একথা বহু পুরনো যে, শিক্ষকরা জাতি গঠনের কারিগর। এরাই গড়ে দেন সমাজের মূল ভিত। সমাজের আয়নায় প্রতিফলিত হয় রাষ্ট্র। কোনো কিছু দৃশ্যমান হবার জন্য আলো অপরিহায্য। আলোর ধর্ম অন্ধকারের পানে যাওয়া। আবার কিছু আলো প্রগাঢ় অন্ধকারের ভেতর ফিনিক হয়ে ফোটে। ড. আসিফ নজরুলের মত এমনই কিছু আলোর ফুলকি দেখলো তারুণ্য। এমন অনেক ছাইচাপা আগুনও দেখেছি। বাস্তবতার নিরীখে যা আলো হতে পারেনি। এ দায় কার?
শিক্ষার্থীদের জন্য বিষয়টা যতটা সাদাকালো, শিক্ষকদের জন্য ততটা নয়। ব্যক্তি পর্যায়ে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না থাকলেও শিক্ষকরা একটি প্রশাসনিক কাঠামোর অধীনে কাজ করেন। ফলে, তাদের অনেক সময় প্রশাসনের আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হয়। যদিও সেই আদেশ-নিষেধগুলো তাদের নৈতিক বা আদর্শিক মূল্যবোধের পরিপন্থী হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, একজন শিক্ষক চাইলেও তার অবস্থান স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। শুনতে অযুহাতের মতো হলেও এই পরিস্থিতির হাতে অনেক শিক্ষকই বন্দী।
এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আদর্শিক যোগ্যতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে মেধার তুলনায়। ফলে শিক্ষকগণ এমন পরিবেশ পাননি, যেখানে তারা স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করতে পারেন।
তরুণ প্রজন্মের দায়িত্ব হলো- এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা যাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সরকার বা রাজনৈতিক প্রভাবে শিক্ষকদের মেরুদণ্ড বাঁকা না হয়। বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে নতুন দিনের সূচনা করেছে তারুণ্য। এখন শিক্ষক-ছাত্র মিলে দেশ গড়ার সময়। শিক্ষকদের অসম্মান কিংবা বয়কট করে দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষকদের যথাযথ দায়িত্বপালনের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এই তরুণ প্রজন্মকেই।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক হিসেবে একজন ব্যক্তির জন্য সমাজে তার অবস্থান সব সময় চ্যালেঞ্জের মুখে থাকে। একদিকে তাকে জ্ঞান বিতরণের গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয়, অন্যদিকে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক চাপের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হয়। আদর্শ ও নৈতিকতার সাথে আপোস না করেই ছাত্রদের জন্য সর্বোত্তম শিক্ষাদানের চেষ্টা করতে হয়। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং প্রশাসনিক চাপের কারণে অনেক শিক্ষকই বাধ্য হন তাদের আদর্শের সাথে আপোস করতে।
বিধি অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবার কথা পুরোপুরি মেধা ও গবেষণায় যোগ্যতার ভিত্তিতে। কিন্ত বাস্তবে প্রাধান্য পাচ্ছে রাজনৈতিক মতাদর্শ। ফলে ওইসকল শিক্ষক রাজনৈতিক গণ্ডির বাইরে গিয়ে নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেননি। এই বাস্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে চলমান বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলন। চোখের সামনে শিক্ষার্থীদের উপর বর্বরতা দেখেও পাশে দাঁড়ানোর সাহস পাননি কিছু শিক্ষক। একই কারণে কিছু শিক্ষক মুখ খোলেননি। তবে কিছু শিক্ষক নিরব থেকেও শিক্ষার্থীদের নৈতিক সমর্থন জানিয়ে গেছেন।
কতিপয় শিক্ষক ব্যক্তিগত লাভের জন্য প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক প্রভাব মেনে নেন। যা পুরো শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর। এ পরিস্থিতিতে, শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যেখানে শিক্ষকরা স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
শিক্ষার্থীদের উচিত শিক্ষকদের সম্মান করা, তাদের পাশে দাঁড়ানো। শিক্ষকদের অসম্মান বা বয়কট করে কোনো আন্দোলন সফল হতে পারে না। বরং শিক্ষকদের সাথে মিলিত হয়ে তাদের সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
শিক্ষকদের সম্মান ও সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ ফেরানো জরুরি। তারুণ্যের প্রতি আহ্বান, এজন্য যা করা দরকার এখনই করুন। যাতে আমরা একটি উন্নত ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তুলতে পারি,
লেখক: পিএইচডি গবেষক, জাপান।
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত