নিউইয়র্কে দক্ষিণ এশিয়ানদের অধিকার-মর্যাদা নিয়ে কর্মরত সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে করোনাভাইরাসে মৃতদের পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক করা হয়েছে। মৃতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্প্যানিশ এবং আফ্রিকান বলা হচ্ছে। এরপরে রয়েছে শ্বেতাঙ্গ এবং এশিয়ান।
সিটি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেছেন যে, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত মৃত্যুবরণকারী (১৬ হাজারের অধিক)‘দের মধ্যে এশিয়ান ছিলেন ৮৩০ জন। এ সংখ্যা জানার পরই আপত্তি উঠেছে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, পাকিস্তানীদের পক্ষ থেকে। তারা প্রশ্ন করেছেন যে, তাহলে সিটি প্রশাসনের নথি অনুযায়ী এশিয়ান বলতে কি শুধু চীন, জাপান, তাইওয়ানকে বুঝানো হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার উপরোক্ত দেশসমূহের মধ্যে শুধুমাত্র বাংলাদেশেরই পৌণে দুই শত’র মত প্রবাসী মারা গেছেন করোনায়। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশী হবে। কারণ, আত্মীয়-স্বজনহীনরা কমিউনিটিভিত্তিক পরিসংখ্যানে উঠেনি। পাকিস্তান এবং নেপালেরও অনেক মানুষ মারা গেছেন।
নিউইয়র্কে প্রবীন দক্ষিণ এশিয়ানদের স্বাস্থ্য-সেবাসহ নানাবিধ কাজে নিয়োজিত ‘ইন্ডিয়া হোমস’র প্রোগ্রাম ডিরেক্টর সিলভিয়া শিকদার ১ মে শুক্রবার এ সংবাদদাতাকে প্রচণ্ড ক্ষোভের সাথে জানান, সেনসাস এবং সিটি প্রশাসনের নানা প্রক্রিয়াতেই দক্ষিণ এশিয়ানদের সাথে এক ধরনের বৈরিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। চায়নিজরা সিটি প্রশাসনসহ স্টেট ও কংগ্রেসে সোচ্চার থাকায় সকলেই এশিয়ান বলতে তাদেরকেও মনে করছেন। আর এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ানরা পর্দার আড়ালে থাকছেন। অর্থাৎ কমিউনিটির উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্যে অর্থ বরাদ্দের সময় দক্ষিণ এশিয়ানরা বাদ পড়ছেন। প্রশাসনে গুরুত্ব পাচ্ছেন একচ্ছত্রভাবে চায়নিজরা। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয়দেরকেও কিছুটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
সিলভিয়া উল্লেখ করেন, ‘করোনাভাইরাসের মহামারিতে আতংকগ্রস্ত বাংলাদেশিরা ৯১১ কিংবা ৩১১ এ কল করেও আন্তরিক সহায়তা খুব কম সময়েই পান। নবাগতরা ইংরেজীতে একেবারেই কথা বলতে সক্ষম না হওয়ায় অপারেটররা পাত্তা দিতে চান না। অথচ সিটিতে বিধি রয়েছে ভাষাগত সহায়তার। কাগজে-কলমে থাকলেও অধিকাংশ সময়ই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন অভিবাসীরা। এহেন অবস্থা চলতে পারে না। কারণ, এই সিটিতে বাংলা ভাষার মানুষের সংখ্যা এখন অনেক।
দক্ষিণ এশিয়ান এবং ইন্দো-ক্যারিবিয়ানদের অধিকার নিয়ে কর্মরত ‘ছায়া-সিডিসি’র নির্বাহী পরিচালক অনিতা শিচরণ এ প্রসঙ্গে বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসংখ্যান মেনে নেয়ার মত নয়। কারণ, এশিয়ান হিসেবে যা মনে করা হয়েছে তা সঠিক হতে পারে না। বিশ্বে সর্ববৃহৎ মহাদেশের ডজনখানেক রাষ্ট্র এর অন্তর্ভুক্ত। অথচ হাসপাতাল কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অথবা সেনসাসের ফরমে সাউথ এশিয়ান বলতে কিছু নেই। বিশেষ করে জ্যাকসন হাইটস, এলমহার্স্ট, জ্যামাইকা, ওজোনপার্ক, চার্চ-ম্যাকডোনাল্ড, পার্কচেস্টার, নিউকার্ক, কোনি আইল্যান্ড, কুইন্স ভিলেজ, রিচমন্ডহীল প্রভৃতি এলাকা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ানদের ঘাঁটি। এসব এলাকার ফরমে অবশ্যই এশিয়ান’র পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ান থাকা উচিত।
মঙ্গলবার পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মধ্যে ১০৬৫ জনকে ‘অন্যান্য’ অথবা ‘অজ্ঞাত’ ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে। করোনায় নিশ্চিত মৃত্যুবরণকারি এ সংখ্যা মোট মৃত্যুর ৯%। অনিতা শিচরণ উল্লেখ করেছেন, এজন্যেই আমরা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। মনে হচ্ছে কমিউনিটির মৃতরা ঐ হিসাবে সুনির্দিষ্টভাবে আসছে না। এমনকি, আক্রান্তদের তালিকাও সঠিকভাবে করা হচ্ছে না। অথচ কে কোন দেশের অভিবাসী সেটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলে চিকিৎসা ব্যবস্থায় অর্থ বরাদ্দ ঠিকমত করা সম্ভব। পাশাপাশি করোনা যাতে সংক্রমিত না হতে পাসে সে পরিক্রমাতেও সে সব দেশের অভিবাসীরা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে সিটি প্রশাসন বলেছে, এই মহামারিতে আক্রান্ত এবং নিহতদের তালিকাটি এখনও চূড়ান্ত নয়। প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে। ল্যাবরেটরির রিপোর্টে তারা আস্থাশীল বলেও উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ভাইরাসে নিহতদের জাতি ও বর্ণগত পরিচয় অবশ্যই বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হবে পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক হলে। তারা আরো বলেন, নিহতদের আইডি পাওয়া না গেলে অথবা স্বজনেরা যোগাযোগ না করলেই ‘অজ্ঞাত’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। কারণ স্বাস্থ্য বিভাগ নিহতদের জাতিগত বা বংশগত পরিচয় সন্ধান করে না।
সিটি স্বাস্থ্য বিভাগের মুখপাত্র প্যাট্রিক গ্যালাহো বলেন, ‘এ ধরনের পরিস্থিতিতে আক্রান্ত এবং মৃতদের ডাটা সঠিকভাবে তৈরি করা সম্ভব হয়, যদি সকলেই টেস্ট করেন। সে সময়েই বিস্তারিত তথ্য সন্নিবেশিত হয় সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু প্রয়োজনীয় সংখ্যক টেস্টিং কিট না পাওয়ায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না এখন পর্যন্ত। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সম্পন্ন টেস্টিংয়ের রেজাল্টে বলা হয়েছে, পজিটিভ এসেছে ‘মাল্টি/অজ্ঞাত/অন্যান্য’ ক্যাটাগরির ২২.৮%। অপরদিকে হিসপ্যানিক-২২.৫%, কৃষ্ণাঙ্গ-২২.১%, এশিয়ান-১১.৭%, শ্বেতাঙ্গ-৯.১%। অর্থাৎ ‘মাল্টি/অজ্ঞাত/অন্যান্য ক্যাটাগরিতেই দক্ষিণ এশিয়ানরা রয়েছেন। এর আগে এক প্রেস কনফারেন্সে সিটি মেয়র বিল ডি ব্লাসিয়ো বলেছেন যে, তার স্ত্রী তথা সিটির ফার্স্ট লেডি চিরলেন ম্যাকরে-ও নেতৃত্বে করোনা টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। তারা নিহত ও আক্রান্তদের বর্ণ এবং জাতিগত পরিচয়ও সংগ্রহ করবেন। যাতে কেউ বৈষম্যের শিকার না হয়।
সেনসাসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী নিউইয়র্ক সিটিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের ৪ লাখ ৩৪ হাজার
অভিবাসী বাস করছে। তবে এই সংখ্যাও প্রকৃত সংখ্যার কাছাকাছিতেও নেই বলে মন্তব্য করেছেন কমিউনিটিভিত্তিক সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, সেনসাসে অনেকেই অংশ নিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না। অনেকে ভীত এজন্যে যে, সেনসাসের তথ্য হয়তো অভিবাসন পুলিশে হস্তান্তর করা হবে। এছাড়া অনেকেই ইংরেজেতে অজ্ঞ বলেও সেনসাসের গুরুত্ব উপলব্ধিতে সক্ষম হচ্ছেন না। এভাবেই অনেক সিটিজেন/গ্রীণকার্ডধারীও সেনসাসের ফরম পূরণে আগ্রহী হন না।
সিটিজেনশিপ গ্রহণকারিরা মনে করেন যে, আত্মীয়-স্বজনকে স্পন্সর করার জন্যেই সিটিজেনশিপ দরকার।
