শিরোনাম
৮ এপ্রিল, ২০২০ ১৭:১৮

বিশ্বায়নের এ যুগে জয় হোক মানবতার

নুজহাত নূর সাদিয়া

বিশ্বায়নের এ যুগে জয় হোক মানবতার

নুজহাত নূর সাদিয়া

আহ! নিজ অজান্তে বুকের ভেতর চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসটা আস্তে করে ছেড়ে দিলাম। কিছুটা উদ্বেগে ভরা চোখ দু'টি সামনের টিভি পর্দায় আটকে গেছে। ব্রেকিং নিউজ, করোনা আক্রান্ত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন শারীরিক অবনতির কারণে হাসপাতালে স্থানান্তরিত হয়েছেন। নিঃসন্দেহে, ব্রিটিশ জনগণ ও পুরো বিশ্বের জন্য এটি একটি দুঃসংবাদ বটে!  কবে যে, এই করোনা ও তার আরেকটি আনুষ্ঠানিক নামতো ভুলেই গিয়েছিলাম কোভিড-১৯ তার মৃত্যুবাণ নিক্ষেপ বন্ধ করবে?  

একদিকে অজানা প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার নিত্য শঙ্কা আর অপরদিকে পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় এক দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক মন্দার মুখোমুখি হওয়ার উদ্বিগ্নতায় ভুগছে বিশ্ববাসী। ইতিমধ্যে, তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর খেটে খাওয়া মানুষগুলো কর্ম সংকটের কারণে অভাবের মুখ দেখছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১০০টির বেশি প্রতিষ্ঠান এ পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর অযাচিত ঋণ পরিশোধে এগিয়ে এসেছে। ব্রিটেনের সুপরিচিত দাতব্য প্রতিষ্ঠান 'অক্সফাম' ও 'অ্যাকশন এইড ইন্টারন্যাশনাল' চলতি ২০২০ সালের জন্য ২০ বিলিয়ন পাউন্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিশ্ব প্রতিনিধিদের কাছে সহায়তা চেয়ে চিঠি লিখেছে।

যুক্তরাজ্যের 'জুবিলি ডেবট ক্যাম্পেইনের' প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সারাহ ক্লিফটনের মতে; কমপক্ষে মধ্যম ও স্বল্প আয় মিলিয়ে বিশ্বের প্রায় ৬৯টি অনুন্নত দেশে এক অপ্রত্যাশিত অর্থনীতি দেখা যাবে যা সামাল দিতে আমাদের এখনই প্রয়োজন প্রাপ্ত সম্পদের একটি উপযুক্ত বন্টন ব্যবস্থা নির্ধারণ করা। বিশ্বব্যাংক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইতিমধ্যে ১৪ বিলিয়ন পাউন্ড ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৫০ বিলিয়ন পাউন্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অংকের অর্থের ঘোষণা দিয়ে তাদের চিরপরিচিত নেতৃত্বের ছড়িটি আবারও বিশ্ব নেতৃত্বকে দেখিয়ে দিল। বাংলাদেশের সৌভাগ্য, বিশ্বব্যাংক করোনা আক্রান্ত বাংলাকে ১০ মিলিয়ন পাউন্ডের আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এত গেল, শীর্ষস্থানীয় দেশ আর প্রতিষ্ঠানগুলোর সাহায্যের খসড়া, তবে সংকটের এ চলমান সময়ে আদৌ কেমন আছেন রাষ্ট্রপ্রধানরা আর কেমন চলছে আমজনতার জীবনলিপি? কথায় বলে, আমেরিকা হাঁচি দিলে নাকি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ঠাণ্ডা লেগে যায়। মার্কিন অর্থনীতির ভিক্তি কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, তা বোঝাতে এই পুরনো প্রবাদই যথেষ্ট। তবে, নিয়তির হাতের পুতুল আমরা সকলে।

