অনেক সময় মনে হয় রবীন্দ্রনাথ লোক ছিলেন না অতিশয় দীনহীন এ বাংলাদেশের। পৌরুষে-প্রাণে, স্বভাবে-আচরণে, উদ্যম-উদ্ভাবনায় একক তিনি, একাকীও; তাঁর সঙ্গে এ দেশের আর পাঁচটি খর্বাকৃতি বস্তুর সাদৃশ্য নেই। মনে হয় অনেক ঊর্ধ্বে তিনি, এসেছেন ব্যত্যয় হিসেবে, অতি প্রাকৃতিক ঘটনার মতো আকস্মিকতায়, অপ্রত্যাশিত রূপে।
কিন্তু তবু এ দেশেরই মানুষই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, বাঙালিই ছিলেন-ব্যক্তিজীবনে এবং ব্যক্তি নিয়ন্ত্রিত হয় যদ্বারা সেই সমাজজীবনে।
তাঁকে বলা হয়েছে বিশ্বকবি। নির্বিশেষে সর্বজনীনতা অবশ্যই আছে রবীন্দ্রনাথে, কিন্তু তাঁর বিশেষ পরিচয়, একান্ত ও অন্তরঙ্গ পরিচয় তাঁর বাঙালিত্বের মধ্যেই। রবীন্দ্র প্রতিভার স্বভাব ও ঝোঁক তাঁর বাঙালিত্ব দ্বারাই অনিবার্য ও স্বাভাবিকরূপে প্রভাবিত, এবং সেই প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত। বাংলা ভাষায় তিনি শ্রেষ্ঠতম লেখক; ভাষার তিনি দাস ছিলেন না, ভাষা তাঁর আজ্ঞাবহ ছিল-একথায় অসত্য নেই যদিও, তবু ভাষার যে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা তা অবজ্ঞেয় নয়, এ সেই ক্ষমতা শ্রেষ্ঠতম লেখকের ক্ষেত্রেও যা অপরিহার্য রূপে কার্যকর। কিন্তু আরও বড় সত্য আছে, একটি প্রধান সত্য, এমনকি হতে পারে প্রধানতম সত্য। সে হচ্ছে এই ঘটনা যে, রবীন্দ্রনাথ ট্র্যাজেডির লেখক ছিলেন না, লেখক ছিলেন মহাকাব্যের। তাঁর অলৌকিক প্রতিভা ট্র্যাজেডির দিকে ঝুঁঁকে পড়েনি, ঝুঁঁকেছিল মহাকাব্যের দিকে। যদিও তিনি কোনো মহাকাব্য লেখেননি, গীতিকাব্যই লিখেছেন।
ব্যাপারটা ব্যক্তিগত নয়। তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়নি যে, তিনি ট্র্যাজেডির লেখক হবেন নাকি লেখক হবেন মহাকাব্যের। এ সিদ্ধান্ত এসেছে তাঁর নিয়ামক বাঙালিত্ব থেকে।
মহাকাব্য স্থানকে যত গুরুত্ব দেয়, ট্র্যাজেডি তত দেয় না। সর্বজনীন হয়েও মহাকাব্য বিশেষ দেশের ও দেশান্তর্গত কালের। বিষয়বস্তুর নির্বাচনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দেশেরই মানুষ-দেশের অতীত ও বর্তমানের। কিন্তু সে কথা আমরা বিশেষভাবে ভাবছি না এখানে। বিশেষভাবে ভাববার কথা এটি যে, ট্র্যাজেডির প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে অপক্ষপাত তাতে তাঁর বাঙালিত্বই প্রতিফলিত। বাঙালির জীবনে নাটক অল্প, ট্র্যাজেডি স্বল্পতর। দুঃখ ও পীড়া বাঙালির জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক বস্তুত, কিন্তু যে দুঃসাহস, অশুভের সঙ্গে সংগ্রামে যে দৃঢ়তা থাকলে দুঃখ ও পীড়া ট্র্যাজেডিতে উত্তীর্ণ হয় অভাব সেই প্রচণ্ড সাহসের, সেই অনমনীয় দৃঢ়তার। এ কারণে একদিকে যেমন তুষ্টি আসে সহজে অন্যদিকে তেমনি সন্ধি ও সহযোগিতাই প্রধান নীতি হয়ে দাঁড়ায়। অশুভ অবশ্যই আছে, জানি সে রয়েছে, তবু তাকে জানতে চাই না সম্পূর্ণরূপে, চিনতে চাই না পরিপূর্ণ পরিচয়ে, কেননা ভয় আছে দ্বন্দ্বে। সম্মুখ মুখোমুখিতে। রবীন্দ্র-সাহিত্যে অশুভ আছে, কিন্তু তাঁর চিত্রকলাতে যেমন আছে সাহিত্যে তেমন নেই। সাহিত্যে অশুভ প্রায়ই অবগুণ্ঠিত, অনেক সময়ে কুণ্ঠিত, এবং যখন প্রকাশিত, যেমন ‘শিশুতীর্থ’, তখন শুভজন্মের জয়ধ্বনি দ্বারা বিধৌত। ভয়ংকর ও সুন্দর হয়ে আছে তাঁর জগতে, যেমন এসেছে রানী সুদর্শনার কাছে। অশুভ চরম নয় কোথাও, শেষ কথাও নয় কোনো রচনায়। মানুষের প্রবৃত্তিকে চিত্রিত করে দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর উপন্যাসে। তুলনাবিহীন পাশবিক অন্ধকারের চিত্র আছে ‘চতুরঙ্গে’। কিন্তু সে প্রবৃত্তি মানবিকই, অশুভ নয় আধিদৈবিক। কোনো বিবেচনাতেই পাপ নয়; পদস্খলনের সম্ভাবনা শুধু। বিপরীত পক্ষে সে ব্যাধিও নয় সমাজের।
জীবনে দুর্ভোগ এত বেশি রূঢ় যে আমরা নতুন করে দুর্ভোগকে দেখতে চাই না সাহিত্যে। আমরা অন্তরাল চাই। সস্তা চলচ্চিত্র, চটুল গান, যৌন মাসিক-এসব বস্তু মধ্যবিত্ত বাঙালির পলায়ন কেন্দ্র। সাহিত্যেও তাই আছে, পলায়নের আকাক্সক্ষা আছে, খুব বড় করে লেখা। আধ্যাত্মিকতাও পলায়নের বাসনা থেকেই উদ্ভূত। সেখানে, আধ্যাত্মিক চিন্তায়, আত্মার সদগতি কামনা নেই, দৈহিক সুখের গোপন ও ভীরু লালসা আছে বড় হয়ে। নাটক যে আমাদের সাহিত্যের উজ্জ্বলতম অংশ নয় তার কারণ অবশ্যই দ্বন্দ্ব-ভীরুতা। রবীন্দ্রনাথের সফলতা নাটকেই সর্বাপেক্ষা স্বল্প। কেননা তাঁর নাটকে শুভের জয় পূর্বনির্ধারিত। আর তাঁর পাঠকও ট্র্যাজেডি চায়নি পড়তে, চেয়েছে রূপকথা-যা নাকি পুরস্কারে ও তিরস্কারে পরিপূর্ণ।
রবীন্দ্রনাথের তাই ট্র্যাজেডি লেখার কথা নয়-তিনি বাঙালি বলে। সেটাকে তাঁর দুর্বলতা বলার দরকার নেই, সেটা তাঁর প্রতিভার নিজস্ব স্বভাব। কোনো রূপকল্পে লিখেছেন লেখক তা দিয়ে তাঁর বিচার হয় না, বিচার হয় লেখার শিল্পমূল্য দিয়ে, শিল্পগত উৎকর্ষ দিয়ে। তদুপরি রূপকল্প হিসেবেও মহাকাব্য যে ট্র্যাজেডির পশ্চাদ্বর্তী এমন কথাও জোর দিয়ে বলার আবশ্যকতা দেখি না। কিন্তু মহাকাব্য রবীন্দ্রনাথ একবারই লিখেছেন, ‘গোরা’তে। তখন উদ্দীপনা ছিল সমগ্র দেশে, ঐক্য ছিল জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। সেই ঐক্য ও উদ্দীপনা একটা বড় বস্তু, তেমন বস্তু যার অভাব ঘটলে মহাকাব্য রচনা হয় না। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন একই সঙ্গে ঐক্য ও উদ্দীপনা এনেছিল এ দেশে, অন্তত দেশের সেই অংশে যে অংশে সামাজিক অবস্থান ছিল রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু পরে উদ্দীপনার অবসান ঘটেছে, ঐক্যও ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে নেতিবাচক শক্তিই ছিল প্রধান যখন তার লক্ষ্য অর্জিত হলো তখন অবসানের ক্লান্তিতে জাতীয় বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদ যতটা দ্রুত বিস্তারশীল হয়ে উঠল তত দ্রুত তার বিস্তার বোধ হয় আগে আর কখনো হয়নি। আপসপন্থিরা একদিকে গেলেন, নিরাপসবাদীরা অন্যদিকে। প্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্ত হিন্দুর স্বার্থ এবং উন্মেষকামী মধ্যবিত্ত মুসলিম স্বার্থে সংঘাত হয়ে দাঁড়াল অপরিহার্য। গ্রাম ও শহরের বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পেল ক্রমশ। নতুন কোনো ‘গোরা’ লেখা আর সম্ভব হলো না রবীন্দ্রনাথের মতো অসামান্য শিল্পীর পক্ষেও। সেই পথে আর গেলেন না তিনি, অসামান্য বলেই গেলেন না, সামান্য হলে, কবি কায়কোবাদ হলে যেতেন হয়তো এবং ব্যর্থ হতেন দৃষ্টিকটুরূপে। কেননা মহাকাব্য নিজস্ব সাংস্কৃতিক পটভূমি ছাড়া রচিত হয়নি কখনো, হতে পারে না কিছুতেই। অসাধারণ বাস্তববুদ্ধি ছিল রবীন্দ্রনাথের, তাই খণ্ড কবিতা লিখেছেন অজস্র, ছোটগল্প লিখেছেন বহু, উপন্যাস লিখেছেন অনেক ক’টি, কিন্তু মহাকাব্য আর লেখেননি, উদ্যমও নেননি লেখার। ‘চতুরঙ্গ’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘চার অধ্যায়’, ‘শেষের কবিতা’-সমগ্র দেশ এদের কোনোটিতেই আসেনি, এমনকি ‘যোগাযোগ’-এও নয়। ছোটগল্পে তো আসার কথাই ছিল না, কবিতাতে ততধিক।
মহাকাব্যিক প্রতিভা মহাকাব্য আর দ্বিতীয়বার লিখলেন না, ‘গোরা’কে ছাড়িয়ে গেল না সেই প্রতিভা, যা নিজেকে নিজে অতিক্রম করেছে সমগ্র জীবনে। এর কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজে নন, কারণ বাঙালি জীবনের বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা, নির্বেদ ও গ্লানি। যে ঐক্য ও উদ্দীপনা বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন একদিন সম্ভব করে তুলেছিল বাংলাদেশে আবার তার উদ্ভব হতে পারত যদি সূচনা হতো নতুনতর, প্রবলতর কোনো আন্দোলনের। সে আন্দোলনকে অবশ্যই হতে হতো সমাজতান্ত্রিক। কেননা অন্য কোনো আন্দোলনের পক্ষে সম্ভব হতো না শ্রেণিবিভক্ত সমাজে ঐক্য আনয়ন করা। ইংরেজবিরোধিতা বঙ্গভঙ্গ-রদের পরবর্তী সময়ে এক পথে অগ্রসর হয়নি, নানা পথে গিয়েছে-অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন প্রবল হয়নি বাংলাদেশে। হলেও তাতে রবীন্দ্রনাথের থাকার কথা ছিল না, বিপ্লব-পরবর্তী রুশ দেশ ভ্রমণ সত্ত্বেও নয়। শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত দৃঢ়কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছেন মানুষের প্রতি মানুষের অবিচারের বিরুদ্ধে, সভ্যতার গভীরে যে সংকট তাকে প্রকটিত করেছেন লেখার মধ্য দিয়ে, কিন্তু সমস্ত বক্তব্য যে একত্র ও এক হয়ে বৃহৎ কোনো রচনার আকার নেবে তা আর হয়ে ওঠেনি।
রবীন্দ্রনাথ যে শ্রেষ্ঠতম বাঙালি সেটা সত্য এদিক থেকেও যে, বাঙালি জীবনের বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতাকে তিনি যেভাবে প্রতীয়মান করে তুলেছেন শুধু লিখে নয়, না-লিখেও, তেমনটি অন্য কেউ পারেননি। পরবর্তীকালে বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পেয়েছে আরও, পাবে যে তার লক্ষণ রবীন্দ্রনাথেই ছিল। অন্যদিকে আবার এটাও লক্ষ্য করা খুব সহজ যে, ‘গোরা’র লেখক যখন ‘শেষের কবিতা’ লেখেন তখন যে তাঁর শক্তি বৈচিত্র্য ও সৃজন-বিপুলতাই শুধু প্রকাশ পায় তা-ই নয়, তদ্বারা মহাকাব্যের অপসৃয়মাণতাও প্রমাণিত হয়। বাক্যবীর অমিত রায় সেই অপসৃয়মাণতারই প্রতিভূ।
সাধারণভাবে বলতে গেলে বলা যায়, বড় লেখকেরা দুই শ্রেণির, শেকসপিয়রের মতো নাটকীয়, অথবা টলস্টয়ের মতো মহাকাব্যিক। রবীন্দ্রনাথ মহাকাব্যের লেখক, তবু তিনি টলস্টয়ের মতো নন, সম্পূর্ণত। রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতা টলস্টয়ের নেই। দরিদ্র দেশে আধ্যাত্মিকতা না থাকলেই নয়। জীবনে যে ব্যক্তি স্বপ্নের মতো সমৃদ্ধ তার পক্ষে স্বপ্ন না দেখলেও চলে; কিন্তু যে ব্যক্তি দরিদ্র স্বপ্ন না থাকলে তার জীবন থাকে না। বস্তুর অভাব ঘটলে আধ্যাত্মিকতার সুবিধা হয়, বিশেষ রকমের। রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই আধ্যাত্মিক ছিলেন না ওই নোংরা বস্তুতান্ত্রিক অর্থে। তাঁর জীবনে বস্তুর অভাব ছিল না, কিন্তু তাঁর বাঙালি সত্তা, তাঁর সামাজিক ঐতিহাসিক চরিত্র যে তাঁকে অনিবার্য হাতে আধ্যাত্মিকতার পথানুসরণে বাধ্য করছে, সে বিষয়ে সন্দেহ কোথায়। সমৃদ্ধ দেশে জন্মগ্রহণ করলে রবীন্দ্রনাথ আধ্যাত্মবাদী হতেন না। হয়তো হতেন বীরত্ববাদী, হয়তোবা বুদ্ধিবাদের প্রবক্তা।
বাঙালি জীবনে শ্রেণিভেদ ও সামন্তবাদী সংস্কৃতির অত্যন্ত গভীর অবস্থান জীবনের সব ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে, বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে, বলা যায় বীরকে, গুরুত্ব দিয়েছে অত্যধিক, এবং সর্বদাই সচেষ্ট থেকেছে সুবিধাভোগী শ্রেণির নেতৃত্বকে অক্ষুণ্ন রাখতে। এ মানসিকতা এমনকি রবীন্দ্রনাথকেও অব্যাহতি দেয়নি। একদিকে তিনি মহাপুরুষের কথা বারবার বলেছেন, প্রতীক্ষা করেছেন মহামানবের, অন্যদিকে আবার একক উদ্যম নিয়েছেন স্থাপন করবেন আদর্শ খামার, আদর্শ বিদ্যালয়, আদর্শ সমবায় ও গ্রাম। মহামানবিক একক উদ্যমে একাকী হয়ে পড়েছেন, সফলতা আসেনি, নাড়া খায়নি সমাজ। নেতৃত্ব থেকেছে ব্যক্তির হাতে, ব্যক্তি উপচে শ্রেণির হাতে কখনো কখনো হয়তোবা, কিন্তু তার বাইরে কখনো যায়নি, যায়নি জনসাধারণের কাছে, এবং ব্যর্থতার কারণও এখানেই ছিল, জনসাধারণের এ অংশগ্রহণ না করায়। রবীন্দ্রনাথের পর সামন্তব্যবস্থা ক্রমশ ক্ষীণ হয়েছে। প্রবল হয়েছে মধ্যবিত্ত।
রবীন্দ্রনাথ বারংবার বলেছেন তিনি রোমান্টিক! আমারে শুধাও যবে, ‘এরে কভু বলে বাস্তবিক’? আমি বলি, ‘কখনো না, আমি রোমান্টিক’ (‘নবজাতক’)। আরও স্পষ্ট কথা আছে ‘সানাই’য়ে : এ গলিতে বাস মোর, তবু আমি জন্ম রোমান্টিক। গলিতেই বসবাস বাঙালির, তবু সে জন্ম রোমান্টিক। গলিকে গলি বলে মানে না, থেকে থেকে খোঁজে দক্ষিণের বাতাস, খোঁজে অলক্ষ্য আকাশ। ফলে গলি গলিই থেকে যায়, বদলায় না, বাতাস থাকে অবরুদ্ধ, আকাশ অলক্ষ্য; শুধু হালকা কল্পনা থাকে সজাগ। হরিপদ কেরানিরা আকবর বাদশার সঙ্গে আত্মীয়তা বোধ করে অত্যন্ত সন্তুষ্ট থাকে। ‘ছিন্নপত্র’তে রবীন্দ্রনাথ পল্লীর চিত্র দিয়েছেন এ রকম : ‘যখন গ্রামের চারিদিকের জঙ্গলগুলো জলে ডুবে পাতা-লতা-গুল্ম পচতে থাকে, গোয়ালঘর ও লোকালয়ের বিবিধ আবর্জনা চারিদিকে ভেসে বেড়ায়, পাট পচানির গন্ধে বাতাস ভারাক্রান্ত, উলঙ্গ পেটমোটা পা সরু রুগ্ন ছেলেমেয়েরা এখানে-সেখানে জলে-কাদায় মাখামাখি ঝাঁপাঝাঁপি করতে থাকে, মশার ঝাঁক স্থির জলের ওপর একটি বাষ্পস্তরের মতো ঝাঁক বেঁধে ভেসে বেড়ায়, গৃহস্তের মেয়েরা ভিজে শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বাদলার ঠান্ডা হাওয়ায় বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে হাঁটুর উপরে কাপড় তুলে জল ঠেলে ঠেলে সহিষ্ণু জন্তুর মতো ঘরকন্নার নিত্য কর্ম করে যায়-তখন সে দৃশ্য কোনোমতেই ভালো লাগে না! ঘরে ঘরে বাতে ধরছে, পা ফুলছে, সর্দি হচ্ছে, জ্বরে ধরছে, পিলেওয়ালা ছেলেরা অবিশ্রাম কাঁদছে, কিছুতেই কেউ তাদের বাঁচাতে পারছে না-এত অবহেলা, অস্বাস্থ্য, অসৌন্দর্য, দারিদ্র্য, মানুষের বাসস্থানে কি এক মুহূর্ত সহ্য হয়।’ কিন্তু এই পল্লী ভিন্নতর হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতায়, তার বাস্তবতার জায়গায় জেগে উঠেছে কাব্যময়তা। ‘যেতে যেতে পথপাশে/ পানা পুকুরের গন্ধ আসে/ সেই গন্ধে পায় মন/ বহুদিন রজনীর সকরুণ স্নিগ্ধ আলিঙ্গন।’- এমন ক্ষেত্রে পানাপুকুরের দুর্গন্ধ সত্য নয়, সত্য অন্য এক অনুভবের আনন্দ। বাস্তববিনাশী এ রোমান্টিসিজমের মধ্যে যে বাঙালিত্ব আছে তা রবীন্দ্রনাথেও ছিল।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়