৫ এপ্রিল, ২০২০ ১৩:১২

যখন জীবন থমকে দাঁড়ায়

সাঈম চৌধুরী

যখন জীবন থমকে দাঁড়ায়

সাঈম চৌধুরী

মৃত্যুমুখী এই সময়ে বুকে যতবার সাহস যোগাই ততবার ভেতরে জাগেন পীর মজির উদ্দিন। তারাখসে পড়া আন্ধার রাতের গল্প বলেন তিনি। বলেন পলকে পলকে জল খাওয়ানোর তীব্রতর প্রেমের কথা। পীর মজির সাহসকে পরিণত করেন অলৌকিক প্রেমে। সময়টা কঠিন। দরজা খুলে দিতে ভয় হয়। যেনো খোলা দরজায় বাতাসের বদলে ঘরে ঢুকে শ্বাসকষ্ট! তাই ঘরে ঘরে দরজায় খিল, ঘরে ঘরে ঘরবন্দির গল্প।

যখন সব দরজা বন্ধ হয়ে যায় তখন মানুষ আরো এক দরজার সন্ধান পায়। সে দরজার চাবি বড় অদ্ভুত। একটু একটু করে খুলে। ধীরে ধীরে খুলে। যতটা বুঝতে পারা যায় ততোটা খুলে। বাস্তবিক তখন নামাজির সংখ্যা বাড়ে, পূজারির সংখ্যা বাড়ে, চার্চের দরজায় তালা দেওয়া থাকলেও বুকের দরজা খুলে ক্রশবিদ্ধ যিশুর যন্ত্রণাকে ধারণ করা যায় ঠিকই।

মৃত্যুচিন্তা অধিকাংশ মানুষকে তার বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যায়। তবে মগজে মৃত্যুর ভয় রেখে এমন যাত্রায় তেমন স্বস্তি পাওয়া যায় না। বিশ্বাসের কাছে যেতে হয় শান্ত কোমল, স্বস্তিময় গভীরতায়। স্বস্তি ব্যতিরেকে বিশ্বাসের কাছে গেলে তার অরূপ রূপের কিছুই ঠাহর হয় না।
রূপ দেখে কে স্রষ্টার সাধনা করে?

আচমকা নিজের গভীর থেকে এই প্রশ্ন আমাকে নাজেহাল করে, বিপর্যস্ত করে। আমি প্রশ্নের উত্তর না দিতে পেরে মৃত্যুমুখী সময়ের কাছে ফিরে যাই। পৃথিবীর এখন আশ্চর্য অসুখ। বিশ্ব মানচিত্র জুড়ে করোনার আধিপত্য। প্রায় প্রতিটি দেশের সীমান্তে রীতিমতো সীলগালা। তবুও রুখে দেওয়া যাচ্ছে না করোনার বিস্তার। বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।

গত কয়েকদিন ধরে কাটছে ঘরবন্দি সময়। বাসার দরজা খুলে পয়ত্রিশ কদম হাঁটলেই তুমুল সবুজ মাঠ। লন্ডনের আকাশ রোদের খেলা। শীতের আড়মোড়া ভেঙে দুয়ার খুলে বেরিয়ে এসেছে বসন্ত। ঘর ছেড়ে পথে নামার উৎকৃষ্ট সময়। অথচ জানলায় তাকিয়ে দেখি, পথে কেউ নেই। জনশূন্য সবুজ পার্ক বিষণ্ণতার ছবি আঁকে। শহর ভোগছে কঠিন অসুখে।

রাষ্ট্রজুড়ে অসুখের ক্ষত। যেনো অসুখ নিয়েছে শহরের দায়িত্বভার। মানুষ হয়েছে ঘরবন্দি। জীবনানন্দের কবিতার মতো সব পাখি ঘরে ফিরে, ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন। এর মাঝে নতুন করে জীবনের মানে শেখায় করোনাভাইরাস। এটি কেবলই রোগ নাকি এটি এক প্রশ্নের উদ্রেক?

মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে, জীবনের নাশ। একদিন এই দেখা হয়ে যাবে শেষ/পড়িবে নয়ন-পরে অন্তিম নিমেষ।তবুও প্রতিদিন আমরা নিজের মৃত্যুকে আরো অনেক দূরের পথ হিসেবে ভাবি। মৃত্যুকে ভাবনায় দূরে রাখতে পারি বলেই জীবন সুন্দর হয়ে ওঠে। জীবন ঝিলমিল ঝিলমিল রঙের নৌকা দৌড়ায়।

রঙের সেই নৌকায় এসে হঠাৎ সজোরে ধাক্কা দিয়েছে করোনাভাইরাস। জীবন আর মৃত্যুকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে একই সমান্তরালে। জন্ম থেকে যে বোধটি আমাদের সঙ্গী থাকা দরকার সেই বোধটা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমাদের সঙ্গ ছাড়ে না। আমাদের নাকাল করে দেয়।

ইদানিং টেলিফোনে যার সাথে কথা বলি, শুনি বিষন্ন, বিপন্ন সুর, যেনো জীবন ফুরিয়ে এলো। আমাদের চারপাশ ঘিরে এখন মৃত্যুর কালো ছায়া। বেঁচে থাকা আর মৃত্যু হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করা জমজ দুই বোন, করোনাভাইরাস আমাদের এই সত্যের নিকটবর্তী করে।

হয়তো আরো কিছুদিন। তারপর মানুষ জয় করবে করোনাভাইরাসকে। যেভাবে একদিন জয় করেছিলো কলেরা, বসন্ত, কত কত মহামারী। তারপর একদিন সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তারপর আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা অঘ্রানে নবান্নে উৎসবে।সেই সময়ে কি আমি থাকবো, বুকের ভেতরে সেই প্রশ্ন কখন যে দীর্ঘশ্বাস হয়ে যায় বুঝতে পারি না। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাই। কী সুন্দর আকাশের নীল, কী সুন্দর মাঠের সবুজ!

যাহা-কিছু হেরি চোখে কিছু তুচ্ছ নয়,
সকলি দুর্লভ ব'লে আজি মনে হয়।
দুর্লভ এ ধরণীর লেশতম স্থান,
দুর্লভ এ জগতের ব্যর্থতম প্রাণ
যা পাই নি তাও থাক্, যা পেয়েছি তাও,
তুচ্ছ ব'লে যা চাই নি তাই মোরে দাও।

লেখক: গল্পকার ও সাংবাদিক, লন্ডন

বিডি-প্রতিদিন/সিফাত আব্দুল্লাহ

সর্বশেষ খবর