৯ এপ্রিল, ২০১৯ ১৬:৪৯

এই এন্টিবায়োটিক ছাড়া আমাদের চলচ্চিত্রের রোগমুক্তি অসম্ভব

শিমুল খান

এই এন্টিবায়োটিক ছাড়া আমাদের চলচ্চিত্রের রোগমুক্তি অসম্ভব

আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে প্রাণের ঢাকাই বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাহমান সংকট ও চিরস্থায়ীভাবে এর থেকে উত্তরণের উপায়-

উপস্থিত ২০১৯ সালে বিশ্ব চলচ্চিত্র ক্রমান্ব‌য়ে আরও বেশি এবং বিশালাকৃতি নিয়ে বিস্তৃতি লাভ করে চলেছে। যেমন হলিউডের চলচ্চিত্র সারাবিশ্বে ১০.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, চীনের চলচ্চিত্র ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ভারতের চলচ্চিত্র ২.৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, জাপানের চলচ্চিত্র ২.২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ চলচ্চিত্র ১.৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, কোরিয়ান চলচ্চিত্র ১.৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ফ্রান্সের চলচ্চিত্র ১.১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, জার্মানির চলচ্চিত্র ১.১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, অস্ট্রেলিয়ার চলচ্চিত্র ৯১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, এমনকি মেক্সিকোর চলচ্চিত্র ৮৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার নিয়ে সারাবিশ্বে তাদের সিনেমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এবং দিন যত যাচ্ছে তাদের সবার চলচ্চিত্র ব্যবসাই সারাবিশ্বে আরও শক্ত এবং বৃহৎ আকার ধারণ করছে।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সিনেমার বাজার আগেই উল্লেখ করেছি কিন্তু মজার এবং অবাক করা বিষয় হচ্ছে- ভারতের তামিল, তেলেগু, মালায়ালাম কিংবা কানাড়া ভাষায় নির্মিত আঞ্চলিক সিনেমাগুলোও বিশ্বের বহু দেশে বর্তমানে চুটিয়ে ব্যবসা করছে এবং দিনের পর দিন তারা তাদের আঞ্চলিক ভাষার চলচ্চিত্রকে বিভিন্ন ভাষায় ডাবিং এবং সাবটাইটেল যুক্ত করে আরো আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করে ক্রমান্বয়ে তাদের বাজার বিশ্বব্যাপী আরো বিস্তৃত করে চলেছে। অথচ ১৮ কোটি জনগণের দেশ বাংলাদেশ, আর সেই দেশেরই চলচ্চিত্র শিল্প দীর্ঘ ৫০ বছর পেরিয়েও বিলিয়ন-মিলিয়ন মার্কিন ডলারতো অকল্পনীয় কথা, দেশী টাকায় সারা বছরে সামান্য ১০ কোটি টাকার বাজারটাও তৈরি করতে পারেনি! উল্টো দেশের চলচ্চিত্র শিল্পটি দিনের পর দিন নিজের সাথে নিজেই মারাত্মক যুদ্ধ করে আজ প্রায় মুমূর্ষু অবস্থায় যেন অনুন্নত কোনো হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।

এমতাবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশি চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে জড়িত সকল শিল্পী এবং কলাকুশলীরা সবসময়ই তাদের সিনেমা শিল্পের উদ্ভূত চরম সংকটের উত্তরণ বিষয়ে নানা সময়ে নানারকম দাবি ও আন্দোলন করে যাচ্ছে শুধু সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের নিমিত্তে। কখ‌নো পুরো ইন্ডাস্ট্রি প্রায় এক দলে দলবদ্ধভাবে আবার কখ‌নো কখনো পুরো ইন্ডাস্ট্রি কয়েক দলে বিভক্ত হয়ে। কিন্তু ঢাকাই চলচ্চিত্র শিল্পের একজন পেশাদার অভিনেতা হিসেবে অতি ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আমরা এযাবতকালে শুধু উপস্থিত সমস্যা নিয়েই চিৎকার-চেঁচামেচি করেছি।

