যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালিসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো পাসপোর্ট তৈরির ফিসহ অন্যান্য সার্ভিসগুলোর ক্ষেত্রে মানছে না সরকারের নির্ধারিত ফি রাখার নীতিমালা।
পশ্চিম ইউরোপের ১৩টি দেশে বাংলাদেশ হাইকমিশন, সহকারী হাইকমিশন, দূতাবাস, কনস্যুলেট অফিস মিলিয়ে ১৬টি প্রতিষ্ঠান। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেবা দেওয়ার এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেবার মান নিয়ে যেমন নানা প্রশ্ন তেমনি সেবার জন্য যে ফি চার্জ করা হয়। সেই ফিতেও আবার রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য। একই সার্ভিসের জন্য একেক দেশে একেক ধরনের ফি চার্জ করা হচ্ছে।
ফি চার্জের ক্ষেত্রে অধিকাংশ দেশগুলোতে মানা হচ্ছে না সরকারি নির্দেশনা। বিশেষ করে এমআরপি পাসপোর্টের ক্ষেত্রে অর্ডিনারি সার্ভিসের জন্য সরকারের নির্ধারিত ফি হচ্ছে ১০০ ইউএস ডলার বা সেই দেশের সমপরিমাণ অর্থ। ২০১০ সালে এই প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট সেই প্রজ্ঞাপনটি আবারও হালনাগাদ করা হয়। বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর অর্ডিনারি পাসপোর্টের জন্য চার সপ্তাহ ও ১০০ ডলার নির্ধারণ করা হলেও যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনে চার্জ করা হয় ৯২ পাউন্ড যা প্রায় ১৩০ ইউএস ডলার। অস্ট্র্রিয়া এবং সুইডেনে ১১০ ইউরো বা ১৩০ ইউএস ডলার চার্জ করা হয়। ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল, ইতালি, স্পেন, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসে চার্জ করা হয় ১০০ ইউরো যা প্রায় ১২০ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। বাকি সবগুলো দেশ স্টুডেন্টদের এমআরপি পাসপোর্টের জন্য ৩০ ইউরো চার্জ করলেও জার্মানিতে সেটা ৩৫ ইউরো। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াতে রাখা হয় ১১০ ইউএস ডলার, কানাডাতে রাখা হয় ১২০ ইউএস ডলার।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বাংলাদেশ দূতাবাসের ওয়েবসাইট তো খুলেই না। অথচ এই দূতাবাসটি ইউএনের স্থায়ী মিশন। মিশনের হিসাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইউরোপে একমাত্র বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া ফি চার্জেও গাইডলাইন মেনে চলছে গ্রিস। গ্রিসে চার্জ করা হয় ৮৫ ইউরো বা ১০০ ইউএস ডলার। আবার ডেনমার্কে চার্জ করা হয় সরকারের দেওয়া নির্ধারিত ফি থেকে কম। মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের জন্য ডেনমার্কে চার্জ করা হয় ৭৭০ ক্রনার বা ৯০ ইউএস ডলার। এর মধ্যে স্পেন ১ জুলাই পর্যন্ত ১১০ ইউরো বা ১৩০ ইউএস ডলার চার্জ করলেও দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে ফির চার্টের জন্য ফোন করার পর মাদ্রিদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রধান এটিএম আবদুর রউফ মণ্ডল বলেন, তারা ফি নিয়ে কাজ করছেন, এর ৪ ঘণ্টা পর স্পেন সময় সন্ধ্যা ৬টা ৫৩ মিনিটে একটি চার্ট পাঠান যেখানে উল্লেখ করা হয়, ২ জুলাই থেকে নতুন ফি কার্যকর করা হবে। নতুন ফি যেটি নির্ধারণ করা হয়েছে সেটাও সরকারের নির্ধারিত ফির চেয়ে ২০ ডলার বেশি।
ট্রাভেল ডকুমেন্টসেও রয়েছে অর্ডিনারি সার্ভিসে ১২ ইউএস ডলার থেকে ৩৫ ইউএস ডলার পর্যন্ত চার্জ করা হয়। যুক্তরাজ্যে চার্জ করা হয় ২৫ পাউন্ড বা ৩৫ ডলার। বাংলাদেশ সরকারের নীতিমালা হচ্ছে অর্ডিনারি সার্ভিসের জন্য ১০০০ টাকা বা ১২ ইউএস ডলার বা স্থানীয় দেশের মান অনুযায়ী রাখতে হবে। একইভাবে পাওয়ার অব অ্যাটর্নিতেও রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য। গ্রিসে চার্জ করা হয় সর্বনিম্ন ১০ ইউরো আর কোনো দেশ ২০, ২৫, ৩০ ইউরো করেও চার্জ করছে। এতো গেল ফিসের তারতম্যের কথা।
সার্ভিসেও রয়েছে নানা পার্থক্য। অর্ডিনারি পাসপোর্টের জন্য একেক বাংলাদেশ মিশনে একেকটি সময় দেওয়া আছে। কোনো দেশে ন্যূনতম ৪ সপ্তাহ আবারও কোনো দেশে সেটা ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত বলা হয়েছে। পাসপোর্ট ছাড়াও ভিসা, নো ভিসা সিল, ট্রাভেল পারমিট, কাগজ সত্যায়ন, পাওয়ার অব অ্যাটর্নিসহ নানা সার্ভিসেও রয়েছে এমন দৃশ্যমান পার্থক্য। ফি, সময়সীমার যেমন পার্থক্য রয়েছে, ঠিক তেমন পার্থক্য রয়েছে সার্ভিসে। ইতালির মিলান কনস্যুলেট অফিসে খোদ কনসাল জেনারেলের নেতৃত্ব নিরাপত্তাকর্মী হাবিব ও পরিচ্ছন্নকর্মী হাবিবের সিন্ডিকেট বাণিজ্য ও প্রবাসী যুবককে মারধরের অভিযোগ নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের করা প্রতিবেদনের পর চলছে তদন্ত!
অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন-আয়েবার মহাসচিব কাজী এনায়েত উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইউরোপের খেটে খাওয়া মানুষের জন্য ২০/৩০ ডলার অনেক টাকা। একেক দেশে একেক ফি এটা কাম্য নয়। হয় একেক দেশের ইনকামের ওপর ভিত্তি করে ফি নির্ধারণ করা যেতে পারে, যেমন: পর্তুগাল বা গ্রিসে একজন সারা মাসে যা ইনকাম করে ইউকে, স্পেন বা সুইডেনে তার চেয়ে অনেক বেশি ইনকাম। সেভাবে ফি নির্ধারণ করা যায়, অথবা বাংলাদেশ সরকারের নির্ধারিত ফি অবশ্যই ফলো করা উচিত।
যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম যুক্তরাজ্য মিশনে ফি রাখা সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন বাংলাদেশ সরকারের নির্ধারিত নীতিমালা এবং ফি অনুসরণ করে এবং তাতে যুক্তরাজ্যে পাসপোর্ট আবেদন প্রসেসিং সংক্রান্ত বিভিন্ন খরচ অন্তর্ভুক্ত করে বর্তমানের পাসপোর্ট ফি ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে যৌক্তিকভাবেই পুনর্নির্ধারণ করেছে। উল্লেখ্য, প্রতিবারেই প্রবাসী সেবাগ্রহীতাদের মতামত যাচাই করে পাসপোর্ট ফি পুনর্নির্ধারণ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ২০১৭ সালের আগে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে পাসপোর্ট ফি ৬৫ পাউন্ড ধার্য ছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের ব্রেক্সিট রেফারেন্ডামের ফলে ১০০ মার্কিন ডলারের বিপরীতে ব্রিটিশ মুদ্রার বিনিময় হার প্রায় ৮০ পাউন্ডে বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ও যুক্তরাজ্যের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সার্ভিস চার্জ বিবেচনায় এনে, হাইকমিশনের সংশ্লিষ্ট কমিটি কর্তৃক সেবাগ্রহীতাদের মতামত যাচাই করে কমিটির সুপারিশ মোতাবেক ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে পাসপোর্ট ফি পুনর্নির্ধারণ করে ৮২ পাউন্ডে ধার্য করা হয়।
যুক্তরাজ্য মিশনের প্রধান আরো বলেন, পরবর্তীতে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড আইন ২০১৮-এর ১৪(ঙ) ধারায় বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে আদায়কৃত কন্সুলার ফি-এর উপর ১০% হারে সারচার্জ-এর অর্থ ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিলে নিয়মিত জমা প্রদানের বিধান হওয়ায় বিগত ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাইকমিশনের সংশ্লিষ্ট কমিটি ১০% সারচার্জ ও ব্যাংক সার্ভিস চার্জ বিবেচনায় নিয়ে পুনরায় সেবাগ্রহীতাদের মতামত যাচাই করে পাসপোর্ট ফি ৯২ পাউন্ড-এ পুনঃনির্ধারণ করে।
তবে যুক্তরাজ্য মিশন খুব শিঘ্রই পাউন্ড ও ডলারের দামের উপর ভিত্তি কওে নতুন করে ফি তৈরি করার জন্য কাজ করে যাবে বলে নিশ্চিত করেছেন সাইদা মুনা তাসনিম।
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত