প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শীর্ষ পর্যায়ের দুই স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বক্তব্যে গভীর উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র আমেরিকায়। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় ইনফেকশাস ডিজিজ এক্সপার্ট ড. এন্থনী এস ফাউসি এবং সিডিসির পরিচালক রবার্ট আর রেডফিল্ড ১২ মে মঙ্গলবার ইউএস সিনেটে প্রদত্ত বক্তব্যে অতন্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, সামাজিক দূরত্ব অটুট এবং মাস্ক ব্যবহারের নিশ্চয়তার পাশাপাশি সকল আমেরিকানের করোনা টেস্টের পর যারা পজিটিভ, তাদের চিকিৎসা ও গতিবিধি মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা ব্যতিত তাড়াহুড়ো করে লকডাউন শিথিল এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করা হলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। যে মহামারি শুরু হবে তা কেউই নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে না।
উল্লেখ্য, এর আগেরদিন অর্থাৎ ১১ মে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনা বিষয়ক প্রেস ব্রিফিংকালে দাবি করেছেন যে, সবকিছু সচল করার জন্য আমরা সবকিছু করতে সক্ষম হয়েছি। অথচ তারই দুই শীর্ষ কর্মকর্তা সিনেটে করোনা সম্পর্কিত শুনানীতে আরো বলেছেন যে, এখনও প্রয়োজনীয় টেস্ট করা সম্ভব হয়নি। সে ক্ষমতাও নেই। এমনকি, টেস্টের রেজাল্ট অনুযায়ী ‘পজিটিভ’ লোকজনকে যথাযথভাবে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থাও করা হয়নি এখন পর্যন্ত।
ড. ফাউসি বলেন, ‘স্টেটগুলো যদি খুব দ্রুত তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল করে তাহলে বড় ধরনের একটি ঝুঁকি নেয়া হবে যে, আপনি করোনার ভয়াবহতাকে বিস্তৃত করার স্যুইচ টিপলেন, যা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবেন না। আর এর ফলে জনজীবনে স্বাভাবিক অবস্থা তথা ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনা দূরের কথা, এমন একটি অবস্থা তৈরী হতে যা কল্পনাও করা যায় না।’
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শ্রম এবং পেনশন বিষয়ক সিনেট কমিটির শুনানীতে এফডিএর পরিচালক ড. রেডফিল্ডও বক্তব্য দিয়েছেন। তিনিও উল্লেখ করেছেন, সবকিছু সচল করার মত পরিবেশ এখনও তৈরী হয়নি। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জার্মানিতে লকডাউন উঠিয়ে নেয়ার পর সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় আমেরিকানদের মধ্যে একই শংকা বিরাজ করলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেটি আমলে নিতে চাচ্ছেন না-যা খুবই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার-মন্তব্য করেছেন ডেমক্র্যাট সিনেটররা। যার প্রভাব পড়ে বিনিয়োগের মার্কেটেও।
উল্লেখ্য, ডেমক্র্যাট শাসিত প্রতিনিধি পরিষদে এমন একটি শুনানীতে ড. ফাউসি সহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ থেকে বিরত করেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের প্রত্যাশা ছিল রিপাবলিকান শাসিত সিনেটে হয়তো ড. ফাউসি, ড. রেডফিল্ড তার পছন্দের কথা বলবেন, কিন্তু তারা প্রকৃত পরিস্থিতি যথাযথভাবে উপস্থাপনে কার্পণ্য করেননি। এই প্রথম তারা সরাসরি আমেরিকানদের সামনে প্রকৃত পরিস্থিতি অবলিলায় উপস্থাপন করতে সক্ষম হলেন। কারণ, এই শুনানী প্রধান প্রধান সবকটি টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে।
ড. ফাউসি সিনেটকে জানান যে, সেপ্টেম্বরে নতুন শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরুর আগে করোনাভাইরাস থেরাপিউটিক্স এবং ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হবে বলে তিনি মনে করছেন না। আর ঐ সময়ে অন্যান্য দেশে ভয়ংকরভাবে পুনরায় ছড়িয়ে পড়ার আশংকা করা হচ্ছে, যা থেকে যুক্তরাষ্ট্রও রেহাই পাবে না। ড. ফাউসি উল্লেখ করেন, করোনা-সম্পর্কিত রোগে ইদানিং শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। অর্থাৎ কোন বয়সের মানুষই অদৃশ্য একটি শক্রুর টার্গেটের বাইরে নই।
ড. রেডফিল্ড সিনেটের সামনে চাঞ্চল্যকর তথ্য উপস্থাপন করেন যে, জাতীয়ভিত্তিক স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তোলা জরুরী। এ সময় তিনি স্বীকার করেন যে, গত বছর কংগ্রেসের অনুমোদন সত্বেও সংক্রমিত হবার আগেই তা পর্যবেক্ষণে সক্ষম ৩০টি পদ পূরণ করা সম্ভব হয়নি এখন পর্যন্ত। তা করা হলে সমগ্র কমিউনিটি নজরদারিতে রাখার পাশাপাশি নাসিং হোমগুলোর অমানবিক পরিস্থিতি অবলোকন করতে হতো না। করোনা মহামারির প্রধান ভিকটিম হয়েছে নার্সিং হোমের অসহায় বাসিন্দারা। অথচ তারা নিরাপদে জীবনের শেষদিনগুলো অতিবাহিত করার অভিপ্রায়েই নার্সিং হোমের আশ্রয় নিয়েছেন।
তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমরা এখনো লকডাউন উঠিয়ে নেয়ার পরিবেশ তৈরীতে সক্ষম হইনি। তবে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
এ শুনানীতে আরো বক্তব্য রাখেন ফুড এ্যান্ড ড্রাগ কমিশনার ড. স্টিফেন হাহ এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক সহকারি সচিব এডমিরাল ব্রেট পি যাইরোর। তারাও ভিডিও কনফারেন্সের মাধমে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
সিনেটর (রিপাবলিকান) ল্যামার আলেক্সান্দার, ড. ফাউসি, ড. রেডফিল্ড এবং ড. স্টিফেন কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। ৮১ হাজার আমেরিকানের মৃত্যুর সময়েই এই শুনানী অনুষ্ঠিত হলো বলে উল্লেখ করে ভার্জিনিয়ার ডেমক্র্যাট সিনেটর টিম কাইন দক্ষিণ কোরিয়ার রেফারেন্স দেন বেশ কবার। ‘কভিড-১৯: সেইফলি গেটিং ব্যাক টু ওয়ার্ক এ্যান্ড ব্যাক টু স্কুল’ শিরোনামের এই আলোচনায় সংক্রমণ এবং রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের শীর্ষ কর্মকর্তাগনের তথ্যভিত্তিক বক্তব্য শোনার পর সিনেট কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। অথচ রিপাবলিকানরা জড়ো হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রত্যাশার পরিপূরক একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে। ট্রাম্প চাচ্ছেন দ্রুত সবকিছু চালু করার মধ্য দিয়ে নভেম্বরের নির্বাচনে নিজের বিজয় নিশ্চিতের রূপরেখা নিয়ে মাঠে নামতে। দু’মাস আগে করোনা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সারা আমেরিকায় জরুরী অবস্থা জারির পর এটাই সিনেটে প্রথম কোন বিষয়ে শুনানী হলো যেখানে অথবা আশপাশেও ট্রাম্পের উপস্থিতি ঘটেনি।
ইউটাহ্ রিপাবলিকান সিনেটর মীট রমনী জানতে চেয়েছিলেন যে, শীঘ্রই কোন ভ্যাকসিন বাজারে আসার সম্ভাবনা আছে কিনা। জবাবে ড. ফাউসি বলেছেন, এটি অবশ্যই খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে ঘটবে না। আমরা যেভাবে আশা করছি, সেভাবে ঘটবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের জন্যে।
রিপাবলিকান সিনেটরের কয়েকজন করোনা পরিস্থিতি যথাযথভাবে হ্যান্ডেল করার জন্যে ট্রাম্পের প্রশংসা করেন। কমিটির চেয়ারম্যান আলেক্সান্দার দাবি করেন যে, পুনরায় কাজে যোগদানের ক্ষেত্র তৈরী হচ্ছে।
ইন্ডিয়ানার রিপাবলিকান সিনেটর মাইক ব্রাউন বলেছেন যে, আমি খুবই আশাবাদি যে পেছানোর আর সুযোগ নেই। তবে সকল সিনেটর এমন মনোভাবে বিশ্বাসী নন। শুনানীতে সিনেটর মীট রমণী করোনা টেস্টে দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তুলনামূলক একটি তথ্য উপস্থাপন করে বলেন, ‘৬ মার্চ পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়া ১৪০০০০ টেস্ট করেছে। সে সময়ে মারা গেছে ২৫৮ জন। অপরদিকে একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে টেস্ট করা হয়েছে মাত্র ২০০০ ব্যক্তির করোনা টেস্ট। করোনা নিয়ন্ত্রণে আমাদের কার্যক্রমে আমি কোনভাবেই সন্তুষ্ট হতে পারছি না।’
এদিকে, সিনেটের শুনানীকালেই প্রতিনিধি পরিষদে ডেমক্র্যাটরা করোনার ভিকটিমদের জন্যে ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের একটি বিল উত্থাপন করেছে। এর এক ট্রিলিয়ন পাবে স্টেট, স্থানীয় প্রশাসন। অবশিষ্ট অর্থ থেকে পুনরায় আমেরিকানরা মাথাপিছু ১২০০ ডলার (শিশুরাও ১২০০ ডলার) করে পাবেন। বেকার এবং খাদ্য সহায়তার জন্যেও বেশ কিছু অর্থ ব্যয় করা হবে এই বিল পাশ হলে। এছাড়া, আসছে ডিসেম্বর পর্যন্ত বেকার ভাতা প্রদানের কথাও রয়েছে এ বিলে।
উল্লেখ্য, নিউইয়র্কের ১২ কংগ্রেসম্যান গত সপ্তাহে যুক্ত স্বাক্ষরের এক পত্রে এই পঞ্চম বিলে ( দ্য হেল্থ এ্যান্ড ইকনোমিক রিকভারী অমনিবাস ইমার্জেন্সি সল্যুশন্স তথা হিরোজ এ্যাক্ট) অবৈধ অভিবাসীদেরকেও মাথাপিছু ১২০০ ডলার করে প্রদানের বিষয় অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছেন। একই চিঠিতে বাসা ভাড়া প্রদানে অক্ষমদের জন্যে ভাড়া মওকুফ এবং বাড়ির মালিকদের মর্টগেজের কিস্তি মওকুফের আহবানও ছিল। ১৫ মে শুক্রবারের মধ্যে এই বিল হাউজে পাশের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে রিপাবলিকান শাসিত সিনেটে এখনও সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলে জানা গেছে। প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলসী এবং সিনেটে ডেমক্র্যাট-লিডার চাক শুমার সোচ্চার রয়েছেন রিপাবলিকানদের কনভিন্স করতে।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন