১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ১৩:১৫

হার্বার্ডে বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্প

এনআরবি নিউজ, নিউইয়র্ক থেকে

হার্বার্ডে বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্প

হার্ভার্ড কনফারেন্সে বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্প উপস্থাপন করছেন পবন চৌধুরী। ছবি : এনআরবি নিউজ।

অপ্রতিরোধ্য গতিতে জেগে উঠা বাংলাদেশের জয়গান ধ্বনিত হলো বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে। একইসাথে সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জানানো হলো যে, বৃটিশ ধ্যান-ধারণার অধ্যায় ছেড়ে শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুযায়ী আমলারাও এখন সর্বসাধারণের সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলছেন। উপদেশ ও পরামর্শ পাচ্ছেন। সে অনুযায়ী উন্নয়ন পরিক্রমায় সমগ্র জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা ঘটছে। সে কারণেই জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অনুদানের অর্থ না পেলেও এসডিজি বাস্তবায়নে অগ্রগতিসাধিত হচ্ছে উৎসাহব্যঞ্জকভাবে। 

সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বস্টনে হার্ভার্ড ইউনিভাসিটির উদ্যোগে গুতম্যান কনফারেন্স সেন্টারে দিনব্যাপী এ কনফারেন্সে অংশ নেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তাসহ এমআইটি, ব্রাউন, কর্ণেল, ক্যানসাস, প্রিন্সটনের স্কলার, বিশ্বব্যাংকের সাবেক চীফ ইকনোমিস্ট, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার নেতৃবৃন্দ। ছিলেন এসডিজি বিষয়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান সমন্বয়কারী আবুল কালাম আজাদ, অর্থ সচিব আব্দুর রৌফ তালুকদার, বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী, বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট রুবানা হক, উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশিদের তথ্য-প্রযুক্তি সেক্টরে কর্মসংস্থানে দীর্ঘদিন যাবত কর্মরত ‘পিপল এন টেক’র প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ইঞ্জিনিয়ার আবু বকর হানিপ। 

উদ্বোধনী পর্বে হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের বেলফার সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র ফেলো ড. ইকবাল কাদির গত দশকের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোকপাত করেন এবং বিনিয়োগে আগ্রহীদের জন্যে অপূর্ব পরিবেশ বিরাজ করছে বাংলাদেশে-সে কথাও বলেন। তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়-এমন সংবাদ-বিশ্লেষণের সমালোচনা করে ড. কাদির বলেন, চলমান উন্নয়ন-অভিযাত্রায় এ এক বড় অন্তরায়। 

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বিভিন্ন পথ-পরিক্রমায় বাংলাদেশ যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করেছি, সে সময় আমি আমেরিকার বেশ কটি কোম্পানীর সাথে কথা বলেছি বাংলাদেশে যাবার জন্যে। সকলেই নাকচ করেছেন আমার অনুরোধ। এক পর্যায়ে নরওয়ের টেলিফোন কোম্পানী আমার অনুরোধে সাড়া দেয়। সেই কোম্পানীর বর্তমানে বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিমাণ ৭ বিলিয়ন ডলার। তবে এখনও পশ্চিমা দেশগুলোতে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে বাংলাদেশ সম্পর্কে। তারা বাস্তবতার আলোকে বিবেচনায় আগ্রহী নয়। এমন অবস্থার উত্তরণে আমার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এখনও একই প্রক্রিয়ায় রয়েছি বলে মাথার চুল কম দেখতে পাচ্ছেন। আমি আজ স্বস্তি পাচ্ছি এজন্যে যে, হার্ভার্ডে মিত্তাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক এবং হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ড. তরুণ খান্না বাংলাদেশ নিয়ে এ কনফারেন্সের আয়োজন করলেন। 

শিক্ষাবিদ, উন্নয়ন অর্থনীতি নিয়ে গবেষণারতরাই এখানে এসেছেন। আমি সর্বান্তকরণে আশা করছি, পশ্চিমাদেশসমূহে বিরাজিত নেতিবাচক মনোভাব অবসানে এ আলোচনা বড় ধরনের একটি প্রভাব ফেলবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিশ্বে দুই শতাধিক দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০ এ। এছাড়া জনসংখ্যাগতভাবে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। 

ড. কাদির অত্যন্ত প্রত্যয়ের সাথে উল্লেখ করেন যে, বর্তমানের ধারা অব্যাহত থাকলে তিন দশকের মধ্যেই বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ভিতওয়ালা দেশের মধ্যে ২০তম স্থান দখলে সক্ষম হবে। 

ড. কাদির আরও উল্লেখ করেন, গত তিন দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকার প্রশংসাও উচ্চারিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। 
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং বর্তমানে কর্ণেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক কৌশিক বসু ২০১৫ সালে ঢাকা সফরের আলোকে বলেছেন, ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেষমূহকে পেছনে ফেলে এগুচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি মানুষের জীবন-মানের উন্নয়নেও উদাহরণ তৈরি করেছে দেশটি। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ভারতের চেয়েও বেশী। এসব সম্ভব হচ্ছে উন্নয়ন-অভিযাত্রায় সমগ্র জনগোষ্ঠীকে একিভূত করায়। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এসডিজি বিষয়ক প্রধান সমন্বয়কারী আবুল কালাম আজাদ এমডিজির পথ ধরে বাংলাদেশ কীভাবে এসডিজি-তেও অগ্রগতি সাধন করছে। 

‘কাউকে পিছিয়ে থাকতে দেয়া হবে না : ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে’ শীর্ষক আলোচনাটি ছিল মধ্যাহ্নভোজের পর। অর্থাৎ অনেকেই পরিশ্রান্ত কিংবা ঘুম কাতুরে ছিলেন। এ অবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটাতে উন্নয়নের ধারাবিবরণী উপস্থাপনে বড় পর্দায় একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করেন তিনি। সেটি ছিল উন্নয়নের জয়যাত্রা আলোকে। আর এর মধ্যদিয়েই সকলে ফিরেন স্বাভাবিক অবস্থায় এবং গভীর মনোযোগ দিয়ে নানা ক্ষেত্রে অগ্রযাত্রার তথ্য-চিত্রসমূহ অবলোকন করেন। 

স্বল্পভাষী আজাদ বলেন, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের জীবনে অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। বাংলাদেশের কোনো গ্রামেই এখন খালি পায়ে কাউকে হাঁটতে দেখা যায় না। স্কুল-কলেজগামী ছাত্র-ছাত্রীদের কটি পোশাক রয়েছে, সে কথাও সরাসরি জানা সম্ভব হয় না। অথচ একসময়ে একজন ছাত্রের একটি বেশী শার্ট অথবা প্যান্ট ছিল না। বাজার-ঘাটে জুতা-স্যান্ডেল পায়ে খুব কম মানুষকেই দেখা যেত। এসব সম্ভব হয়েছে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নে উদ্বুদ্ধ করায়। 

আজাদ বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং অনিয়ম অথবা স্থবিরতা থাকলেও সর্বক্ষেত্রে নয়। দুর্নীতি রোধে কঠোর পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ঢালাও অভিযোগ এখন করা সমীচিন নয়। কারণ, আমি নিজেও একজন আমলা। কিন্তু আমি সকল মানুষের সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলি। তাদের পরামর্শ গ্রহণ করি। প্রবাসীরাও এগিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশে। তাদের মেধা-অভিজ্ঞতাকেও বাংলাদেশ কাজে লাগাতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। 

কনফারেন্সের সঞ্চালনা করেন নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশী রেশমা হুসাম। সনোফিল্টারের উদ্ভাবক ড. হুসামের কন্যা রেশমা হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মেধাবী এই বাংলাদেশী আমেরিকান ও বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং অভিবাসন নিয়ে কথা বলেছেন। 

উল্লেখ্য, এবারই প্রথম হার্ভার্ডের নিজস্ব উদ্যোগে বাংলাদেশ নিয়ে কনফারেন্স হলো এবং আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্নরা এতে গবেষণা-পর্যবেক্ষণমূলক বক্তব্য উপস্থাপন করলেন। 

কেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবেন-এ আলোকে অনুষ্ঠিত সেমিনারে বক্তৃতাকালে ব্রুমার অ্যান্ড পার্টনারের ম্যানেজিং পার্টনার খালিদ কাদির অভিযোগ করেছিলেন যে, বাংলাদেশের আমন্ত্রণে অনেকে সেখানে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আমলাদের আন্তরিক সহযোগিতা পাননি। এমন পরিস্থিতির অবসান ঘটানো উচিত। 

এ সময় বাহরাইনের আসমা ক্যাপিটল পার্টনার নামক একটি কোম্পানীর অধিকর্তা আবু বকর হানিপ বলেন, বিদেশী বিনিয়োগকারী হিসেবে আমি সকলের সহায়তা পাচ্ছি। সুতরাং ঢালাওভাবে অভিযোগ করা সমীচিন নয়। 

এ পর্বে অর্থ সচিব আব্দুর রৌফ তালুকদার বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সাদর আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রণোদনাও প্রদান করা হয়েছে। আগের অবস্থানে নেই বাংলাদেশ। সেজন্যেই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে সর্বক্ষেত্রে। উন্নয়নের মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরীও কোন কোন ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার প্রসঙ্গ টানলেও সামগ্রিক অর্থে চমৎকার একটি পরিবেশ বিরাজ করছে বাংলাদেশে বিনিয়োগের-এ অভিমত পোষণ করেন। বিদেশী বিনিয়োগকারিদের আকৃষ্ট করতে ১০০টি রফতানী উন্নয়ন জোন প্রতিষ্ঠা করার কথাও তিনি জানান। 

ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মুসা সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ছোট্ট একটি জনপদের মানুষ কীভাবে উন্নয়নের ছোঁয়া পেয়েছে তা বিবৃত করেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি এনজিওগুলোর কার্যক্রমকেও গুরুত্ব দেন তিনি। 

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঘাতকদের বর্বরতা আলোকে একটি পর্বের সঞ্চালনা করেন বিবিসি নিউজের মাহফুজ সিদ্দিকী। এতে অংশ নিয়ে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক গ্যারি ব্যাস নানা যুক্তিতর্কের মাধ্যমে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্তদের সমর্থনকারি রাজনৈতিক দল অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামীকে গণতান্ত্রিক পরিবেশে স্বাভাবিক কাজকর্ম পরিচালনার পক্ষে মত দেন। অবশ্য কনফারেন্সে উপস্থিত আর কেউই এমন মতাবাদ পোষণ করেননি। অধিকন্তু একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্তদের বিচার কার্যক্রমেরই প্রশংসা উচ্চারিত হয়েছে। কনফারেন্সে উপস্থিতি অনেকেই এ সংবাদদাতার সাথে কথা প্রসঙ্গে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম-ব্যবসায়ী তথা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যারা নিজেদের আখের গোছাতে চায়-তাদের বিপক্ষে রয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংস্থার শীর্ষপদধারীরা।

বিডি প্রতিদিন/এনায়েত করিম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর