আপনি কি কখনো চিন্তা করতে পারেন আপনার বুকের ধন আদরের সন্তান এভাবে সামান্য খাবারের জন্য লঙ্গরখানার লাইনে দাঁড়িয়ে আছে? যেটুকু খাবার আপনি বাসায় নষ্ট করেন ঠিক ততটুকু খাবারের জন্য হাপিত্যেশ, ততটুকু খাবার হাতে পেয়ে যে আনন্দ সেটা গ্রিসের প্রত্যন্ত পাহাড়ী এলাকা ইডিমিনির রিফিউজি ক্যাম্পে না আসলে বোঝা যাবে না।
আমাদের কারোর জীবনেই নেই আদরের সন্তানকে বুকে নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে দেশান্তরী হওয়ার গল্প। যে গল্প আমার আপনার জীবনে অলীক কল্পনা সেই গল্প ইডোমিনিতে আটকে পড়া ১০ হাজার পরিবারের কাছে বাস্তব। তারা জীবন বাজি নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন ৪ ঘণ্টার সমুদ্র পথ, ছোট ডিঙ্গিতে করে ছোট ছোট বাচ্চা আর অতশীপড় বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে পার হওয়ার অভিজ্ঞতা শুনলে শিরে উঠতে হয়। কতো প্রাণ যে ঝরে গেছে সমুদ্রে, কতো বাবার হাত থেকে সন্তান ছিটকে গেছে সাগরের নোনা জলে! এই গল্প বলতে বলতে চোখের কোনে কখন যে পানি চলে এসেছে উজাইরের চোখে, আর নোট নিতে নিতে আমার পেশাদার মনে চলছে উথাল-পাথাল ঢেউ, সেই ঢেউ কি কোন অংশে ভূমধ্য সাগরের ভয়ংকর ঢেউয়ের চেয়ে কম! তাই উজাইরের চেহারা আমার কাছে ঝাপসা হয়ে ওঠে। উজাইরের কোলে তার ৬ বছরের বাচ্চার ভিতর কি তোলপাড় চলছে সেটা বোঝার জন্য শিশু মনস্তত্ববিদ হতে হয় না।
সাফওয়া নামের মেয়েটির হাতে একটি টেডি বিয়ার। আমার ক্যামেরার সামনে উঁচু করে ধরলো! হয়তো কোন চ্যারিটি সংস্থা দিয়েছে তাকে। সে ইংরেজী জানে না, আমি জানি না আরবী। তবে ভাষার তো কোন সীমানা নেই, শিশু সাফওয়া তাই একগাল হেসে উঠলো ক্যামেরায় তার টেডি বিয়ারের ছবি দেখে।
সাত বছর বয়সী আলী বেশ চটপটে ছেলে। তার খুব ভাব চ্যারিটি সংস্থার কর্মীদের সাথে। টুকটাক ইংরেজী সে শিখে ফেলেছে। যেমন আমি সাংবাদিক জেনে নিজেই এগিয়ে এসে বলছিলো, তার নাম আলী, সে ছাড়াও পরিবারে রয়েছে মা-বাবা আর ছোট বোন। সে জানায় একটি বড় তাবুর প্রয়োজন। চ্যারিটি সংস্থার লোকজন বলেছে তারা আলীর জন্য একটি বড় তাবু ব্যবস্থা করবেন। সে বসে আছে কখন একটি তাবু আসবে। আলী আমার ক্যামেরায় খুব সুন্দর করে পোজ দিচ্ছিলো, অনেকটা স্টুডিওতে ছবি তুলে যেভাবে সেভাবে।
আলীর মতো হাজারো যে শিশুর আজ স্কুলে যাওয়ার কথা সেই শিশু আজ ধুলিমাখা জীবনের এক অনিশ্চিত যাত্রায় সামিল হয়েছে। সে ভুলে গেছে বর্নমালা, ভুলে গেছে স্কুলে আওরানো প্রিয় সব ছড়া আর রূপকথার চরিত্র। সে আর বিশ্বাস করে না কোন এক সুপারম্যান উড়ে এসে বদলে দেবে সবকিছু! নিয়তির কঠিন বাস্তবতা তাকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে কিভাবে লাইনে দাড়িয়ে খাবার আনতে হয়, কিভাবে মাথা গোঁজার একটি তাবুর জন্য ঘণ্টার ঘণ্টা বসে থাকতে হয়!
বিডি-প্রতিদিন/ ০২ এপ্রিল, ২০১৬/ রশিদা