি নৃতত্ত্বের এক অনন্য নজির হয়ে থাকবে। 

অমিত গোস্বামী বুভুক্ষু পাঠক। এমন সব প্রশ্নে তিনি রোমাঞ্চিত হন এবং তাঁর কলমের মাধ্যমে সে রোমাঞ্চকে করে তুলতে পারেন সংক্রামক, যেগুলোর সামনে দাঁড়ালে প্রকৃতিতে মানুষের নিজস্ব প্রেক্ষিতটি নতুন আলোয় চিহ্নিত হয়। একই সঙ্গে দু’রকম উপলব্ধি আমাদের চেতনা অধিকার করে। এক, আমরা বুঝি, এই মহাবিশ্বের বিশালতার পাশে মানবজীবন এক নগণ্য অস্তিত্ব। ধুলোকণার অহংকারও তার সাজে না। অপর দিকে পাই এই বিশ্বাস যে, মানুষ তার মস্তিষ্কে ধারণ করেছে এই বিশালকেও। বিরাটকে যে ভাবনায় বন্দি করেছে তার তো কোনও ক্ষুদ্রতা সাজে না! হয়তো অতি রোমান্টিক ভাবনা।  কিন্তু অমিত গোস্বামীর বইটি জুড়ে তারই আবাহন ও সেলিব্রেশন। তাঁর লেখা পড়তে শুরু করার কিছুক্ষণের ভেতর কয়েকটা বৈশিষ্ট্য নজর না টেনে পারে না। 

এক, এর অনবদ্য সাহিত্যগুণ। কিছুটা এগোতে বোঝা যায় ছোটগল্প নয়, এতে রয়েছে উপন্যাসের চলন। তাঁর বাক্য এগোয় সরল দৃঢ়তায়। বাক্য কাটেন এমন ভাবে, যেন তুষারগাত্রে কোনও পর্বতারোহী একটু থেমে পিটন পুঁতছেন। এই ভঙ্গির একটা শ্লথ অথচ অমোঘ প্রভাব আছে। প্রতীক্ষা পাঠককে জারিত করতে থাকে। এ থেকে প্রশ্রয় পায় লেখার আর-এক বৈশিষ্ট্য। রচনাগুলো, এগুলোর নাতিক্ষুদ্র অংশ অন্তত, কোনও ধরাবাঁধা ভাবনারেখা অনুসরণ করে না। একটা মূল থিমের সঙ্গে পুষ্ট কিংবা ক্ষীণ সূত্রে যুক্ত থেকে নানা দিকে বিচরণ করতে থাকে। এতে আমাদের কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়, কারণ আমরা কোনও নির্দিষ্ট জ্ঞানার্জনের লোভে বইটি খুলিনি, আমরা শেষ অবধি উপভোগ করতে থাকি অজস্র আইডিয়ার স্ন্যাপশট ও ঘটনাচূর্ণ, যা ক্রমাগত আমাদের খিদে বাড়াতে থাকে এবং আমরা অনুভব করি বিজ্ঞানক্ষেত্রের সজীব স্পন্দন । আর আদিম জনজাতি যে এই বইয়ের এক পুনরাবৃত্ত মোটিফ সেটাও আমাদের নজর এড়ায় না। 

বইয়ের নামঃ  আন্দামানের আদিবাসী
লেখকঃ অমিত গোস্বামী 
প্রকাশকঃ অন্বেষা প্রকাশ (প্যাভিলিয়ন ১২)

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

সর্বশেষ খবর