২৯ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:৫৮

দ্য স্টোরি অব থ্যাংকস গিভিং ডে!

রীতা রায় মিঠু

দ্য স্টোরি অব থ্যাংকস গিভিং ডে!

২০০১ সালে আমরা সবেমাত্র আমেরিকা এসেছি, প্লেন থেকে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া স্টেটেই প্রথম নেমেছি। আমাদের মেজো মেয়ে মিশা যে মিডল স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়েছিল, সেই স্কুলের মিউজিক টিচার ছিলেন মিসেস রজার্স। দশ বছরের মিশা ছিল ঐ স্কুলে একমাত্র বাঙালি (মিশার সাথে পরিচিত হওয়ার আগে ঐ স্কুলের কেউ তখনও বাংলাদেশ নামের দেশটির সাথে পরিচিত ছিল না।) মিশা খুব যে ভাল গান করতে পারতো তা নয়, কিন্তু মিশা খুব মিশুকে ছিল। টিচারদের প্রতি ছিল অগাধ শ্রদ্ধা, ব্যবহারে ছিল বাঙালি নমনীয়তা যা দেখে মিশাকে মিসেস রজার্সের খুব ভাল লাগে। মিশাকে কাছে ডেকে ওর বাবা-মা, ভাই-বোন সম্পর্কে, দেশ সম্পর্কে, দেশে ফেলে আসা আত্মীয় স্বজন সম্পর্কে নানা গল্প শুনতে চাইতো। বাংলাদেশ দেখতে কেমন, ওখানে সকলেই গান করে কিনা, নাচ করে কিনা, বাংলাদেশে ক্রিসমাস উৎসব হয় কিনা, এমন নানা কথা শুনতে চাইতো। মিশা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মাঝে মাঝেই বলতো যে, মিসেস রজার্স আমাদের সাথে পরিচিত হতে চায়।

তখন আমরা সবে দুই মাস হয় আমেরিকা এসেছি, আমেরিকার জলহাওয়ার সাথে পরিচিত হইনি, আমেরিকার জীবন, আমেরিকার সংস্কৃতি, আমেরিকার মানুষ, আমেরিকার উৎসব—কোন কিছু সম্পর্কেই তেমন কোন ধারণা হয়নি। এরমধ্যেই নভেম্বার মাসের চতুর্থ সপ্তাহে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঁচ দিনের ছুটি দেয়া হলো, উপলক্ষ থ্যাংকস গিভিং। আমার স্বামী এবং স্কুল পড়ুয়া দুই মেয়েও ছুটি পেলো। ওরা ছুটি পেয়েছে ঠিকই তবে ‘থ্যাংকস গিভিং’ উৎসব সম্পর্কে তখনও কিছুই জানে না। থ্যাংকস গিভিং যে নভেম্বার মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার হয়, সেটিও জানতাম না, শুধু এটুকু বুঝেছিলাম যে এটি একটি আনন্দোৎসব। থ্যাংকস গিভিং ডে’র দুপুরে আমাদের বাসার ফোনে একটি কল এলো, মিশা জানালো, মিসেস রজার্স ফোন করেছেন। আমি খুব হতচকিত হয়ে ফোন কানে দিয়ে হেলো বলতে ওপাশ থেকে অসম্ভব মায়াবী কন্ঠের এক নারী বললেন যে উনি থ্যাংকস গিভিং উপলক্ষে মিশার জন্য ‘সিনামোন রোল’ তৈরী করেছেন, আমি যদি অনুমতি দেই তবেই উনি সিনামোন রোল নিয়ে আমাদের বাসার দরজায় গাড়ি থামাবেন। এমন ধরণের ফোন কল আমি এর আগে কারো কাছ থেকেই পাইনি। কাউকে কিছু দিতে হলেও যে অভিভাবকের সম্মতি নিতে হয়, আমেরিকান এই সংস্কৃতির সাথে প্রথম পরিচিত হলাম মিসেস রজার্সের মাধ্যমে। আমি হ্যাঁ বলার তিন মিনিটের মধ্যেই দরজায় টোকা পড়লো, দরজা খুলতেই দেখলাম দারুণ রুপবতী এক নারীকে, হাতে সুদৃশ্য কাগজে মোড়ানো ট্রে, যার মোড়কের ফাঁকা দিয়ে দারুণ সুবাস বেরোচ্ছে। মিসেস রজার্স আমাদের সবাইকে হ্যাপী থ্যাংকস গিভিং ডে’র শুভেচ্ছা জানিয়ে সেদিনের মত বিদায় নিলেন।