কিন্তু সবসময়ই আমরা আমাদের সুদূরপ্রসারী চিন্তাচেতনা ও কর্মপরিকল্পনা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছি। কারণ সিংহভাগ সময়ই আমরা শুধু আমাদের চলচ্চিত্রের উপস্থিত সমস্যা সমাধানেরই চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং কখনোই আমাদের চলচ্চিত্র নিয়ে আমরা সুদূরপ্রসারী কোনো সময়োপযোগী বিশ্বমানের উন্নয়নমূলক কর্মপরিকল্পনা এখন পর্যন্ত সরকারের কাছে সম্ভবত আমরা উপস্থাপন করতে পারিনি। এই ধরুন সারাবিশ্বের অনেক পরে এসে যেমন, ২০১০ সালে ডিজিটাল ফরম্যাট আসার পর থেকে এতদিন পর্যন্ত এইচডি রেজুলেশনে সিনেমা প্রদর্শনের পর এই এতদিনে এসে আমরা সারাদেশে প্রচুর সিনেপ্লেক্স চাচ্ছি সরকারের কাছে তাও আবার অন্তত 2K রেজুলেশনের! যেখানে উন্নতবিশ্বে বহু আগে থেকেই 4K রেজুলেশনে সিনেমা প্রদর্শন চলছে এবং খুব শীঘ্রই হয়তো 6K চালু হয়ে যাবে।

যথারীতি সবসময়ই সরকার সারাদেশে সিনেপ্লেক্স বানিয়ে দেয়ার ওয়াদাও করছে, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমরা সারাদেশে সরকারি উদ্যোগেই কয়েকশত সিনেপ্লেক্স পেয়ে যাবো! কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে- এতগুলো সিনেপ্লেক্স বাণিজ্যিক সফলতার সাথে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখার জন্য দরকার নিয়মিতভাবে পর্যাপ্ত মানসম্মত রুচিশীল সিনেমা নির্মাণ। অথচ মানসম্মত রুচিশীল সিনেমা নিয়মিত নির্মাণের জন্য আমাদের দরকার বিপুল সংখ্যক সুশিক্ষিত, সৃজনশীল, মানসম্মত, উদ্যমী শিল্পী এবং কলাকুশলী! কিন্তু আমাদের কি তা আছে...? না, নেই।

কাজেই সরকার আমাদের সারাদেশে প্রচুর সিনেপ্লেক্স বানিয়ে দিলেও আদতে মানসম্মত, রুচিশীল সিনেমা নিয়মিত নির্মাণ, সরবরাহ ও যোগান না দিতে পারার অপরাধে অদূর ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই আবারো মহাসংকট ও হুমকির মুখে পড়ে যাবে ঢাকাই বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প। তখন বরাবরের মতো আবারো হল মালিকদের পক্ষ থেকে হিন্দি সিনেমা আমদানী করে সিনেমা হল শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার দাবি উঠবে। তারপর আবারো বর্তমানের মতো সেই অযৌক্তিক আন্দোলন ডাকা হবে! কারণ আমরা বরাবর জ্বর সর্দিকাশির জন্য প্যারাসিটামল খেয়েই হাফ ছেড়ে বাঁচতে চাই কিন্তু আমাদের শরীরে অর্থাৎ ঢাকাই বাংলা চলচ্চিত্রের শরীরে ক্যানসারের মতো মরণব্যাধি যাতে আঘাত করে আমাদেরকে শেষ না করে দিতে পারে সেই ব্যবস্থাটা করি না। এরপর আসি প্রযোজক এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে। কারণ প্রযোজক ও বিনিয়োগকারী না বাঁচলে কখনোই চলচ্চিত্র শিল্প বাঁচবে না।

কাজেই প্রযোজক বাঁচানোর জন্য ই-টিকেটিং সহ প্রতিটি টিকেট থেকে যৌক্তিক হারে প্রযোজকের পকেটে অর্থ ফেরত নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই প্রতিটি প্রযোজক ন্যুন্যতম একটা অর্থপ্রাপ্তির মাধ্যমে পরবর্তী সিনেমায় লগ্নি করতে উৎসাহিত হবে এবং এভাবেই একের পর এক লগ্নি হলে বাড়বে সিনেমার সংখ্যা এবং বাজেট আর তখনই সুষম পরিবেশ বজায় থাকবে। আর সেইসাথে সুষ্ঠু একটি চলচ্চিত্র শিল্প প্রতিষ্ঠিত হবে। অথচ সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের কাছে বরাবরই প্রযোজকের মুনাফার স্বার্থটি অগ্রাহ্যই থেকে গেছে।

পরিশেষে- সারাদেশে সিনেপ্লেক্স নির্মাণ এবং প্রযোজকের স্বার্থ রক্ষা করার চেয়েও অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী বিষয়টি বহুবারের মতো আমি আবারো সবার সামনে যৌক্তিক দাবি হিসেবে তুলে ধরতে চাই আর তা হলো- বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের একটি সুবিশাল ফিল্ম একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা খুব বেশি জরু‌রি। কারণ চকচকে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রেস্টুরেন্ট খুলে বসলেই কিন্তু ব্যবসা হয় না, দরকার হয় সেখানে খাবারের সুন্দর এবং স্মার্ট পরিবেশন এবং তার চেয়েও মূল্যবান বিষয় সুস্বাদু খাবার রান্না করা, আর সুস্বাদু খাবার রান্নার জন্য অবশ্যই  দরকার হয় একজন সুদক্ষ, দুর্দান্ত বাবুর্চির। সেইসাথে যোগান দিতে হয় উপযুক্ত মাল-মশলা ও রান্নার প্রয়োজনীয় উপকরণাদী। কাজেই শুধুমাত্র সিনেপ্লেক্স নির্মাণ আর প্রযোজকের স্বার্থ দেখলেই এদেশে নিয়মিত মানসম্মত আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র নির্মাণ হবে না! কারণ রুচিশীল, মানসম্মত এবং আন্তর্জাতিক মানের ফিল্ম নির্মাণের জন্য দরকার হয় শিক্ষিত, উপযুক্ত, মানসম্মত, সু-প্রশিক্ষিত একঝাঁক শিল্পী ও কলাকুশলী। আর এই ফিল্ম একাডেমীর কাজই হবে নিয়মিত সেইমানের শিল্পী ও কলাকুশলী তৈরী করে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে নিয়মিত সরবরাহ করা। যাতে করে বিদেশ থেকে শিল্পী ও কলাকুশলী নিয়মিত ভাড়া করে আনতে না হয় মানসম্মত ফিল্ম নির্মাণের চরম অজুহাতে। আর সেইসাথে আমরাও অর্জন করবো আমাদের চলচ্চিত্রের কাঙ্ক্ষিত প্রকৃত চিরস্থায়ী স্বাবলম্বিতা। আর উক্ত আন্তর্জাতিক মানের ফিল্ম একাডেমী থেকেই হাতেকলমে পড়াশোনা ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়েই মূলত বেড়িয়ে আসবে একজন প্রোডাকশন বয়, প্রোডাকশন ম্যানেজার থেকে শুরু করে লাইন প্রোডিউসার, এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসার, গল্প ও চিত্রনাট্যকার, প্রোডাকশন ডিজাইনার, ভিএফএক্স আর্টিস্ট, ফিল্ম এডিটর, শিল্প নির্দেশক, ফাইট ডিরেক্টর, ডান্স কোরিওগ্রাফার, শব্দ গ্রাহক, আলোক নির্দেশক, চিত্রগ্রাহক, চলচ্চিত্র প্রযোজক, নির্মাতা, অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ পুরো ফিল্ম ইউনিট। ঠিক যেমনটি বের হয়ে আসে চলচ্চিত্রে উন্নত উপরোল্লিখিত দেশগুলো থেকে! আর সেইজন্য তারাই পারছে দিনের পর দিন বিশ্ব চলচ্চিত্রে তাদের বাণিজ্যিক ও শৈল্পিক অবস্থান আরো সুদৃঢ় করতে।

পরিশেষে শুধু এটুকুই শুধু বলতে চাই-

১। সিনেপ্লেক্স ২। প্রযোজকের স্বার্থ ৩। একটি আন্তর্জাতিক মানের ফিল্ম একাডেমী

উপরোল্লিখিত এই ৩ টি প্যাকেজ এন্টিবায়োটিকের একটিকে ছাড়াও আমাদের প্রাণের ঢাকাই বাংলা চলচ্চিত্রের চিরস্থায়ী রোগ মুক্তি অসম্ভব।
 
লেখক: পেশাদার চলচ্চিত্র অভিনেতা

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর