শুক্রবার, ৭ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা
পর্ব ৩

একুল নেই ওকুল নেই

সমরেশ মজুমদার

একুল নেই ওকুল নেই

[পূর্বে প্রকাশের পর]

হাসল শিবকুমার। বলল, ‘দেশ থেকে আসার আগে আমি অথবা আমার রুমমেটদের কেউ রান্না করতে জানতাম না। এ দেশে এসে ধাক্কা খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। আর অনেক রকম রান্না করার সময় তুমি পাবে না। দরকার নেই। দুই বেলা মোটামুটি খাওয়ার মতো রান্না কদিনের মধ্যেই ঠিক পেরে যাবে। আর যেটুকু রান্না করার জন্য যা দরকার তা কিনে নিতে বেশি খরচ হবে না।’ তারপর হেসে বলল, ‘আরে, অফিস থেকে ফিরে এসে প্রচুর সময় বসে থাকতে হয়। সে সময় রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করলে দেখবে ভালোই লাগবে। তা ছাড়া দেখবে, খাওয়ার খরচ অর্ধেক কমে যাবে মাসখানেকের মধ্যেই। আচ্ছা, আমি চলি।’

‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।’

‘আরে! ভদ্রতা করছ কেন, ওহো আমরা আগামীকাল লনের বাইরে যাচ্ছি, অবশ্য কালই ফিরে আসব। পর দিন অফিস আছে।’

‘কোথায় যাচ্ছ?’

‘লাস ভেগাস’, হাসল শিবকুমার।

‘সেখানে দেখার কী আছে?’

‘নাম শোনোনি? লাসভেগাস হলো এ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জুয়া খেলার শহর। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ওই শহরে ছুটে যায় জুয়া খেলতে। আমরা যাচ্ছি ওই শহরের ক্যাসিনোগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে।’ হাসল শিবকুমার। ‘তোমার কী যাওয়ার ইচ্ছে আছে?’

‘যে কোনো নতুন জায়গায় যেতে তো ইচ্ছে হয়, কিন্তু খরচ কী রকম হবে?’ ইতস্তত করে কমল।

‘এমন কিছু না, খুবই সামান্য। চল তাহলে।’ হাত মেলাল শিবকুমার।

‘তবু যদি আন্দাজ পেতাম তাহলে-’

‘শোনো। এর আগে আমি একবার গিয়েছিলাম। ক্যাসিনোর বাসে গেলে ওরা যে ভাড়া নেয় তা পৌঁছেই ফেরত দিয়েছিল। অর্থাৎ যাতায়াত একদম বিনা পয়সায়। তুমি যদি জুয়া খেলতে না চাও তাহলে কেউ তোমাকে জোর করবে না। খরচ হবে যখন খাবার কিনে খাবে। সে খরচ নির্ভর করবে তোমার ওপর, তুমি যেমন খাবে তেমন খরচ হবে।’ হেসে কথাগুলো বলল শিবকুমার।

খুব ইচ্ছে করছিল কমলের। এ রকম জুয়ার শহরের গল্প সে আগেও শুনেছে কিন্তু উৎসাহী হওয়ার কোনো কারণ দেখেনি। শিবকুমার যা বলল তাতে খাওয়ার খরচ ছাড়া যখন অন্য কোনো খরচ হবে না তখন পর দিন সকালেই সে বাড়িওয়ালির কাছে গিয়ে অগ্রিম ভাড়া দিয়ে সই করা চুক্তিপত্র নিয়ে এলো।

আমেরিকার বিষয়ে অনেক গল্প কমল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শুনেছে। ওই দেশের বেশির ভাগ মানুষই বিদেশি হিসেবে কাজের সন্ধানে এসে এক সময় আমেরিকার নাগরিক হয়ে গেছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে আমেরিকা সম্পর্কে বিরূপ ভাবনার প্রকাশ পেতে তেমন দেখা যায় না।

সাতসকালে তৈরি হয়ে নিয়েছিল কমল। যে ভদ্রলোক তাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি ঠিক সময়ে পৌঁছে গেলেন। কমলকে দেখে হাসিমুখে বললেন, ‘বাহঃ আপনি তো ঠিক সময়ে তৈরি হয়ে গিয়েছেন। চলুন যাওয়া যাক।’

সকাল ১০টার মধ্যে স্লান সেরে পরিচিত দোকান থেকে খাবার কিনে খেয়ে নিল সে, তার মনে হলো, এতে বিকেল পর্যন্ত দিব্বি থাকা যাবে।

একটু ভালো জামাপ্যান্ট পরে সে তৈরি হয়ে ছিল। লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে শীতকালে ঠান্ডা খুব কম পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের তাই এ শহরে থাকতে কোনো কষ্ট হয় না। ১২টা নাগাদ শিবকুমার এসে বলল, ‘চল, হেঁটেই যাই।’

‘আমরা বাস না ট্রেনে যাব?’ জিজ্ঞাসা করল কমল।

‘বাসে যাব। ক্যাসিনো কোম্পানির বাস। চল।’

সুন্দর চেহারার বাস পরপর দাঁড়িয়ে। শিবকুমারকে দেখে তিনজন মধ্যবয়সী ভারতীয় এগিয়ে এলো। ‘চল আর পাঁচ মিনিট পরে বাস ছাড়বে।’

তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল শিবকুমার। ওরা একসঙ্গেই থাকে। দুই পাশে মুখ ঘুরিয়ে দেখে শিবকুমার জিজ্ঞাসা করল, ‘ম্যাডাম এখনো আসেননি?’

একজন জবাব দিল, ‘ঠিক সময়ে এসে বাসে উঠে গেছেন।’

বাসের দুই সিটের ভাড়া ষোল ডলার। কমলের কাছ থেকে ওর ভাড়ার টাকা চেয়ে নিয়ে টিকিট কিনে আনল শিবকুমার। পাঞ্চ করিয়ে বাসে উঠে সিটে বসে কমল দেখল তার জায়গা ওই চারজনের সঙ্গেই হয়েছে। ওদের উল্টো দিকের জানালার পাশে রোদচশমা পরা যে মহিলা বসে আছেন তার পরনে প্যান্ট-শার্ট। একটা হাত তুলে শিবকুমারকে নিঃশব্দে জানালেন, তিনি এসেছেন।

আমেরিকার এ অঞ্চল সবুজে মোড়া নয়। বরং গাছপালা বেশ কম, ঘাসের দেখা অনেক জায়গায় পাওয়া যাচ্ছিল না। একঘেয়ে হয়ে যাওয়ায় চোখে তন্দ্রা নামছিল। যখন বাস থামল তখন চোখ খুলে সুন্দর ঝকঝকে বিশাল বাড়ি দেখতে পেল। সবার সঙ্গে নিচে নেমে শিবকুমার ভদ্রমহিলাকে বলল, ‘আপনার সঙ্গে তো ওর পরিচয় হয়নি। কিছুদিন আগে দেশ থেকে এসেছে কমল। কমল, দিশা আমাদের সহকর্মী।’

কমল কথা বলার আগেই দিশা বলল, ‘আর একজন পরিচিত মানুষের সংখ্যা বাড়ল। আপনার কথা অফিসে শুনেছি। চলুন, ভিতরে যাই।’

একের পর এক বাস আসছে আর যাত্রীকে নিয়ে নেমে ক্যাসিনোর ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। ঢোকার সময় পর পর কাউন্টার। মেলার বাসের টিকিট দেখলে তার ওপর স্ট্যাম্প মেরে ফেরত দিয়ে দিচ্ছে। তারপর অনেকটা প্যাসেজ পার হয়ে আসার পর বিরাট হলঘরে পৌঁছে অবাক হয়ে গেল কমল। চারপাশ থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে।

পরপর রয়েছে কয়েন কেনার বাক্স। পাঁচ সেন্ট থেকে এক ডলার। পকেটের ডলার বের করে কাউন্টার থেকে কয়েন কিনতে হবে। তারপর সামর্থ্য অনুযায়ী বাক্স বেছে নিতে হবে। বাক্সের গর্তে কয়েন ফেলে হাতল ধরে টেনে অথবা মেশিন চালু করার জায়গায় চাপ দিলে সামনের মেশিন চালু হয়ে যায়। কপাল ভালো থাকলে মেশিন থেকে কয়েক গুণ বেশি কয়েন বেরিয়ে আসে। পেছনে দাঁড়িয়ে কমল লক্ষ্য করল একের পর এক কয়েন ফেলেও কেউ রিটার্ন পাচ্ছে না, কেউ দুই তিনবারেই পঞ্চাশ সেন্ট থেকে পাঁচ ডলার যন্ত্রের পেট থেকে বেরিয়ে আসছে।

ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল কমল, কত মেশিন এবং তাতে খেলছে কত মানুষ তা গুনে শেষ করতে পারল না সে। সে দাঁড়িয়ে দেখল একটি তরুণ বাক্সের মধ্যে একের পর এক কয়েন ফেলে কিছু না পেয়ে হতাশ হয়ে উঠে দাঁড়াল। সে কৌতূহলী হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘উঠে যাচ্ছেন?’

তরুণ মাথা নাড়ল, ‘নো লাক।’

‘কত হারলেন?’

তরুণ খুব বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘সেটা জেনে তোমার কী লাভ?’ বলে চলে গেল তরুণ। এ সময় একজন বৃদ্ধ এসে তরুণের ছেড়ে যাওয়া মেশিনের সামনেই খালি চেয়ারে এসে বসে বাক্সের গর্তে কয়েন ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ঝনঝন করে শব্দ হতে লাগল। আলো জ্বলে উঠল মেশিনের ওপর। তারপর ঝরঝর করে মেশিনের পেট থেকে কয়েন বেরিয়ে সামনের ট্রেতে পড়তে লাগল। পড়তে পড়তে স্তূপ হয়ে গেল কয়েনের।

একজন কর্মচারী ছুটে এসে সেসব কয়েন তুলে নিয়ে বৃদ্ধকে বললেন তার সঙ্গে যেতে। ওরা চলে গেলে একজন প্রৌঢ় যে কমলের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল, বলল, ‘একেই বলে কপাল। ওই ইয়ংম্যান আর একবার কয়েন ফেলে বোতাম চিপলেই কয়েক শ ডলার পেয়ে যেত।’

শুনে কমল বলল, ‘সেটা তো আগে বোঝা যায়নি।’

‘হ্যাঁ। এজন্যই বলে ভবিষ্যৎ বোঝা যায় না।’

কমল ভাবছিল টিকিটের ফেরত পাওয়া দাম দিয়ে কয়েন কিনে কোনো একটা মেশিনের সামনে বসে যাবে কি না। কিন্তু তার সাহস হচ্ছিল না। যদি ওই তরুণের মতো তার অবস্থা হয় তাহলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হাত খালি হয়ে যাবে। নিজেকে বোঝাল, কী দরকার।

হঠাৎ চোখে পড়ল একটি মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দিশা। অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে মেশিনটাকে দেখছেন। কিন্তু ওকি? ভদ্রমহিলার হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট থেকে হালকা ধোঁয়া বের হচ্ছে।

খুব অবাক হয়ে কমল দেখল দিশা মেশিনে খেলা শুরু করল। তার আঙুলের ফাঁকে গোঁজা সিগারেটটা নিয়ে সে একটুও মাথা ঘামাচ্ছে না। যন্ত্রের মতো হাত ওপরে উঠছে, ঠোঁটের কাছে সিগারেট চলে এলে সে অল্প টান দিচ্ছে কিন্তু মনোযোগ খেলার ওপর। কোনো বাঙালি অল্প বয়সী দূরের কথা, মধ্যবয়সিনীকেও কমল এ রকম স্বচ্ছন্দে সিগারেট খেতে কোনো দিন দেখেনি।

কমল শ্বাস ফেলল। সে সময় দিশা মুখ ফিরিয়ে কমলকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়ল। কিন্তু কথা না বলে আবার খেলায় মন দিল। একটু সহজ হলো কমল। সেটা যখন আবার হয়ে গেল তখন সরে না গিয়ে দেখা যাক মহিলার কপাল কী রকম।

এবার দিশা বোতাম টিপতেই কয়েন পড়ার শব্দ হলো। তিনবার। অর্থাৎ খুব সামান্য লাভ হলো। কয়েন কুড়িয়ে নিয়ে কাছে এসে দিশা বলল, ‘জানেন, আমার গ্যামলিংয়ে একটুও লাক নেই।’ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিশা বলল, ‘চলবে?’

‘না। আমি স্মোক করি না।’ মাথা নাড়ল কমল।

‘বাঃ! গুড বয়।’ হাসল দিশা।

‘বাঃ, তা ঠিক নয়। খাওয়া হয়ে ওঠেনি।’

‘আপনি খেলছেন না?’

‘প্রথমবার এলাম তো, তাই একটু ঘুরে ঘুরে দেখছি।’

‘এগুলো আট আনার কয়েন। এখানে এক টাকার বেশি কোনো কয়েন বাক্স নেই। পাঁচ বা দশ ডলার বক্স হলে-;’ বলে মাথা নাড়ল দিশা, ‘হেরে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

‘তার মানে প্রতিবার দশ ডলারের কয়েন গর্তে ফেলতে হয়?’ চোখ বড় হয়ে গেল কমলের।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। খেলবেন নাকি?’ হাসল দিশা।

‘পাগল?’

‘তাহলে আপনি ঘুরে ঘুরে দেখুন। আমি পকেট খালি করি।’

‘ঠিক আছে।’ সরে এলো কমল। নিজের পকেট নিজেই খালি করে কেউ! করার আগে হাসিমুখে বলতে পারে!

ঘুরতে ঘুরতে দূর থেকে শিবকুমারদের দেখতে পেল সে। শিবকুমার তাকে দেখে হাত নাড়ল। কাছে যেতে শিবকুমার বলল, ‘আজ আমরা নিজেদের পয়সায় লাঞ্চ করছি না। আমি পঞ্চাশ ডলার জিতেছি। তাই দিয়ে লাঞ্চ হয়ে যাবে।’ তারপর চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল। ‘ম্যাডাম কোথায়? দেখা হয়েছে?’

উত্তরের দরকার হলো না। ভিড়ের ভিতর থেকে এগিয়ে এলো দিশা।

শিবকুমার তাকে অর্থ প্রাপ্তির খবরটা হাসিমুখে দিলে দিশা বলল, ‘ভগবান যে একজন পুরুষ মানুষ তা আর একবার প্রমাণিত হলো।’

‘তার মানে?’ অজান্তেই প্রশ্নটা বেরিয়ে এলো কমলের মুখ থেকে।

‘এ তো সোজা কথা। তিনি সব সময় পুরুষদের স্বার্থ দেখেন।’ দিশা হাসল।

‘তার মানে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী কি ভগবান নন?’ শিবকুমারের বন্ধুদের একজন একটু তোতলা গলায় প্রশ্নটা করল।

‘না মশাই। তারা ভগবানের স্ত্রী অথবা কন্যা। কিন্তু কেউ অলমাইটি ভগবান নন। তিনি পৃথিবীর সর্বময় কর্তা, যাকে বলে অলমাইটি। আচ্ছা, আপনি যদি আচমকা ব্যথা পান তাহলে কী বলে ওঠেন? বলেন, উঃ ভগবান! কখনো কি বলেন উঃ লক্ষ্মী? বলেন না। থাকগে বেশি দেরি নেই একজন মহিলা ভগবানকে ঠিক পেয়ে যাব আমরা।’ হাসতে হাসতে বলল দিশা।

‘মহিলা ভগবান? কথাটা কানে লাগছে। আপনি কি ভগবতী বলতে চাইছেন?’

‘না না। ভগবতী বললেই মনে হবে ইনি ভগবানের স্ত্রী। ভগবানের কথায় ওঠেন বসেন। মহিলা ভগবান যিনি হবেন তিনি একজন আলাদা শক্তি। যাক গে, এসব কথা ছাড়ুন। আপনারা কি এখান থেকে বেরিয়ে কোথাও যাচ্ছেন?’ জিজ্ঞাসা করল দিশা।

এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল শিবকুমার। যেহেতু দিশার কথাগুলো ইংরেজিতে তাই ওদের মুখে হাসি ছিল। বোঝা যাচ্ছিল বেশ মজা পাচ্ছে। শিবকুমার বলল, ‘চলুন, আমরা লাঞ্চ করে আসি। আজকের লাঞ্চ এখানে যা জিতেছি তা দিয়েই হয়ে যাবে।’

‘জিতেছেন?’ চোখ বড় করল দিশা, ‘কত?’

অঙ্কটা শুনে অভিনন্দন জানাল দিশা। পেছনের দিক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে মুগ্ধ হয়ে গেল কমল।   

[চলবে]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর