৩১ মার্চ, ২০১৬ ১১:৫৮
স্বাধীনতা দিবসের সমাবেশে

ফিলাডেলফিয়ায় মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন বন্ধুদের সম্মাননা

নিউইয়র্ক থেকে এনআরবি নিউজ:

ফিলাডেলফিয়ায় মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন বন্ধুদের সম্মাননা

ড. নীনা আহমেদ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে অসাধারণ ভূমিকা পালনকারী ৭ জন আমেরিকানকে সম্মাননা জ্ঞাপনের পাশাপাশি মার্কিনিদের সামনে হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে ফিলাফেলফিয়ায় বাংলাদেশের ৪৬তম স্বাধীনতা দিবস পালিত হলো। একইসাথে মূলধারায় অত্যন্ত জোরালোভাবে প্রবাসী বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এশিয়া বিষয়ক উপদেষ্টা ড. নীনা আহমেদকেও ক্রেস্ট প্রদান করা হলো।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং সংবিধান স্বাক্ষরের স্মৃতিবাহী ফিলাডেলফিয়া সিটির মেয়র জেমস কেইনিকেও বিশেষভাবে সম্মান জানানো হলো একই অনুষ্ঠান থেকে। এ অঞ্চলের বাংলাদেশিদের আরও জোরালোভাবে সিটি ও রাজ্য প্রশাসনের সাথে জড়িত করার অভিপ্রায়ে ফিলাডেলফিয়া সিটির ডেপুটি মেয়র হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে ড. নীনা আহমেদকে। অর্থাৎ একইসাথে তিনি দুটি দায়িত্বে থেকে বাংলাদেশি তথা এমিয়ান-আমেরিকানদের সর্বাত্মক সহায়তায় নিরলসভাবে কাজ করছেন। 

‘বাংলাদেশি-আমেরিকান কমিউনিটি ফোরাম’ নামক একটি সংগঠনের ব্যানারে গত ২৬ মার্চ পেনসিলভেনিয়া রাজ্যের ফিলাডেলফিয়া সিটির কুর্টজ সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্টস এর থিয়েটার হলে ব্যতিক্রমী আমেজে এ অনুষ্ঠান হয়। বিভিন্ন ভাষা ও বর্ণের শত শত আমেরিকানের উপস্থিতিতে এবং উৎসবমুখর পরিবেশে হাজার বছরের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতি, মাতৃভাষার অধিকারের আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি  বিবৃত করেন ফিলাডেলফিয়া সিটির ডেপুটি মেয়র ড. নীনা আহমেদ। 

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ড. নীনা। ‘বাংলাদেশের বাঙালিরা এখন এই মার্কিন মুল্লুকেও অত্যন্ত সাফল্য প্রদর্শন করে চলেছেন এবং একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক অগ্রগতিতেও তারা অবদান রাখছেন’ বলেন ড. নীনা। তিনি বলেন, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন।’ 

এ অনুষ্ঠানের সাথে সাধারণ আমেরিকানদের সম্পৃক্ততার গভীরতা অনুধাবন করা যায় একাত্তরে পাক হায়েনাদের জন্যে নিক্সন প্রশাসনের দেয়া অস্ত্র ভর্তি জাহাজ অবরোধকারীদের কয়েকজনের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতার পক্ষে মার্কিনীদের অভূতপূর্ব সমর্থনের ঘটনাকে চলচ্চিত্রে রূপদানকারী (ব্লকেড) আরিফ ইউসুফ এবং তাসবির ইমামও ছিলেন অনুষ্ঠানে।  বাল্টিমোর, ফিলাডেলফিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে অবরোধ রচনার অবিস্মরণীয় সে ঘটনা এখন বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম একটি অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। 

এ অনুষ্ঠান শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। আয়োজকদের পক্ষে বিশিষ্ট সমাজকর্মী এবং শহীদ পরিবারের সন্তান ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ তার স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট উপস্থাপন করেন। তারপর প্রজন্মের শিল্পী সাইমুন আলম তাসীর উদাত্ত কণ্ঠে আমেরিকা  এবং বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাগানিয়া সঙ্গীত পরবেশিত হয়।

ডেপুটি মেয়র ড. নিনা আহমেদ মুক্তিযুদ্ধে পাক হায়েনাদের গণহত্যা এবং বিভীষিকার কথা স্মরণ করিয়ে স্বাধীনতার মূল্যকে ধারণ করার আহ্বান জানান।   

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ফিলাডেলফিয়া সিটির মেয়র জেমস কেইনি। বাংলাদেশিদের কোন অনুষ্ঠানে সিটি মেয়রের অংশগ্রহণের ঘটনা এটিই প্রথম। ইস্টারের ছুটি সত্ত্বেও তিনি স্বাধীনতা দিবসের এ অনুষ্ঠানে এসে বাংলাদেশি-আমেরিকানদের ইতিহাসের এই অসাধারণ অধ্যায়ের কথা জেনে অভভিূত হন। তার বক্তব্যে নির্বাচনী ময়দানে কোন কোন প্রার্থী কর্তৃক মুসলিম  বিদ্বেষী মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেন। সিটি মেয়র তার নিজের আইরিশ ও অন্যান্য জাতির উপর আমেরিকার ইতিহাসের কলঙ্কজনক অতীত বৈষম্যের পুনরাবৃত্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার আহ্বান জানান। তিনি  ফিলাডেলফিয়ার বাংলাদেশি-আমেরিকান সম্প্রদায়কে তার নির্বাচনের সময় সমর্থন ও  প্রচার অভিযানে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। এছাড়াও   বাংলাদেশি-আমেরিকান সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করে ফিলাডেলফিয়াকে একটি স্বাগতপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী শহরে পরিণত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন সিটি মেয়র। তিনি ২৬  মার্চকে ফিলাডেলফিয়া সিটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ‘ঘোষণা পত্র’ হস্তান্তর করেন।        

এ সময় বিপুল করতালির মধ্যে নর্থ ইস্ট  ফিলাডেলফিয়া বাংলাদেশ কম্যুনিটি, ওয়েস্ট  ফিলাডেলফিয়া বাংলাদেশ কম্যুনিটি , আপার ডার্বি ও মেলবর্ন বাংলাদেশ কম্যুনিটি, সাউথ জার্সি বাংলাদেশ কম্যুনিটি, লেন্সডেল ও  হেট্ ফিল্ড বাংলাদেশ কম্যুনিটি, বায়তুল মুকাররম মসজিদ ও বাংলাদেশি আমেরিকান কমিউনিটি ফোরামের পক্ষ থেকে মেয়র জেমস কেইনি ও  ডেপুটি মেয়র ড. নীনা আহমদকে সম্মাননা ক্রেস্টসহ উপহার প্রদান করা হয়।  এ পর্বের সমন্বয় করেন কম্যুনিটি লিডার ড. ফারুক সিদ্দিকী ও ডা. ইবরুল হাসান চৌধুরী। 

এরপর  বহুল আকাঙ্ক্ষিত তথ্যচিত্র ‘ব্লকেড’  প্রদর্শন করা হয়। বাংলাদেশীসহ ভিনদেশীরা মন্ত্রমুগ্ধের মত আবেগ তাড়িত হয়ে  তা উপভোগ করেন। এ পর্বের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কারণ একাত্তরে পাকিস্তানীদের জন্যে মার্কিন অস্ত্রভর্তি জাহাজ ‘পদ্মা’কে যারা অবরোধ করেছিলেন তার মধ্যে ৭ জন ছিলেন অনুষ্ঠানে। এরা হলেন রিচার্ড টেইলার এবং তার স্ত্রী ফিলিস টেইলার, সেলি উইলোবি, ড. ক্লাউস কিপিনদ্রফ, বাংলাদেশী ড. মোনায়েম চৌধুরী এবং আরো দুই আমেরিকান। অবরোধে নেতৃত্ব প্রদানকারি রিচার্ড টেইলার অসুস্থ থাকা সত্তে¦ও অন্যের কাধে ভর করে অনুষ্ঠানে আসেন। ছবিটি প্রদর্শনের পর তারা তাদের তখনকার ৭ মাস নিক্সন সরকার বিরোধী আন্দোলন ও জাহাজ ঠেকানোর অনুভূতির কথা ব্যক্ত করতে যেয়ে বলেন যে, সেই সময় তারা জীবনের ঝুঁকিকেও মেনে নিয়েছিলেন। তারা উপস্থিত  অনেকের প্রশ্নের জবাব প্রদান করেন। অয়োজকদের পক্ষ থেকে তাদের সম্মাননা উপহার প্রদান করা হয়। ওই তথ্যচিত্রের নির্মাতা আরিফ ইউসুফ তার বক্তব্যে এই ছবি তৈরীর অনুপ্রেরণা ও দীর্ঘ  প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেন  এবং এই ঐতিহ্যবাহী ছবি আমেরিকার বিভিন্ন শহরে দেখাবার জন্য সহযোগিতা কামনা করেন। 

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমেরিকানদের অকুণ্ঠ সমর্থনের ধারাবিবরণী সংবলিত এ অনুষ্ঠান আয়োজনে নিরলসভাবে শ্রম প্রদানকারীদের মধ্যে ছিলেন ওয়েস্ট ফিলাডেলফিয়ার সমাজকর্মী ও শিক্ষানুরাগী কামরুল ইসলাম এবং তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস, মীর হোসেন, শহীদুল ইসলাম, আনাম চৌধুরী, আজিজ উদ্দিন তারেক, মোহাম্মদ হারিস, আবুল কাশেম;  নর্থ ইস্ট  ফিলাডেলফিয়ার  আওতাদ চৌধুরী , কামরুজ্জামান,  মাশুকুল ইসলাম খান, জাকারিয়া চৌধুরী, আবুল হাসেম বুলবুল; আপার ডার্বি ও মেলবর্ন বাংলাদেশ কমুনিটির  মহম্মদ মইনুদ্দিন আবুল ফজল, কাজী সাখাওয়াত হোসাইন;  সাউথ জার্সি বাংলাদেশ কমুনিটির সালাহউদ্দিন ও রাজিয়া আহমেদ; লেন্সডেল ও  হেট্ ফিল্ড বাংলাদেশ কমুনিটির মফিজ উল ইসলাম ও  অমি ইসলাম; ডেলওয়ার ভ্যালী বাংলাদেশ কমুনিটর ডা. ফাতেমা আহমেদ, শেলী রহমান ও ফারহানা আফরোজ প্রমুখ।

 


বিডি-প্রতিদিন/ ৩১ মার্চ, ২০১৬/ রশিদা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর