শুক্রবার, ২৯ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রাণপুরুষ

ড. এম আবদুল আলীম

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রাণপুরুষ

কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯১-১৯৮১) বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা, পঠন-পাঠন ও গবেষণার অন্যতম প্রাণপুরুষ। এক্ষেত্রে তিনি বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন যা তাঁর পূববর্তী জ্ঞানসাধক ও মনীষীদের শতাব্দীব্যাপী সাধনার ধারাবাহিকতার ফসল

 

কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯১-১৯৮১) বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা, পঠন-পাঠন ও গবেষণার অন্যতম প্রাণপুরুষ। এক্ষেত্রে তিনি বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন যা তাঁর পূববর্তী জ্ঞানসাধক ও মনীষীদের শতাব্দীব্যাপী সাধনার ধারাবাহিকতার ফসল। কাজী মোতাহার হোসেনের বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার বিষয়টি পর্যালোচনা করতে গেলে আমাদের ইতিহাসের ঝরোকায় চোখ মেলে পেছনে তাকাতে হয়। এদেশে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত করেছিলেন খ্রিস্টান মিশনারীরা। এছাড়া হিন্দু-কলেজ (১৮১৭) প্রতিষ্ঠার ফলে বঙ্গদেশে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় নবদিগন্তের দ্বার উন্মোচিত হয়। রাজা রামমোহন রায় এ ধারা বেগবানে বিশেষ অবদান রাখেন। ১৮২৩ সালে এক চিঠিতে তিনি বড়োলাট লর্ড আমহার্স্টকে অনুরোধ করেন এদেশে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা প্রচলনের। বাংলা ভাষায় প্রথম বিজ্ঞানপুস্তক রচনা করেন রবার্ট মে, বইটির নাম অঙ্কপুস্তকং (১৮১৭)। এরপর হপ্কিংস পিয়ার্স ও জন পিয়ার্সন রচনা করেন ভূগোল বৃত্তান্ত (১৮১৯) ও কথোপকথন (১৮২৪) গ্রন্থ। এরই ধারাবাহিকতায় পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, অঙ্কশাস্ত্র, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে অনেক গ্রন্থ বাংলা ভাষায় রচিত হয়। ইংরেজি ভাষা-ভাষীদের রচিত বিজ্ঞানগ্রন্থগুলো প্রধানত ছিল পাঠ্যপুস্তক, যার গদ্য সরস ও প্রাঞ্জল ছিল না। পরবর্তীকালে বাঙালি চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক এবং পন্ডিতগণ; যেমন-অক্ষয়কুমার দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, ভূদেব মুখোপাধ্যাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখের চিন্তা-মনন ও প্রতিভার স্পর্শে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা প্রাণপ্রচুর্যে ভরে ওঠে। বিজ্ঞানের তথ্য তথা জটিল সূত্রের সঙ্গে প্রাণের আবেগ এবং চিন্তা-মনন মিশিয়ে বাংলা ভাষায় সাবলীল ভঙ্গিতে বিজ্ঞানচর্চা করে তাঁরা দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন। বঙ্কিমের বিজ্ঞান-রহস্য (১৮৭৫) গ্রন্থটি বাংলা ভাষার বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ভাষার কারুকাজ এবং লালিত্যে বিজ্ঞানের জটিল রহস্য তথা জ্যোতির্বিদার নানাবিষয় তিনি পাঠকের সামনে হাজির করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিজ্ঞানচর্চা এবং বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগের নানা দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। জীবনস্মৃতি পাঠ করলে শৈশব থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর কৌতূহলের খবর পাওয়া যায়। জগদীশচন্দ্র বসু, আইনস্টাইন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রশান্ত মহলানবিশ প্রমুখের সঙ্গে ঘনিষ্ঠসান্নিধ্য এ কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দেয়। জীবনের অপরাহ্ণ-বেলায় তিনি রচনা করেন বিশ্বপরিচয় (১৯৩৭) নামক অসাধারণ গ্রন্থ। এ গ্রন্থে শিক্ষার গোড়া থেকেই শিশুদের বিজ্ঞানের আঙিনায় প্রবেশের তাগিদ দেন। এক্ষেত্রে সাহিত্যের সহায়তা স্বীকার করলে অগৌরবের কিছু নেই বলেও মন্তব্য করেছেন। সেই দায়বোধ থেকেই তিনি রচনা করেন বিশ্বপরিচয়। গ্রন্থের ভূমিকায় বিজ্ঞানচর্চার গুরুত্ব তুলে ধরে লেখেন : ‘আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বাল্যকাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না। ... জ্যোতির্বিজ্ঞান আর প্রাণবিজ্ঞান কেবলই এই দুটি বিষয় নিয়ে আমার মন নাড়াচাড়া করেছে। তাকে পাকা শিক্ষা বলে না, অর্থাৎ তাতে পান্ডিত্যের শক্ত গাঁথুনি নেই। কিন্তু ক্রমাগত পড়তে পড়তে মনের মধ্যে বৈজ্ঞানিক একটা মেজাজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। ... বিজ্ঞান থেকে যাঁরা চিত্তের খাদ্য সংগ্রহ করতে পারেন তাঁরা তপস্বী।’ এভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিজ্ঞানচর্চা ও শিক্ষার ওপর তাগিদ দিয়েছেন। একই সঙ্গে বিজ্ঞানশিক্ষা ও চর্চার দ্বারা দেশবাসীর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়া ও সমাজ থেকে গোঁড়ামি ও পশ্চাৎপদতা দূর করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রায় এক শতাব্দীর ঐতিহ্য অর্থাৎ-পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই কাজী মোতাহার হোসেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় অভিনিবেশ ঘটান। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, গবেষণা, পরিভাষা নির্মাণ; প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি বাংলা ভাষাকে কাজে লাগিয়েছেন। বস্তুত, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের উচ্চতর গবেষণা করে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তা সেকালে তো বটেই, একালেও অনুসরণীয়।

কাজী মোতাহার হোসেনের বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রেরণা জুগিয়েছে তাঁর যুগ-পরিবেশ এবং সমকাল। সেকালে ফ্যাসিবাদী ও সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির পৈশাচিকতার বিপরীতে বিশ্বব্যাপী জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, দর্শন-ইতিহাসচর্চায়ও সৃষ্টি হয় ব্যাপক উদ্দীপনা। বিশের দশকের শুরুর দিকে তিনি যখন পদার্থবিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন তখন প্ল্যাংক, আইনস্টাইনের বিপ্লবাত্মক বলবিদ্যা এ শাস্ত্রের পুরনো ধ্যান-ধারণা ভেঙে নতুন প্রাণসঞ্চার করে। বোরের আণবিকতত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞান গবেষণায় নতুন পথ দেখায়। এছাড়া কোয়ান্টাম তত্ত্ব আবিষ্কার ও পরমাণু নিয়ে গবেষণায় ঘটে বিপ্লব। এমন বাস্তবতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দিয়ে কাজী মোতাহার লাভ করেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নিবিড় সান্নিধ্য, যাঁর নেতৃত্বে এদেশের পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা তখন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পরিচিতি পায়। সত্যেন বসুর ‘বোস সংখ্যায়ন’-এর মতো যুগান্তকারী আবিষ্কার মোতাহার হোসেনের সামনেই ঘটেছে। মেধাবী ছাত্র, তরুণ ও কৌতূহলী অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের চেতনা ও মননের জগতে বিজ্ঞান-গবেষণার এসব ঘটনা ব্যাপক উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। সত্যেন বোসের আহ্বানে দিন-রাত সাধনা করে তিনি পদার্থবিদ্যার বহু সমস্যা সমাধান করে দেন। তাঁর গাণিতিক পারদর্শিতা দেখে সত্যেন বোস পরিসংখ্যানবিদ্যায় মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন। যার ফল কলকাতায় গিয়ে প্রশান্ত মহলানবিশের তত্ত্বাবধানে পরিসংখ্যানে তাঁর ডিপ্লোমা অর্জন। শুধু তাই নয়, ১৯৪২ সালে পরিসংখ্যানবিদ্যায় গবেষণা করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর ওই গবেষণা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। এরই ধারাবাহিতকায় তাঁর হাত দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের গোড়াপত্তন ঘটে, প্রতিষ্ঠিত হয় পরিসংখ্যান গবেষণা ও ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের। পদার্থবিজ্ঞান ও পরিসংখ্যানবিদ্যার গবেষণায় বাংলা ভাষার নিপুণ ব্যবহার করে তিনি এ ভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় নতুন যুগের দ্বার-উন্মোচন করেন। সত্যেন বসুর কোয়ানআম থিয়োরি লেখাটির বাংলা অনুবাদ করে তিনি নাম দেন ‘ঝলকবাদ’। লেখাটি প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত হলে সত্যেন বসু এর ভাষাগত স্বাভাবিকতা, সরলতা এবং প্রাঞ্জলতার প্রশংসা করেন।     

 

দুঃখজনক হলেও সত্য যে কাজী মোতাহার হোসেন এবং তাঁর পূর্বসূরিগণ যেভাবে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ধারা বেগবান করেছিলেন, তা ক্রমে স্তিমিত হয়ে গেছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় তথা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিশিক্ষার যতটা প্রসার ঘটেছে, সে তুলনায় বাংলা ভাষায় এর পাঠদান ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন বৃদ্ধি পায়নি

 

কাজী মোতাহার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে শুরুর দিকে অধ্যাপনা শুরু করেন। তখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে এমন সব গুণী ব্যক্তির (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এফ. সি. টার্নার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, জি. এইস. ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, ডব্লিউ এ জেনকিন্স, রমেশচন্দ্র মজুমদার, স্যার এ. এফ. রহমান, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ) অধ্যাপনায় সমাগম ঘটে; যাঁরা শিক্ষায়, গবেষণায়, ব্যক্তিত্বে, পান্ডিত্যে, পেশাদারিত্বে এবং সর্বোপরি জ্ঞানভিত্তিক সমাজনির্মাণে ইতিহাসে মর্যাদার আসন লাভ করেছেন। এঁদের মধ্যে কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১) ছিলেন ব্যতিক্রম। বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েও সাহিত্য-সংস্কৃতি, দেশ-কাল-সমাজ; বিশেষত মুসলমান সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্নতা ও পশ্চাৎপদতা নিয়ে তিনি গভীর চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, যা তাদের জাগ্রত করতে ও এগিয়ে নিতে সঞ্জিবনীসুধার কাজ করেছে। একজন খেলোয়াড় তথা দাবাড়ু হিসেবে উপমহাদেশে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিলেন না। মুসলিম সাহিত্য সমাজের (১৯২৬) অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি হিসেবে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ছিলেন নজরুল-সুহৃদ, রবীন্দ্রঅনুরাগী এবং বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির সমঝদার। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চালালে তিনি বাংলা ভাষার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা এবং উচ্চশিক্ষায় এর প্রয়োগে তাঁর অবদান ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।      

কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞানের ছাত্র, নিবেদিতপ্রাণ অধ্যাপক এবং নিবিষ্টচিত্ত গবেষক হিসেবে বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা-চেতনা দ্বারা নিজেকে পরিচালিত করেছেন। তাঁর বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি হঠাৎ করে গড়ে ওঠেনি। এর পেছনে ছিল দীর্ঘ দিনের সাধনা-অধ্যয়ন-অধ্যবসায়; যার গোড়াপত্তন ঘটে অতি শৈশবে। বাড়ির নিম্ন-প্রাইমারিতে পড়ার সময় পন্ডিত চাচার কাছে শিখেছিলেন যোগ, বিয়োগ এবং গুণ অঙ্ক। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় পাঁচটি মিশ্র অঙ্কের উত্তরসহ সব বিষয়ে ১০০ নম্বরের মধ্যে ১০০ পেয়ে মাসিক দুই টাকা বৃত্তি পেয়েছিলেন। কুষ্টিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সময় শিক্ষক জ্যোতিরিন্দ্রমোহন রায় তাঁর চেতনার মর্মমূলে গভীরভাবে প্রোথিত করেন গণিতশাস্ত্র তথা বিজ্ঞানের বীজ। একই সঙ্গে মানবতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার দীক্ষাও তিনি তাঁর কাছেই পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন-অধ্যাপনা করতে গিয়ে বিজ্ঞান ও সাহিত্যের প্রতি গভীরভাবে অনুরাগী হন। একদিকে বিজ্ঞান, অন্যদিকে সাহিত্য; এ দুয়ের সমন্বয়ে জ্ঞান-সাধনা ও জীবন-যাপন ছিল তাঁর আরাধ্য। সাহিত্যের সত্য এবং বিজ্ঞানের সত্যকে একাত্ম করে তিনি রচনা করেছেন ‘পৃথিবীর গতি সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’, ‘কবি ও বৈজ্ঞানিক’, ‘শব্দ ও তাহার ব্যবহার’, ‘বৈজ্ঞানিকের জ্ঞানসাধনা’, ‘অসীমের সন্ধানে’, ‘মানবমনের ক্রমবিকাশ’ প্রভৃতি প্রবন্ধ। বিজ্ঞানের মতো রসকষহীন বিষয়কে সাহিত্যরসে জারিত করে শৈল্পিক ঢঙে উপস্থাপন করেছেন। কবি ও বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনা করে লিখেছেন : ‘কবি ও বৈজ্ঞানিক দুইজনই সাধক, দ্রষ্টা, ¯্রষ্টা। ... কবি দেখতে চান জগৎ-ব্যাপারের অতীত সৌন্দর্য, আর বৈজ্ঞানিক দেখতে চান তার অন্তর্নিহিত সত্য। কবির সৌন্দর্য যেমন সত্য, বৈজ্ঞানিকের সত্যও তেমনি সুন্দর।’ বস্তুত, বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিকের উপলব্ধিতে মিল খুঁজে তিনি বিজ্ঞানচর্চায় শিল্প-সংস্কৃতির সমন্বয় সাধনের তাগিদ দিয়েছেন।

তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানশিক্ষা, পঠন-পাঠন ও চর্চার ওপর ব্যাপক গুরুত্বারোপ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পদার্থবিজ্ঞান ও তথ্যগণিত শিক্ষা দিয়েছেন বাংলা ভাষায়। সহকর্মীদের সঙ্গে মিলে তৈরি করেছিলেন পরিসংখ্যানের অনেক পরিভাষা। তিনি লক্ষ্য করেছেন শিক্ষার্থীরা ইংরেজি অপেক্ষা বাংলা ভাষায় পাঠগ্রহণে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ইংরেজি ভাষায় বাঙালি সন্তানদের বিজ্ঞান শিক্ষার এ পন্থাকে তিনি ভুল মনে করতেন। তাই শিক্ষার্থীদের পঠন-পাঠনের সুবিধার কথা চিন্তা করে ১৯৬২ সালে বাংলা ভাষায় গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস নামে গ্রন্থ রচনা করেন। বইটি ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে তিনি প্লেটোর সিম্পোজিয়াম বইটি বাংলায় অনুবাদ করেন, যা ১৯৬৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। তাঁর তথ্য-গণিত গ্রন্থ বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার অনন্য দৃষ্টান্ত। বিজ্ঞান-গবেষণায় তাঁর প্রবর্তিত ‘হোসেন-শৃঙ্খল’ সেকালে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে, যা আজও সমানভাবে সমাদৃত। তথ্য-গণিত গ্রন্থে তিনি কালা-বকরি, রাঁধুনি-পাগল ধানের উল্লেখসহ এমন সব উদাহরণ হাজির করেছেন, যা বাঙালির আটপৌরে জীবন থেকে নেওয়া। তথ্য-গণিতের মতো জটিলশাস্ত্র বাংলা ভাষায় পঠন-পাঠন, চর্চা ও গবেষণার সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং তা উত্তরণের পথ-নির্দেশ করে তিনি লিখেছেন : ‘অনেকের মনেই অহেতুক সংশয় রহিয়াছে-বাংলাভাষার মাধ্যমে তথ্য-গণিতের মতো একটি বিষয় কেমন করিয়া শিখান যাইবে? পরিভাষা কোথায়? বাংলাভাষার সমৃদ্ধি কোথায়, যাহাতে পৃথক পৃথত প্রায় সমার্থক পারিভাষিক শব্দের ব্যঞ্জনা প্রকাশ করা যায়? কিন্তু তাই বলিয়া কি আরম্ভ করিতে হইবে না? আরম্ভ না করিলে কোথায় কোথায় জটিলতা রহিয়াছে তাহা ধরা পড়িবে কেমন করিয়া? আর ধরা না পড়িলে অতিক্রমই বা করা যাইবে কিভাবে?’ তাঁর উদ্ভাবিত পরিভাষাসমুহ-বিস্তার, বিক্ষেপ, পরিমিতি বিস্তার, বিস্তৃতি, গড় বিস্তৃতি, পরিক্ষেপ, আন্তঃচতুর্থক অর্ধপরিক্ষেপ, পার্থক্যেও যথার্থতা, মান, বিভিন্নক, অভিন্নক প্রভৃতি পরিসংখ্যানবিদ্যা চর্চা ও গবেষণায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।      

কাজী মোতাহার হোসেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেনে। বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সমন্বিত সাধনায় আলোকিত মানুষ সৃষ্টি ছিল তাঁর লক্ষ্য। এদেশের বিজ্ঞানের অধ্যাপকেরা যেখানে মাতৃভাষায় পাঠদান ও গবেষণায় উন্নসিকতা প্রদর্শন করেন, কাজী মোতাহার হোসেন সেক্ষেত্রে স্থাপন করেন অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীকালে অনেকেই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা করেছেন এবং এখনো করছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখ করা যায় শাহ ফজলুর রহমান, মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, জহুরুল হক, আবদুল হক খন্দকার, আবদুল্লাহ আল-মুতী, তপন চক্রবর্তী, আলী আজগর, অজয় রায়, দ্বিজেন শর্মা, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, নাদিরা মজুমদার প্রমুখের নাম। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে কাজী মোতাহার হোসেন এবং তাঁর পূর্বসূরিগণ যেভাবে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ধারা বেগবান করেছিলেন, তা ক্রমে স্তিমিত হয়ে গেছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় তথা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিশিক্ষার যতটা প্রসার ঘটেছে, সে তুলনায় বাংলা ভাষায় এর পাঠদান ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন বৃদ্ধি পায়নি। কাজী মোতাহার হোসেনের মতো বিজ্ঞানী ও জ্ঞানসাধক যেভাবে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথ প্রশস্ত করেছিলেন, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে এখনো যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানের গবেষণা, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং পাঠদান করা হয়, তাতে জাতির অশেষ কল্যাণ সাধিত হবে। ১২৫তম জন্মদিনের প্রাক্কালে এই বিজ্ঞানী ও মুক্তচিন্তার সাধক ও ধারককে জানাই শ্রদ্ধা।

লেখক : অধ্যাপক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর