রোহিঙ্গা পরিস্থিতির ভিকটিমদের অবস্থা পরিদর্শনকারি নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলের ব্রিফিং উপলক্ষে ১৪ মে সভা অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ সদর দফতরে। এতে সভাপতিত্ব করেন পোল্যান্ডের স্থায়ী প্রতিনিধি।
২৮ এপ্রিল থেকে ১ মে পর্যন্ত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এই প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করেন। ব্রিফিংটি তিনটি পর্বে ভাগ করে উপস্থাপিত হয়। কুয়েতের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মনসুর আল ওতায়িবী বাংলাদেশ সংক্রান্ত অংশ, পেরুর স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত গুস্তাভো মেজা কোয়াড্রা ভেলাজকুয়েজ মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডো সংক্রান্ত অংশ এবং যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত ক্যারেন পাইয়ার্সি রাখাইন স্টেট সংক্রান্ত অংশটি উপস্থাপন করেন।
কুয়েতের রাষ্ট্রদূত তার ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের সরকারি প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক এবং কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের বিষয়ে তথ্য উপস্থাপন করেন। মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিকদের মানবিক সহযোগিতা ও আশ্রয় প্রদানের জন্য তিনি নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণকে সাধুবাদ জানান এবং ভূয়সী প্রশংসা করেন। এক্ষেত্রে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের আসন্ন বর্ষা মৌসুমে সহযোগিতার হাত আরও প্রসারিত করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। তিনি রোহিঙ্গাদের প্রতি সংঘটিত সহিংসতাকে ‘জাতিগত নির্মূল’ বলে অভিহিত করেন।
পেরুর স্থায়ী প্রতিনিধি মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি, সিনিয়র জেনারেল মিন অং হালাইংসহ মিয়ানমার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকের বিষয়টি তুলে ধরেন। ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, এসকল বৈঠকে নিরাপত্তা পরিষদ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদে, নিরাপত্তার সাথে, স্বেচ্ছায় ও সম্মানের সাথে নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তন; এই সমস্যার শিকড় খুঁজে বের করা এবং রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশন এর সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানায়।
যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি তার ব্রিফিংয়ে উত্তর রাখাইন প্রদেশের বর্তমান পরিস্থিতি, বিশেষ করে গ্রামের পর গ্রামে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।
নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদল ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেটমেন্টের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। তারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারকের বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চান। মিয়ানমার সরকার যাতে সেদেশে জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্ট সকল আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদলের অবাধ ও নিরাপদ প্রবেশ এবং বাধাহীন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করে সে বিষয়ের প্রতি এই প্রতিনিধিদল বিশেষভাবে জোর দেন।
এছাড়া শিশু ও নারীসহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সকল সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার জন্য মিয়ানমারের সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় জাতিসংঘ পরিদর্শন দল। রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে উত্থাপনের উল্লেখ করেন কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিবর্গ।
ব্রিফিং শেষে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশ চীন, যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, ফ্রান্স, কাজাখিস্তান, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, রাশিয়ান ফেডারেশন, নেদারল্যান্ডস ও পোল্যান্ডের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন।
নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদলের এই পরিদর্শন মিয়ানমার সঙ্কটের বিষয়ে সকলের চোখ খুলে দিয়েছে মর্মে প্রায় সকল সদস্যদেশই মন্তব্য করেন।
রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে বলে মন্তব্য করেন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধিগণ। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ তাদের বক্তব্যে মানবতার বিরুদ্ধে এই ধরণের অপরাধ করে যাতে কেউ পার না পায় তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
এই সঙ্কট সমাধানে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও জাতিসংঘসহ মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতের সাথে সামনের দিনগুলোতে নিরাপত্তা পরিষদ আলোচনা অব্যাহত রাখবে মর্মে সুইডেনসহ কয়েকটি সদস্য দেশের প্রতিনিধি তাদের বক্তব্যে উল্লেখ করেন।
নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদেশের বাইরে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের স্থায়ী প্রতিনিধি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা প্রদান এবং মিয়ানমারের সাথে বিশ্বাসের ভিত্তিতে এই সমস্যার সমাধান করতে চান মর্মে উল্লেখ করেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। তিনি সভায় নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর চারটি প্রত্যাশার কথাও তুলে ধরেন। এগুলো হল: ১) নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিতকল্পে ধারাবাহিক ও নিষ্পত্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ ২) গত বছর গৃহীত নিরপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেটমেন্টের আলোকে একটি প্রস্তাবনা প্রণয়ন ৩) রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত বাস্তবায়ন ৪) জবাবদিহিতা ও সুবিচার নিশ্চিতকরণ।
সহিংসতার বিষয়ে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাগণ মিয়ানমারের আদালতে বিচার পেতে মামলা দায়ের করতে পারে মর্মে মিয়ানমারের স্থায়ী প্রতিনিধির বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ এই পরিষদের উদ্দেশ্যে বলেন, নাগরিকত্বের বিষয়টি নিষ্পত্তি না হলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কীভাবে মিয়ানমারের আদালতে আইনি লড়াই করতে পারে?
এই ব্রিফিং অনুষ্ঠান শেষে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদেশসমূহ একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। উল্লেখ্য, নিরাপত্তা পরিষদ তাদের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরের উপর গত ৯ মে একটি প্রেস স্টেটমেন্ট ইস্যু করে।
বিডি প্রতিদিন১৫ মে, ২০১৮/ফারজানা