এর পরের সপ্তাহে রজার্স দম্পতিকে আমাদের বাসায় ডিনারের নেমন্তন্ন করলাম। উনারা খুব খুশী, যথাদিনে রজার্স দম্পতি এলেন। মিসেস রজার্স অসম্ভব রূপবতী আর মিঃ রজার্সকে দেখামাত্র মনে হলো, একজন শুদ্ধ মানুষকে দেখছি। সেই থেকে রজার্স দম্পতির সাথে আমাদের আত্মার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেলো। আমরা ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া থেকে মিসিসিপি চলে এসেছি পনের বছর আগে। কিন্তু আঠারো বছর আগে আমেরিকায় আমাদের প্রথম থ্যাংকস গিভিং উৎসবে মিসেস রজার্স নামের অসাধারণ এক নারী ‘সিনামোন রোল’, কুকিজ, ফ্রুট কেক’ পাঠানোর যে রেওয়াজ চালু করেছিলেন, আজও তা অটুট এবং অক্ষুন্ন রয়ে গেছে। প্রতি বছর থ্যাংকস গিভিং সপ্তাহে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া থেকে বিশাল বড় এক প্যাকেট আসে, তার ভেতরে মিসেস রজার্সের স্বহস্তে তৈরী রকমারী সুস্বাদু খাবার।

এখন আমরা সকলেই জানি, থ্যাংকস গিভিং ডে আমেরিকার সবচেয়ে বড় দুটি উৎসবের একটি, অন্যটি ক্রিসমাস। আমরা তো বিশ্বাস করি, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার, তাই থ্যাংকস গিভিং উৎসবে আমরাও আনন্দ করি, উৎসবের আমেজে থাকি, একে অপরকে ‘হ্যাপী থ্যাংকস গিভিং’ বলে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি। রজার্স দম্পতীকে সবার আগে ‘হ্যাপী থ্যাংকস গিভিং ডে’ জানাই। সারা উত্তর আমেরিকায় আজ ধুমধামের সাথে পালিত হচ্ছে ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ উৎসব। দিনটি সরকারী ছুটির দিন। গত কয়েক শতক ধরে নভেম্বার মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার আমেরিকায় মহা সমারোহে থ্যাংকস গিভিং ডে উদযাপিত হয়, এ বছর ২৮শে নভেম্বার, বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ উৎসব। থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ উৎসবে মূলত পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবসহ সকলে একত্রিত হয়, একসাথে বসে খাওয়া-দাওয়া করে, জীবনের প্রতিটি সাফল্য, দেশ ও জাতির প্রতিটি সাফল্যের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপণ করে। 
উৎসব উদযাপনে এদেশে কারো ক্লান্তি আসে না। এক দুই দিনে উৎসবের রেশও কাটতে চায় না। বৃহস্পতিবার থ্যাংকস গিভিং ডে, পরের দিন শুক্রবার ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল’,পরের দুই দিন শনি আর রবি, সব মিলিয়ে চার দিন ছুটি পাওয়া যায়। আমেরিকানরা চারদিনের ছুটি খুব উপভোগ করে।। সাধারণ আমেরিকানদের অনেকেই থ্যাংকস গিভিং উৎসবের ইতিহাস জানে না। উৎসব কবে থেকে শুরু হয়েছে, কেনই বা উৎসবটির নাম থ্যাঙ্কস গিভিং ডে! তাদের কাছে থ্যাঙ্কস গিভিং মানে সবাই একত্র হওয়া, পরস্পর হ্যাপি থ্যাংকস গিভিং সম্ভাষণ জানানো, পরিবারের সকলে একসাথে বসে থ্যাংকস গিভিং ডিনার খাওয়া।

থ্যাংকস গিভিং ডে উৎসবের সূচনাঃ

১৬২০ সালের আগস্ট মাসে ‘মে ফ্লাওয়ার’ নামের এক মালবাহী জাহাজ ১০২ জন যাত্রী নিয়ে ইংল্যান্ডের সাউথ হ্যাম্পটন থেকে যাত্রা করেছিল। যাত্রীদের সকলেই ছিল ধর্মযাজক শ্রেনীর, যাদেরকে ইংরেজীতে ‘পিলগ্রিম’ বলা হয়। ইংল্যান্ডে বসবাসকালীন পিলগ্রিমগণ স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা করতে পারতো না, তাদেরকে সরকারী-বেসরকারী নানাবিধ বাধার সম্মুখীন হতে হতো। তাই নির্বিঘ্নে, একাগ্রচিত্তে ঈশ্বরের উপাসনা করার জন্য তারা একটি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বের হয়। তাদের প্রাথমিক গন্তব্য ছিল ভার্জিনিয়া কোস্ট, যেখানে আরও কিছু পিলগ্রিমের বসবাস ছিল। যাত্রা শুরুর দুই তিন মাস পর ‘মে ফ্লাওয়ার’ আমেরিকার মেসাচুসেটস বে তে এসে পৌঁছে। 

এই তিন মাসে যাত্রীদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ইংল্যান্ড থেকে যাত্রার শুরুতে তারা জানতো না জায়গামত পৌঁছুতে কতদিন লাগতে পারে। এত দীর্ঘ সময় লাগবে তা ধারণায় ছিলনা। দীর্ঘযাত্রার উপযোগী পোশাক-পরিচ্ছদ, পর্যাপ্ত পরিমান খাদ্য মে ফ্লাওয়ারে মজুত ছিলনা। ফলে যাত্রীদের অনেকেই বৈরী আবহাওয়ায়, অর্ধাহারে, অনাহারে অসুস্থ হয়ে পড়ে, জাহাজেই বেশ কিছু যাত্রীর মৃত্যু হয়। নতুন স্থানে পৌঁছে শীতের তীব্রতায় বাকী সকলেই অসুস্থ ও দূর্বল হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে জাহাজ মেসাচুসেটসেই যাত্রা বিরতি করে। যাত্রীদের সকলেই জাহাজ থেকে তীরে এসে নামে, শরীর সুস্থ হতে অনেক সময় লেগে যায়, তাদের ভার্জিনিয়া কোস্টে পৌঁছানোর পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়। নতুন আশা বুকে বেঁধে মেসাচুসেটসেই ওরা কলোনী গড়ে তোলে, যাকে বলা হয়ে থাকে প্লিমথ কলোনী।

শুরু হয় মুক্ত স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, ধর্মচর্চার স্বাধীনতা। শুরুতে তাদের অনেক কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়। নতুন দেশ, নতুন আবহাওয়া, শীতের তীব্রতায় প্রতিদিনই দুই একজনের জীবন সংকট দেখা দিতে থাকে। কেউ কেউ মারাও যায়। শীত পেরিয়ে যখন বসন্তের আগমন ঘটে, বেঁচে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা দেয়। বেঁচে থাকার তাগিদে নতুন উদ্যমে তারা ধীরে ধীরে ঘর-বাড়ি বানাতে শুরু করে, আশেপাশের স্থানীয় ইন্ডিয়ান উপজাতিদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে, উপজাতিদের কাছ থেকে পাওয়া সাহায্য নিয়ে চাষ-বাস শুরু করে। এরপর উপজাতিদের সাথে উৎপাদিত দ্রব্য বিনিময় প্রথা চালু হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে প্লীমথ কলোনী বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। ১৬২১ সালের নভেম্বার মাসে প্লিমথবাসী প্রথমবারের মত নিজেদের উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলে। ফসলের মধ্যে ভুট্টার ফলন এত বেশী ভালো হয়েছিল যে তৎকালীন গভর্নর উইলিয়াম ব্র্যাডফোর্ড এই উপলক্ষে সমস্ত ইন্ডিয়ান উপজাতি এবং প্লি্মথ কলোনিবাসীদের সৌজন্যে ‘ফিস্টি’ আয়োজন করেন।

ফিস্টির দিনটিকে ঈশ্বরের নামে উৎসর্গ করা হয়েছিল। সকলেই কৃতজ্ঞ চিত্তে ঈশ্বরকে স্মরণ করে, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায়, তারা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বরের কৃপায় তারা বেঁচে আছে, প্রভুর দয়ায় তাদের সকলের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, পতিত বন্যভূমিকে সকলে মিলে বাসযোগ্য কলোনি হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছে, ঈশ্বর কৃপা করেছেন বলেই উৎপাদিত ফসলে তাদের গোলা ভরে উঠেছে, ফসলের ফলন এত বেশী হয়েছে যে আগামী শীত কেটে যাবে কোন খাদ্য ঘাটতি ছাড়া। ঈশ্বরের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন শেষে নিজেদের মধ্যে ধন্যবাদ বিনিময় হয়, খাওয়া দাওয়া হয়, সকলে মিলে আনন্দ-ফূর্তিতে কাটিয়ে দেয় একটি দিন। পরস্পর-পরস্পরে ধন্যবাদ বিনিময়ের সেই দিন থেকেই অনুষ্ঠানটি আমেরিকার সর্ব প্রথম ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। প্লীমথ কলোনিবাসীর দেখাদেখি থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উদযাপনের এই রীতি অন্যান্য কলোনিবাসীদের মাঝে প্রচলিত হতে থাকে। তবে বছরের নির্দিষ্ট দিনে তা পালিত হতো না। কলোনিবাসীদের নিজেদের সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী তারা বছরের একটি দিন থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উদযাপন করতো।

সরকারীভাবে সর্ব প্রথম ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ উদযাপিত হয়েছিল নিউইয়র্কে, ১৮১৭ সালে। এরপর থেকে প্রতি বছর অন্যান্য স্টেটেও উৎসবটি পালিত হতে থাকে। প্রথমদিকে নিউইয়র্ক এবং অন্যান্য স্টেটে দিনটি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষিত ছিল। পরবর্তীতে সকল স্টেট থেকে থ্যাঙ্কসগিভিং ডে’কে জাতীয় ছুটির দিন ঘোষণা করার পক্ষে জোর দাবী উঠতে থাকে।

১৮২৭ সালে বিখ্যাত নার্সারী রাইম ‘মেরি হ্যাড আ লিটল ল্যাম্ব’ রচয়িতা সারাহ যোসেফা প্রথম উদ্যোগ নেন, দীর্ঘ ৩৬ বছর তিনি পত্র-পত্রিকায় আর্টিক্যাল, এডিটোরিয়েল লিখাসহ এই আবেদনের সপক্ষে প্রচুর চিঠিপত্র গভর্নর, সিনেটর, প্রেসিডেন্ট, রাজনীতিবিদদের কাছে পাঠিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত ১৮৬৩ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, সারাহ যোসেফের আবেদন খুব গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেন এবং ‘সিভিল ওয়ার’ চলাকালীন সময়েই জনগণের উদ্দেশ্যে আবেদনমূলক ঘোষনা দেন, সকলেই যেন পরম করুনাময় ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা জানায়, “হে ঈশ্বর! তোমার স্নেহের পরশ, অপার করুণা তুমি তাদের উপর বর্ষণ করো, যারা গৃহযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যে নারী স্বামী হারিয়েছে, যে সন্তান পিতৃহারা হয়েছে, যে মা সন্তান হারিয়েছে, যা ক্ষতি সমস্ত জাতির হয়েছে, সমস্ত ক্ষতি যেনো দ্রুত সারিয়ে তোলা যায়। জীবিত সকলের যেন মঙ্গল হয়’। একই বছর প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন নভেম্বার মাসের শেষ বৃহস্পতিবার ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ হিসেবে সরকারী ছুটির দিন ঘোষনা করেন। পরবর্তীতে, বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা শুরু হয়। ‘গ্রেট ডিপ্রেশান’ হিসেবে পরিচিত অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠার লক্ষ্যে ১৯৩৯ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট রিটেল সেল বাড়ানোর ঊদ্দেশ্যে এই ছুটি এক সপ্তাহ এগিয়ে আনার ঘোষনা দেন, এবং সেই থেকে শেষ বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে নভেম্বার মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ পালিত হয়।

থ্যাংকস গিভিং ডে’ উদযাপন! 

অতি গুরুত্বপূর্ণ ছুটির দিনটির দুপুরে পরিবারের সকলে একসাথে খাওয়া দাওয়া করে, দুপুরের খাবার হলেও বলা হয় ‘থ্যাংকস গিভিং ডিনার’। থ্যাংকস গিভিং ডিনারে মূল আকর্ষণীয় আইটেম ‘টার্কি রোস্ট, ক্র্যানবেরী সস, এবং পামকিন পাই’। একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, থ্যাংকস গিভিং উৎসবে কেন সকলেই টার্কি রোস্ট এবং পামকিন পাই খায়! ধারণা করা যায় যেহেতু এই উৎসব শুরু করেছিল ইউরোপ থেকে আগত পিলগ্রিম এবং আমেরিকান ইন্ডিয়ানরা। নভেম্বরে ফসল তোলার মৌসুমে তারা ‘নবান্ন উৎসবের’ মত থ্যাংকস গিভিং উৎসব পালন করতো। উৎসব উপলক্ষে উপাদেয় খাবারের আয়োজন করতো নিশ্চয়ই। খাবার সংগ্রহ করার জন্য বনে বাদাড়ে ঘুরতো, পাখি পশু শিকার করতো। 

এই ঋতুতে বক্নে বাদারে প্রচুর টার্কি দেখা যায়। টার্কি হচ্ছে ময়ূরের মত দেখতে কিন্তু ময়ূর নয়, বনমোরগ কিনা জানিনা, হলে হতেও পারে। টার্কি শিকার করে টার্কির মাংস দিয়ে উৎসব করতো। শীতের শুরুতে জমিতে কুমরোর ফলনও খুব ভাল হয়। শীতের শুরুতেই কুমড়ো পাকে, তাই হয়তো থ্যাংকস গিভিং উৎসবে পাকা কুমড়ো দিয়ে ‘পামকিন পাই’ বানানোর এই রীতি তখনই চালু হয়। যে কোন রীতি একবার শুরু হলে প্রচলিত ধারায় তা চলতে থাকে যুগের পর যুগ, সাথে আরও নতুন রীতি যোগ হতে পারে, কিন্তু আদি রীতি একেবারে হারিয়ে যায়না। হয়তো থ্যাংকস গিভিং ডিনারে বর্তমান যুগে নানারকম খাবারের আয়োজন থাকে, কিন্তু টার্কি রোস্ট এবং সবশেষে পামকিন পাই, আদি ও অকৃত্রিম হিসেবে আজও রয়ে গেছে খাদ্য তালিকায়। থ্যাংকস গিভিং এত বড় উৎসব যে এই উপলক্ষে টিভিতে ফুটবল গেইম, থ্যাঙ্কস গিভিং প্যারেড প্রচারিত হয়ে থাকে। থ্যাঙ্কস গিভিং প্যারেডে পিলগ্রিম (ব্রিটিশ অরিজিন) এবং আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের ডিস্পলে দেখানো হয়ে থাকে। থ্যাংকস গিভিং উৎসবের খাওয়া দাওয়া শেষে মূল আকর্ষণ ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল’!! বিশেষ মূল্য হ্রাসে আকর্ষণীয় জিনিসপত্র বেচা কেনার প্রতিযোগিতা! ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেলে আমেরিকান জনগণের খুব প্রিয় পণ্যসামগ্রী সীমিত পরিমাণে কিন্তু জলের দরে বিক্রি করার ঘোষণা দেয়া হয়। যেহেতু সীমিত পরিমাণ তাই কার আগে কে পাবে, এই নিয়ে হুড়োহুড়ির প্রতিযোগিতা চলে। ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেলের বাণিজ্যিক লাভের অংশটুকু আমেরিকার রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখে বলে এই সেলের আবেদন রাষ্ট্রিয় পর্যায়েও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল ভীষণ উত্তেজনাময়, আমাদের দেশের ক্রিকেট ফুটবলের মত জনপ্রিয় ইভেন্ট। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে এই সেল শুরু হয়, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে সেল চলে, বেলা একটু বাড়ার সাথে তা শেষ হয়ে যায়। ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেলে আমেরিকার প্রতিটি রিটেল স্টোরে অতি সুলভ মূল্যে আকর্ষণীয় পণ্য বিক্রয় করা হয়। পণ্য সরবরাহ সীমিত থাকে, বিক্রয় সময়ও থাকে নির্দিষ্ট, তাই ক্রেতাদের ভীড় হয় অনিয়ন্ত্রিত। ফলে আগে এলে আগে পাবে প্রতিযোগীতায় ক্রেতাদের ভীড়, হুটোপুটি, একজনের গায়ে ধাক্কা লেগে অন্যজনের হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়া, পড়ে গিয়ে আবার উঠেই সেলের পণ্য ধরতে দৌড় দেয়া, সব মিলিয়ে দারুণ উপভোগ্য দৃশ্য। প্রায় প্রতি বছর আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে দুই একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, দুই একজন যে প্রাণ হারায়নি, তাও নয়, গর্ভবতী নারীর প্রসব বেদনা উঠার ঘটনাও ঘটেছে, তবুও ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেলের আবেদন এতটুকু কমেনি। ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল’ আমেরিকার অর্থনীতির সূচককাঁটা ঘুরিয়ে দেয়। এভাবেই বর্তমান সময়ে থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’র ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্য অপেক্ষা বাণিজ্যিক দিকটাই বেশী প্রকাশিত হয়ে পড়ে।

যদিও থ্যাংকস গিভিং ডে উৎসব আমেরিকা কানাডায় পালিত হয়। তবে শুধু আমেরিকা বা কানাডাতে দিনটি উদযাপিত না হয়ে পৃথিবীর সকল দেশেই তা পালিত হতে পারে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ তো প্রতিনিয়তই দেয়া উচিত এমন সুন্দর এক পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন বলে, ধন্যবাদ দেয়া উচিত, এই সুন্দর পৃথিবীর সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য আমাদের সৃষ্টি করেছেন বলে, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য পৃথিবীটাকে নানা ধনসম্পদে ভরিয়ে রেখেছেন বলে। 

আমাদের সকলেরই তো ‘মে ফ্লাওয়ার’ এর যাত্রী পিলগ্রিমদের মতই পরিশ্রম করে ফসল ফলানোর কথা, শত্রু নয় বন্ধু নীতিতে চলার কথা, তা না করে আধুনিক বিশ্বে মানুষ হয়ে উঠছে স্বার্থপর, নিষ্ঠুর, অমানবিক। প্রতিদিন নিষ্ঠুর গোলার আঘাতে হত্যা করে চলেছে অসহায় নারী, পুরুষ, শিশু। আশ্রয়হীন, সম্বলহীন অসহায় মানুষগুলো একটু আশ্রয়ের জন্য, এক মুঠো খাদ্যের জন্য বনবন করে ঘুরছে এ প্রান্তর থেকে ও প্রান্তরে, নিজ দেশ থেকে পাশের দেশে। এমন হওয়ার কথা ছিল না, বিশ্ব যত বেশী আধুনিক হচ্ছে, বিশ্বের মানুষ ততই আদিম যুগের পথে হাঁটছে। 

পৃথিবীতে শান্তি আসুক, শান্তি চাই, সব সুন্দর হয়ে উঠুক, সকল সুন্দরের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ শুধুমাত্র প্রতীকী দিবস হিসেবে পালিত না হয়ে, আক্ষরিক অর্থেই পারস্পরিক বন্ধুত্ব, ভালো কাজের স্বীকৃতি, পারস্পরিক সহযোগীতা, সহমর্মিতা ও উদারতায় পরিপূর্ণ হোক। মানুষ যুদ্ধ বিগ্রহ ভুলে, হানাহানি, মারামারি বন্ধ করে, প্রতিবেশী, প্রতিবেশী দেশ তথা সারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের সাথে বন্ধুত্ব অথবা সন্ধি করার কথা ভাবুক, তবেই ঈশ্বরও আমাদের জীবনে তাঁর করুণা বর্ষণ করবেন। 

ঈশ্বরের করুণায় সিক্ত হয়ে আমরাও প্রতিদিন অথবা প্রতি মাস অথবা বছরের একটি দিন, ঈশ্বরের জয়গান করতে পারি, ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে পারি আমাদের প্রতি অবারিত করুণা বর্ষণের জন্য। আজকের দিনটি হোক ঈশ্বর বন্দনায় নিবেদিত! থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’- দিনটি হোক সকলের, পৃথিবী হয়ে উঠুক বাসযোগ্য!!

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী
 

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

সর্বশেষ খবর