১২ আগস্ট, ২০১৭ ১০:১৩

রাস্তায় 'ওয়াই-ফাই জোন' মানেই স্কুলগামীদের বিপথগামী করা

মু. তৌহিদুল ইসলাম

রাস্তায় 'ওয়াই-ফাই জোন' মানেই স্কুলগামীদের বিপথগামী করা

প্রতীকী ছবি

আঞ্চলিক একটি কথা আছে, 'মাগনা গরুর দাঁত নাই।' আসলে এই কথাটির মাধ্যমে যা বোঝানো হয়েছে তা হলো, ফ্রি জিনিসের মূল্য নেই, স্থায়িত্ব নেই, ফ্রি জিনিস অপব্যবহার হয় বেশি, এর প্রতি মায়া থাকে কম, ফ্রি জিনিস শেষ হয়ে যায় দ্রুত। পক্ষান্তরে মূল্য দিয়ে কেনা জিনিস আমরা খুব ভালোভাবে ব্যবহার করি বা যত্ন করি। কারণ এটা পরিশ্রমলব্ধ, শ্রম ও রক্তের দামে কেনা। বড়লোক বাবার ছেলেরা দেখা যায় প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা খরচ করে, এটা সে পারে কারণ এই টাকা তার পরিশ্রম করে পাওয়া নয়। নিশ্চয়ই তার বাবা টাকা এভাবে দুই হাতে উড়ায় না।

একদিন ঢাকার পাশ্ববর্তী একটি জেলায় আমি একটি আবাসিক এলাকার রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, কিছু ছেলে কোনায়-কানায় বসে আছে, কারো কারো কাঁধে স্কুল ব্যাগ। আমি ভেবেছিলাম হয়তো আশপাশে কোচিং সেন্টার আছে। আমার সাথে থাকা বন্ধুটি বললো, এই এলাকাটিতে ওয়াই-ফাই সুবিধা আছে। এবার বুঝলাম ব্যাপারটা। আচ্ছা যে সকল ছেলেরা এখানে বসে মোবাইল চালাচ্ছে আমরা কি হলফ করে বলতে পারি সবাই মোবাইলে পড়ালেখা করছে বা পড়ালেখা সংশ্লিষ্ট কাজ করছে? আমার মনে হয় এটা কেউ বলবে না। কারণ ফ্রি ওয়াই-ফাই দিয়ে রাস্তার পাশে বসে স্কুলগামি ছেলেরা মোবাইলে পড়ালেখা করবে এটা কল্পনা ছাড়া আর কী হতে পারে! এখন আমার প্রশ্ন এই এলাকায় ফ্রি ওয়াই-ফাই এর সুবিধা দেয়ার দরকারটা কী? যদি আমরা ধরি আশেপাশে কোন গুরুত্বপূর্ণ (ঐ এলাকাটি আবাসিক ছিল) অফিস আছে তাহলে তো ব্রডব্যান্ড দিয়েও কাজ করা যেতো। এভাবে ওয়াই-ফাই জোন করে দেয়া মানে তো স্কুলগামী ছেলেদের বিপথগামী করা! তাদের অবসর সময়টাকে নষ্ট করা, এলাকার পরিবেশ নষ্ট করা।

একটা সময় মুরব্বী বা শিক্ষিতজনরা সাইবার ক্যাফের বিরুদ্ধে খুব বলতেন। আমাদের মনে আছে বিভিন্ন জায়গায় আমরা টিচার বা সমাজের সচেতন মানুষের মুখ থেকে এ বিষয়ে উদ্বেগের কথা শুনেছি। তারা এ বিষয়ে প্রশাসনের হস্তুক্ষেপও কামনা করতেন। স্কুল ড্রেস পড়ে কেউ যেনো সাইবার ক্যাফেতে না যায় সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে বলতেন। কিন্তু এখন আর এটা শোনা যায় না কারণ আমরা এটাকে নিয়ে এসেছি ঘরের ভেতর! এখন আর টাকা খরচ করে সাইবার ক্যাফেতে যাওয়া লাগে না। এখন ঘরের ভেতরে, রাস্তায়, ফাস্ট ফুড, হোটেল, শপিং মল ইত্যাদি সব জায়গাকেই আমরা সাইবার ক্যাফে বানিয়ে রেখেছি। এখন শিশু বা স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা অবসর সময় কাটায় ফাস্টফুডের দোকানে গিয়ে অথবা যেখানে ওয়াই-ফাই সুবিধা আছে সেখানে। সেসব জায়গাতে অযথা সময় নষ্ট করছে। যখন পড়ালেখা বা সৃষ্টিশীল কাজ করার কথা সে সময়টায় তারা মোবাইলে বুদ হয়ে থাকছে। 

গত ১০ আগস্ট’১৭ একটি জাতীয় দৈনিকে (প্রথম আলো) ঢাকার ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের একটি ছোট সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। সেখানে এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “ওয়ার্ডের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ফ্রি ওয়াইফাইয়ের ব্যবস্থা করা হবে।” গুরুত্বপূর্ণ স্থান আর অফিস আলাদা বিষয়। আমরা জানি সরকারী সকল গুরুত্বপূর্ণ অফিসে ইন্টারনেট সুবিধা আছে বা কাজের জন্যই থাকতে হবে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ স্থান মানে আসলে কী? এটা যদি কোন এলাকা, পার্ক বা দর্শনীয় স্থান হয় তাহলে আমাদের প্রশ্ন এর প্রয়োজন কতুটুকু? কেন গুরুত্বপূর্ণ স্থানকে ওয়াই-ফাই জোন করা হবে। এতে কী লাভ? আমরা উদ্বেগের সঙ্গে বলতে পারি, এটা শিক্ষার্থীদের অযথা সময় কাটানোর ও মোবাইলে অপ্রয়োজনীয় কাজ করার সুযোগ করে দেয়া ছাড়া আর কিছুই নয়! যদি শিক্ষার্থীদের ভালোর জন্য এটা করার উদ্যোগ নেয়া হয়ে থাকে তাহলে অন্য ব্যবস্থা করা হোক। কিন্তু আমাদের আগামী প্রজন্মকে ভার্চুয়াল জগতের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা করা দরকার। এ ব্যাপারে অভিভাবক ও প্রতিটি পরিবারকেই সচেতন হতে হবে। 

এখন অনেক বাসায় ওয়াই-ফাই সুবিধা আছে। আপনি বলতে পারেন, ওয়াই-ফাই আছে কিন্তু শিক্ষার্থীদের পাসওয়ার্ড দেয়া হয়না। আপনাকে বলতে চাই এখনকার শিশুরা অনেক আপগ্রেড তাদের জন্য ওয়াই-ফাইয়ের পাসওয়ার্ড বের করা মামুলী ব্যাপার! আমি এমন অনেক ছেলেকে জানি যারা এসব বিষয়ে খুবই দক্ষ। তার মানে আমার ধারনা অনেক ছেলেরাই এ বিষয়ে দক্ষ। তারপরও যদি বাসা বা এলাকায় পাসওয়ার্ড না জানান তাহলে তো ভবিষ্যতে এমনও হতে পারে, একদিন সকালে পত্রিকার পাতা খুলে আমরা দেখবো ওয়াই-ফাই এর পাসওয়ার্ডের জন্য বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া রক্তারক্তি/পাসওয়ার্ড না দেয়ায় বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন/এলাকার জনপ্রতিনিধি লাঞ্চিত। আবার এমনও হতে পারে পাসওয়ার্ডের কারণে ছেলের হাতে মা-বাবা/ভাই-বোন খুন! বিষয়টি সবাইকে ভাবার অনুরোধ।

লেখক: শিশু সংগঠক, কাউন্সিলর, বাংলাদেশ শিশুকল্যাণ পরিষদ, ঢাকা।

বিডি প্রতিদিন/১২ আগস্ট ২০১৭/হিমেল

সর্বশেষ খবর