ব্রুকলীনে বাংলাদেশি অধ্যুষিত চার্চ-ম্যাকডোনাল্ড এলাকার সংগঠক শাহানা হানিফ বলেন, প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠেই শুনি করোনায় বাংলাদেশি মারা যাবার দু:সংবাদ। তাই সিটির যে ডাটা তৈরি করা হয়েছে সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাই, আমাদের লোকজনের তালিকা আমাদেরকেই তৈরি করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশিরা এমন ভয়ংকর পরিস্থিতির ভিকটিম, সেটি আড়ালেই রয়ে যাবে। তৃণমূলে কাজ করতে আগ্রহীদের সমন্বয়ে সম্প্রতি গঠিত ‘বাংলাদেশি আমেরিকান ফর পলিটিক্যাল প্রগ্রেস’ (বাপ) এর সংগঠক শাহানা হানিফ বলেন, আমরা নিজ নিজ এলাকার মানুষেরাই সঠিক একটি তালিকা করবো কতজন মারা গেলেন এবং কতজন আক্রান্ত। উল্লেখ্য, কেনসিংটন এলাকার সিটি কাউন্সিলম্যান (৩৯ ডিস্ট্রিক্ট) ব্র্যাড ল্যান্ডারের অফিসের কর্মকর্তা শাহানা সামনের নির্বাচনে প্রার্থীতার ঘোষণা দিয়েছেন ডেমক্র্যাটিক পার্টি থেকে। ব্র্যাড ল্যান্ডারের এটি হচ্ছে শেষ মেয়াদ।
সাউথ এশিয়ান এবং ইন্দো-ক্যারিবিয়ানদের অধিকার নিয়ে নিউইয়র্ক অঞ্চলে কর্মরত ‘দেশীজ রাইজিং আপ এ্যান্ড মুভিং’ (ড্রাম) এর নির্বাহী পরিচালক ফাহাদ আহমেদ বলেন, সিটি মৃতদের যে তালিকা করেছে সেটি কোনভাবেই সঠিক নয়। আমাদের মানুষেরা কী বৈষম্যের শিকার। বিশেষ কোন কারণে কী এমন তালিকা করা হচ্ছে। তাহলে তারা তালিকা থেকে বাদ পড়ছে কেন? ফাহাদ বলেন, অন্য কমিউনিটি( হিস্যপানিক, কৃষ্ণাঙ্গ)’র লোকজনও মারা যাচ্ছেন, এটি মিথ্যা নয়। তবে তারা তালিকায় উঠছেন যথাযথভাবে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ানরা সে সুযোগ পাচ্ছে না।
নেপালিদের অধিকার-মর্যাদা নিয়ে কর্মরত ‘অধিকার’র ক্যাম্পেইন ম্যানেজার প্রার্থনা গুরুঙ্গ বলেন, অনেক নেপালি করোনায় আক্রান্ত হয়ে নিজ বাসাতেই মৃত্যুবরণ করেছেন। তারা ভাষাগত দুর্বলতা অথবা অভিবাসনের মযাদা প্রশ্নবিদ্ধ থাকার কারণে হয়তো ৯১১ এ কল করেননি। অর্থাৎ তারা চিকিৎসা থেকে চরমভাবে বঞ্চিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এখন সিটির তালিকাতেও ঠাঁই হচ্ছে না।
সিটির হেলথ এ্যান্ড হসপিটাল কর্পোরেশনের মুখপাত্র স্টিফেনী গুজম্যান বলেছেন, সিটির রীতি অনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি অথবা যে কোন কাজে আগতদেরকে ১৩টি ভাষায় ফরম দেয়া হয়। এরমধ্যে বাংলা, আরবি, উর্দু, হিন্দি, কোরিয়ান, ক্যান্টনিজ, ম্যান্ডারিনও রয়েছে। অনুবাদ চাইলেই প্রদান করতে বাধ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ২০১৭ সালের রীতি অনুযায়ী বাংলা, কোরিয়ান, উর্দু, আরবীসহ ১০ ভাষার নোটিশ, নির্দেশনা প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে করোনা পরিস্থিতি হঠাৎ করে এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে, অনেক রোগী গুরুতর অবস্থায় থাকায় তাদের নাম-পরিচয় (বিশেষভাবে যাদের সাথে ফটো আইডি পাওয়া যায়নি) সুনির্দিষ্টভাবে ফাইলে উঠেনি। মারা যাবার পরও যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির স্বজনেরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতেন তাহলেও তালিকাটিকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সঠিক বলা যেত।
বাপ’র প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য মৌমিতা আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, বেশ কয়েকজন রোগীর অনুবাদক হিসেবে আমি কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, তারা তার চিকিৎসকের সাথে কথা বলতে সক্ষম হচ্ছেন না। কী ধরনের কষ্ট পাচ্ছেন অথবা কদিন যাবত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন সেটিও বলতে পারছেন না। একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করে মৌমিতা জানান, বাংলাদেশি একজন নারী টেস্ট করেছেন ফোর্টগ্রীণে ব্রুকলীন হাসপাতালে। কিন্তু রেজাল্ট পাচ্ছেন না। কারণ, সেখানে মাত্র একজন লোক কাজ করছিলেন।
বাপ’র আরেকজন মেম্বার ড. রায়হান ফারুকী বলেন, অনেক বাংলাদেশি ৯১১ এ কল করে অপারেটরকে ঠিকমত বুঝাতে সক্ষম হচ্ছেন না কী জন্যে ফোন করেছেন। এ অবস্থায় ড. ফারুকী বাংলা ভাষাভাষীদের জন্যে একটি হটলাইন সার্ভিস চালুর কথা ভাবছেন। সেখানে ফোন করলে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হবে।
বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