দাম্ভিক ট্রাম্প ইতিমধ্যে নিজেকে রাজনৈতিক শরণার্থীদের তালিকায় সামনের সারিতে উপস্থাপন করেছেন। রাজনৈতিক শরণার্থী বলছি এ কারণে যে, আরেক বাণিজ্য  ব্যাঘ্র ভারতকে রীতিমত শাসিয়েছেন চিকিৎসার ওষুধ দিতে অপারগতা প্রকাশের কারণে। অন্যদিকে, চির বৈরি দেশ চীনা কীটগুলোকে ব্যর্থ বলে ঘোষণা দিয়ে তাদেেই স্বনামখ্যাত প্রতিষ্ঠান 'আলীবাবা' হতে মোট ৫,০০,০০০ টেস্ট কিট ও ১ মিলিয়ন মাস্কের সহায়তা প্রতিশ্রুতি নিয়ে এটাই প্রমাণ করলেন। বিপদে বন্ধু-শত্রু সকলে হাত ধরাধরি করে চলে। বিশ্ব বিপর্যয়ের এ সময়ে কানাডা অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের এ দ্বিধাবিভক্তিতে। অন্যদিকে সুচতুর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সময়ের এ সুবর্ণ সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাননি। ভবিষ্যতে, আবার বিশ্ব সিংহাসনে বসার সুপ্ত ইচ্ছা হতেই মাস্কসহ নানা চিকিৎসা সরঞ্জামাদি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন তিনি। 

কোভিড-১৯ এর দৌরাত্ম্যে আজ পবিত্র কাবা শরীফ নিরব-নিস্তব্ধ, রাশান-সৌদি দ্বন্দ্বে তেলের দাম ক্রমশ কমছিল, তবে ব্রিটিশ বহু পেট্রোল কোম্পানির অভিমত পেট্রোলের দাম ১ পাউন্ডের নিচে নেমে গেলে অবাক হবার কিছু থাকবে না! আজ শৌখিন ও পেশাদার গাড়ি চালকদের মাথায় হাত বললেও অত্যুক্তি হবে না। বিগত ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ববাজারে সর্ববৃহৎ রপ্তানিকারক চীনের গাড়ি বিক্রি নিম্নমুখী শতকরা (-৮৬) ভাগে। সবচেয়ে, সম্ভাবনাময় যে পোশাক খাত তা আবার ও হুমকির মুখে, সরকার -মালিক পক্ষ দ্বন্দ্ব। শ্রমিকদের টানাপোড়েনে ব্রিটেনের মোট দেড় হাজার রিটেইল শপ পুরোপুরি বন্ধের মুখে। অন্যদিকে, দেশের 'ফোরটিস গ্রুপ' নামক একটি প্রতিষ্ঠান পিপিআই, মাস্ক সহ নানা প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নির্মাণের মাধ্যমে এ বার্তাই নিশ্চিত করেছে, সীমিত সাধ্যে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। 

স্বর্ণ, নারীর সৌন্দর্য্য বর্ধন আর অনিশ্চয়তার অন্যতম হাতিয়ার বলে বিবেচিত। এ দুঃসময়ে বিনিময়ে এখনো আস্থাভাজন এ মূল্যবান ধাতুর দাম স্থিতির পর্যায়ে। দূরদেশে বাণিজ্য সেতু তৈরি, প্রিয়জনদের হাসিমুখগুলো বারে বারে স্মরণ আর কিছুটা একঘেয়েমি জীবনে ভিনদেশে বৈচিত্র্যে ভরা ছুটি কাটানো-সবকিছুই এখন স্বপ্নেরও অতীত। মোট ১০০টি দেশে ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্রায় ৩৬,০০০ জন নিয়মিত কর্মীর চাকরি ছাঁটাই, আন্তঃদেশীয় ফ্লাইট চলাচল কমে এখন প্রায় ৫০,০০০-এরও নিচে। এত সব দুঃসংবাদ, তবে বরিস সরকার মোট ৭৫ মিলিয়ন পাউন্ডের একটি প্যাকেজ ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দিল, ব্রিটিশ সরকার চার্টার বিমানের মাধ্যমে নানা দেশে আটকে পড়া ব্রিটিশ নাগরিকদের মাতৃভূমিতে ফিরিতে আনতে সংকল্পবদ্ধ।

এ আনুষ্ঠানিক লকডাউন পিরিয়ডে উন্মাদের মত খাবার কেনার হিড়িক যেমন পড়েছে পুরো বিশ্বজুড়ে, ঠিক তেমনি সুযোগসন্ধানী একদল অসাধু ব্যবসায়ী অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের অনৈতিক পুঁজির পাহাড়টিকে আকাশছোঁয়া করতে তৎপর ছিলেন। আশার কথা, পরিস্থিতি মোটামুটি স্থির বিপুল চাহিদার তালিকায় থাকা কিছু জিনিস- যেমন টয়লেট টিস্যু, হ্যান্ড ওয়াশ, ডিম, লবণ, শিশুদের গুঁড়ো দুধ, ফ্রোজেন কমলার রস আবারও তাদের শারীরিক উপস্থিতি জানান দিচ্ছে সুপারশপগুলোর সুদৃশ্য তাকে। রাজনৈতিক উপদেষ্টা আর সরকার প্রধানদের রেশনিং-এর সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত কাজে এসেছে বৈকি।

বেকারদের তালিকায় মার্কিনিদের অবস্থান ১ম সারিতে মোট ৬.৬ মিলিয়ন, তালিকায় পরের স্থানটি স্পেনের প্রায় ৯ লাখ। বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুসারে এ ক্রান্তিকাল যত দীর্ঘ হবে মোট উৎপাদনের রেখাটি ক্রমশ নিচে নামবে যা কঠিন বাস্তবতায় শতকরা ২.৪ হতে সর্বনিম্ন ১.৫ পর্যন্ত হতে পারে। ব্রিটেন সরকারের শর্তবিহীন নানা প্রণোদনা চাকরিতে অস্থায়ী কর্মীটিকে আগামী তিনমাস যেমন কিছুটা হলেও স্বস্তি যুগিয়ে চলেছে, অন্যদিকে সন্তানদের পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয়ে ছুটন্ত অভিভাবকদের কপালের রেখাগুলো দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। কিছুটা উদভ্রান্ত আর পোড় খাওয়া উদ্যোক্তাটি যেমন সরকার হতে প্রাপ্ত পুঁজি নিয়ে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে। অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের এক ক্লান্ত -শ্রান্ত দিনমজুরের করুণ আর্তি- করোনা হইলে ১৪ দিন ঘরেবন্দী থাকন লাগব, আর না খাইয়া থাকলে দু’তিনদিনে মরণ লাগব, আমরা কই যামু?

দীর্ঘশ্বাসটি আরও বড় হয়- জীবনের অপমৃত্যু নিত্য, ভবিষ্যৎ নিয়ে নির্মম চুলচেরা। সব ছাপিয়ে চোখের সামনে ক্ষণিকের তরেও কি ভেসে উঠছে না কিউবা নামক সে  ছোট্ট দেশটি আর তাদের অবিস্মরণীয় নেতা ফিদেলের সংগ্রামগাঁথা। যে দেশটি মহামারি আর লুটেরাদের আক্রমণে বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে, সাহায্য দিতে অপারগ ইউরোপীয় দেশগুলোর হুমকির তোয়াক্কা না করে সাহস আর মানবশক্তিকে পুঁজি করে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা খাতে শুধুই সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। মিসাইল নামক সে ধ্বংসাত্মক মনোভাবের পেছনে না ছুটে প্রতি ২৫জন মানুষের বিপরীতে একজন চিকিৎসক তৈরি করে দেখিয়ে দিয়েছে যুগে যুগে শুভবুদ্ধির জয় হয়েছে এবং তা হতে বাধ্য। বিশ্বায়নের এ গতিময় যুগে মানবতার জয় হোক, স্রষ্টা সকলকে রক্ষা করুন। (সূত্র: বিবিসি)

বিডি-প্রতিদিন/শফিক

সর্বশেষ খবর