শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

উর্দু রোডের বাড়িটি

শামীম আজাদ

উর্দু রোডের বাড়িটি

স্নেহের চিনা

বেশ কদিন ধরে তোমাকে চিঠি লিখতে চাইছি। লিখছিও। কিন্তু কিছু দূর লেখার পর মনে হয় যা লিখেছি তা লিখতে চাইনি। যা চাইছি তা লিখতে পারিনি। আবেগে চোখ ভিজে গেছে। এমনো হয়েছে, যে লেখা শুরু করে চা বানিয়ে ফিরে এসে চায়ে চুমুক দিয়ে মাত্র লিখে যাওয়া কথাগুলোই অর্থহীন মনে হয়েছে। তাই ডিলিট করে আবার সেই লিখতে শুরু করেছি। আগের কাল হলে আজ আমার লেখার টেবিলের নিচটা ভরে যেত আধা লেখা চিঠির ছেঁড়া পাতায় পাতায়।

চিনা, তোমাকে প্রথম দেখি পুরান ঢাকার উর্দু রোডের ৯ হায়দার বক্স লেনের অদ্ভুত এক বাড়িতে। এমন আকর্ষণীয় সেই বাড়িটি যে মাঝে মাঝেই মনে হতো, এ বাড়িতে কোনোক্রমে একবার, মাত্র একবার হুমায়ূন আহমেদকে এনে ছেড়ে দিলে হতো! তিনি তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, রোয়ায় রোয়ায় গল্প খুঁজে পেতেন। হয়তো এখানেই ধারণ করতেন শাওনের গাওয়া সে বিখ্যাত গান...যদি মন কাঁদে... তুমি ফিরে এসো এক বরষায়। চিনা, আমি থাকি বিলেতে, লন্ডনে কতদূরে আর তোমাদের কেউও সেখানে থাক না তবু আমার মন কাঁদে তোমাদের সেই অত্যাশ্চর্য বাড়িটির জন্য।

চিনা নামে তোমায় চেনে অল্প কিছু লোকে। আর হয়তো চেনে পাশের উর্দু রোডের লোক। সবাই চেনে ডিজাইনার এমদাদ হক নামে। আমি তোমাকে চিনি তোমার আপার কল্যাণে। আমার বন্ধু বাবলী, মানে লেখক বাবলী হক তোমার বড় বোন।

 

***

পঞ্চাশ বছর আগের কথা। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে, তখন আমার আর বাবলীর অকারণ হাসাহাসির কাল। সারা দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শর্ষে খেতে সোনার গুঁড়ো উড়িয়ে ক্লাস শেষে লাইব্রেরির সামনে গিয়ে উঠে পড়তাম তোমাদের গাড়িতে। সে প্রথম দিনে লাল টয়োটা গাড়িটি চালাচ্ছিল তোমাদের গম্ভীরমুখো পুরনো বিশ্বস্ত ড্রাইভার নাজির। পুরান ঢাকার লোক ওই নাজিরকে আমার কেন যেন তোমার বাবার স্পাই মনে হতো। মনে হতো আমরা ক্লাস পালিয়ে যেখানে যেখানে গেছি দিন শেষে সে তার সবই চাচাকে রিপোর্ট করে দেয়। কারণ চাচা তো আর দেবতা নন। কিন্তু তিনি কী করে টের পেয়ে যান সব!

তোমার তখন পাঁচ বা ছয় বছর বয়স আর আমরা অষ্টাদশী। একজোড়া নবীন লেখক। আমাদের বন্ধু ও সহপাঠী আলী ইমাম, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, শাহরিয়ার কবির, নুরুল করিম নাসিম এমনকি নির্মল দা মানে নির্মলেন্দু গুণ এবং হেলাল হাফিজও। তাই নাজিরের সব রিপোর্ট ছিল সত্যি। আমরা কোনো একদিন বাংলাদেশের বিখ্যাত দুই কবি ও লেখক হব বলে সারা দিন ললনা, ইত্তেফাক, পূর্বদেশ, চিত্রালী অফিস, বাংলা একাডেমি ঘোরাঘুরি করতাম। লেখা দিতে, বিল নিতে, পাঠে বা নিছক আড্ডায়। স্টেডিয়ামের কাছে ইগলু আইসক্রিম খেতে খেতে সাহিত্য তর্ক করতাম। কখনো ক্লাসের ফাঁকে, কখনো ক্লাস ফাঁকি দিয়ে।

সেদিনও সেগুনবাগিচা ললনা অফিসে আখতার ভাইয়ের কাছে লেখা দিয়ে তোমাদের বাড়ি গেছি। ঘড় ঘড় শব্দ করে করে বিশাল সে লোহার গেট খুলতে লাগলে ভিতর থেকে ডিজনি ল্যান্ডের বিস্ময়ের মতো উঠে দাঁড়াল এক চারতলা বাড়ি। গাড়ি থেকে নামতেই আমার চোখ গেঁথে গেল তার দেয়ালে দেয়ালে। কে জানে কত পুরনো এ বাড়ি! মাথা তুলে দেখি এর অঙ্গে অঙ্গে কে যেন বাজিয়ে গেছে সময়ের আশাবরী। ত্বকে তলায় তলায় তার দাগ পড়ে আছে। পরে ধীরে ধীরে ক্রমশ দেখেছি এর ছোট বড় চৌকোণ, ত্রিকোণ ও আয়তাকার আকারের তেত্রিশের ওপর কক্ষ ও সাড়ে বারো বারান্দার এ বাড়ির একেক তলার গঠনশৈলী যে একেক রকম। প্রত্যেক তলারই যেন রয়েছে একেকটি কারণ। নিচের তলার কুটুরি মার্কা কক্ষ থেকে উপরে উঠতে উঠতে দালানের কক্ষ সংখ্যা ক্রমশ কমে কমে আকার বড় হতে হতে চারতলায় এসে একেবারে নতুন ঢাকার গুলশান-বনানীর মতো খোলামেলা হয়ে গেছে। স্থাপত্যগাঁথা বাংলাদেশের নবাবী আমল থেকে যাত্রা শুরু করে গিয়ে পৌঁছেছে একদম ফরাসি পেন্ট হাউসে। প্রথম দিন আমি মাথা কাত করে দেখার চেষ্টা করছিলাম বাড়ির সব চেয়ে উপরের তলাটা পাশের বাড়ির সূর্যের আলোর সঙ্গে কোথায় ধাক্কা খাচ্ছে!

তিমি মাছের পিঠরঙা গথিক স্টাইলের খোঁচা খোঁচা সুবিশাল লোহার গেট পেরিয়ে গাড়ি থেকে নেমেই দেখি বিশাল এক সিংহ সদৃশ অ্যালসেশিয়ান। তার নামকরণ করা হয়েছে পাকিস্তানি পালোয়ান ভুলুর নামানুসারে। বাঁধানো চত্বরের এমন আয়েশী ভঙ্গিতে হাঁটছে যেন সে পিলারের কাছে শিকলবদ্ধ নয়। যেন সে পুরান ঢাকার সারমেয় সম্রাট। আহার সম্পন্ন করেছে বলেই কিনা জানি না কোনো শব্দ করল না। বরং একটা বড় হাই ছাড়ল। আমি তার তীক্ষè দাঁতগুলো দেখলাম। সাদা-কালো কেশর যেন চিরুনি করা। সামনেই একটি গোলাকার অ্যালুমিনিয়ামের থালায় পড়ে আছে গরুর বড় বড় হাড়। কুকুরের স্বাস্থ্য ও হাড়ের সাইজ দেখে বুঝলাম- এ বাড়ির মানুষ খায় দায় ভালো। সেদিনই তার প্রমাণ পেয়েছি। তবে পরে আরও যা দেখেছিলাম তা হলো এরা দেয়ও অনেক। সোবহানবাগের তিন কক্ষের ছোট্ট সরকারি ফ্ল্যাটে থেকে অভ্যস্ত আমি বুঝছিলাম না কোথা থেকে কোথায় যাব।

 

***

নিচের ওই চত্বরেই তোমাদের বাড়ির বিয়ে আচার অনুষ্ঠানের জন্য সব রান্নাবান্না, কাটাকুটা হতো। কুয়োর মতো গভীর গর্ত ও ধারওলা বিশাল বিশাল হাঁড়িতে হতো কাচ্চি বিরিয়ানি, ঘিয়ে ভাজা পেস্তা বাদামের সঙ্গে আনারস, খয়েরি মাওয়া আর ছোট ছোট মোরব্বা কুঁচো দেওয়া খুশবুদার সোনালি জর্দা। পুরান ঢাকার হাজী বাবুর্চি টুপি পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরে মুখে খুশবুদার পান পুরে নিজে একবার তদারকি করে যেতেন। আর তার সাগরেদরা কোমরে গামছা বেঁধে রান্নার সময় হাঁড়িতে বাড়ি মেরে মেরে একটা হল্লা লাগিয়ে দিতেন। বাবলীর ঘর থেকে সব শোনা যেত।

সামনে ও পাশে ছোট ছোট সবুজাভো ঘরগুলোয় কাঠের কড়ি-বরগা। দরোজার দৈর্ঘ্য কম আর জানালাও ছোট ছোট। দেখি সে জানালায় কাঠের শিকের নিচে আবার একটুখানি আলসেও আছে! কংক্রিট চত্বরে ভারি ও চৌকোণা থামের পাশে একফাঁলি পিচ্ছিল বারান্দা। দেখতে সরু এক ভেজা শাড়ি শুয়ে আছে মনে হলো। পুরো নিচের তলাটা এত ঠাণ্ডা যে মনে হলো তা ফ্রিজের ভিতর বসা। পাশেই কোথাও নিশ্চয়ই কলের জল। না হলে সেখান থেকে স্নান সেরে খালি গায়ে একটা লোক কি করে বেরিয়ে এলো! বাবলী তাকে চেনে না। কিন্তু সে বাবলীকে চেনে। বাবলী যে এই বাড়ির ডাকসাইটে কর্তার সব চেয়ে বড় সন্তান তা সে জ্ঞাত আছে। আমাদের দেখে গা মোঝামুছি থামিয়ে সালাম না হলেও একটা সালাম মার্কা ভাব দিল। আমি বুঝে গেলাম উর্দু রোডের আবওয়া। বুঝে গেলাম এ বাড়িতে আমার বন্ধুর সুশক্ত অবস্থান। আর তারই অন্যতম বন্ধু বলে আমার গুরুত্বও কম না।

চিনা, তুমি জানো পরে ধীরে ধীরে আমার সে স্থান তোমাদের পরিবার ছাড়িয়ে খালাতো ফুপুতো ভাইবোন বকুল, পারুল, নম্মু, ইতি, মনি দা, রাইসুল দা, খোকন দা-ভাবি, অভিনেতা সাইফুদ্দিন চাচা কিংবা গ্রাম থেকে আসা ফুপু পর্যন্ত ব্যপ্ত হয়েছিল। অদ্যাবধি সে মায়ার টান অবশিষ্ট আছে বলে আন্দাজ করি। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি সেই স্বপ্নের মতো বাড়িটারই বাসিন্দা ছিলাম।

 

***

সে ছিল ১৯৬৯ সাল। সে সময় তোমার দুরন্ত বড় দুই ভাই পিন্টু ও মিন্টু পাকিস্তানের এক আবাসিক স্কুলে বা কলেজে পড়ত। বাড়িতে ছিলে তোমরা বাকি তিন ভাই। একহারা ও অনেক লম্বা সেন্টু নবকুমার ইনস্টিটিউটে সম্ভবত নবম বা দশম ক্লাসে পড়ত। ওর সঙ্গেই ছিল আমার আর বাবলীর বেশি ভাব। তখনো বিজলীর জন্ম হয়নি বিধায় তুমিই ছিলে সর্বকনিষ্ঠ। রেন্টু তোমার পিঠাপিঠি। তোমরা পড়ছিলে উদয়ন স্কুলে। বাবলী বকশিবাজার কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে পাস করে ভর্তি হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমারই সঙ্গে বাংলায়। সে সময়ই তার প্রথম উপন্যাস ‘সুখ নদীতে’ ধারাবাহিকভাবে ললনায় বেরোচ্ছে। আমার ছোটগল্প সমকালে উঠবে বলে অপেক্ষা করছি। আর এসব নিয়ে দুই সখী সর্বক্ষণ উত্তেজিত থাকি। 

দোতলায়ও আবার আরও বেশ কটা নানান মাপের কক্ষ এবং যথারীতি বাড়িটির তিন দিক থেকে তিন রকমের সিঁড়ি। যা কাণ্ড! তলায় তলায় মানুষের বসবাস। বহু পরে বুঝেছি কী কারণে সারাক্ষণ তোমাদের খাবার টেবিলে খাবার ঢাকা দেওয়া থাকত। কেউ হয়তো চিকিৎসা করাতে কুমিল্লা থেকে এসেছে। কেউ হয়তো এসেছে পুরান ঢাকার আদালতপাড়ায় তার মামলার তদবিরে। কেউ এখানে থেকে করছে কলেজে পড়াশোনা। আমার ধারণা, শুনে বাবলী বললে, আবার কেউ কেউ এ বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া ছাড়া আর কিছুই করছে না। এ কথা শুনে আমি হেসে উঠি আর সরু ও খাড়া সিঁড়িগুলো বেয়ে ওপরে উঠতে থাকি।

তোমাদের নিউক্লিয়াস পরিবারের বসবাস শুধু তিন ও চারতলায়। সে আবাসনের শুরু আড়াই তলা থেকে। ওখানে সিঁড়ির বাঁ-দিকে এক চিলতে চৌকোণ উঠান এবং অতি ছোট একটা রান্নাঘর। রান্নাঘরের বাইরে কোণে আল বাঁধানো কলতলা। শূন্য একটি কাপড় শুকানোর তার এধার থেকে ওধারে চলে গেছে। তাতে কোনো পাখি নেই নেই কাপড়ও। আড়াই তলাতেই এ সাম্রাজ্যের রানিজিকে পাওয়া গেল। তাঁর শ্যামলা ও সুগোল হাত জোড়ায় ঝকমক করছে সোনার চুড়ি। কানে মুক্তোর ফুল। তাঁর চুল টেনে পেছনে বাঁধা। পান পাতার মতো মিষ্টি ও সুখী মুখখানা থেকে মায়া গলে পড়ছে আর সুস্বাস্থ্য জড়িয়ে কাঁধে উঠে গেছে একটি নরম রঙের ছাপা শাড়ি। সেটি কৃত্রিম আঁশ না সুতির তা ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে ব্লাউজটা ছিল নরম কাপড়ের, হয়তো রুবিয়া ভয়েলের। হাফহাতা বাসি ব্লাউজটা হাতার কাছে কুঁচকে আছে। খালাম্মার সামনে ধরাশায়ী বিশাল এক ধূসর রুই। মাছটি বাঁকানো বঁটি গোড়া থেকে লাল চোখে তাকিয়ে আছে। খালাম্মা কাঠের উঁচু পিঁড়িতে বসা। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে সালোয়ার কামিজ পরা এক তরুণী। বুঝলাম তিনি সহকারী মেয়েটিকে এত বড় মাছটা কি করে কাটতে হবে তার তালিম দিচ্ছেন। রান্নাঘরটা অন্ধকার বলে বাতি জ্বলছে। ভিতরে ছিটের শাড়ি পরা একজন ছোটখাটো নারী উঁচু কাঠের চুলোয় উঁকি দিয়ে দিয়ে একটি লোহার পাইপে ফুঁ দিয়ে আগুন উসকে দিচ্ছেন। কষা মসলার সুগন্ধ দুপুর ফুঁড়ে লাফিয়ে পড়ছে সিঁড়ি অবধি।

এমন সময় নিচের তলা থেকে দুজন হ্যাংলা গোছের মানুষ আভির্ভূত হয়ে মিনমিন করে খালাম্মাকে কি যেন বলল। আমি শুধু হাসপাতাল শব্দটা শুনতে পেলাম। খালাম্মা কপালের ঘাম মুছে বুকের আঁচলের নিচে হাত দিয়ে ব্লাউজের ভিতর থেকে অর্থ বের করলেন। আমি অবাক! তারপর তা থেকে কিছু তাদের দিলেন। ওরা এক মুঠো টাকা নিয়ে নিচে নেমে গেল। এবার তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি শামীম না! যাও তোমরা খাওগা সব টেবিলে আছে।’ তিনি আমার নামের আদ্যাক্ষরটা নরম করে ‘ছ’-এর মতো উচ্চারণ করতেন। প্রবল মমতা ভরে কথা শুরু করতেন মা বলে। এমন সময় দেখি আমাদের তিন সিঁড়ি ওপরে দোতলা ও তিন তলার সন্ধিস্থলে লম্বা বারান্দায় ধুতিপাড় সাদা শাড়ি পরা এক দীর্ঘাঙ্গী প্রবীণা। তিনিও শ্যামাঙ্গী। সদ্য স্নান সেরেছেন। হাতে গামছা। সেটা দিয়ে হালকা হাতে ভেজা চুল ঘষছেন। নানীকে ওরা আজ্জা ডাকে। কেন তা বাবলী নিজেও জানে কিনা সন্দেহ আছে। তো আজ্জা আমাদের খাবার ঘরে যাওয়ার ঈশারা করলেন।

 

***

খাবার ঘরে দেয়াল আলমারিতে কাচের কপাটের ভিতর ভরা পিঁয়াজ, রসুন, জলপাই, আমলকী থেকে শুরু করে আম ও আমড়ার ঝাল মিষ্টি আচার। এদিকে ওভ্যাল শেপের খাবার টেবিলের একদিকে কড়া করে ভাজা মাছ, কষা মাংস, সবজি, ঘি দিয়ে মচমচে করে করলা ভাজি, আলুভর্তা, পটোলের দোলমা, হাল্কা করে রান্না কদু-চিংড়ি এ রকম কমপক্ষে সাত রকমের ব্যঞ্জন। অন্যদিকে বিশাল বোলে গ্রাম থেকে আসা খেতের ধানের ভাত আর গভীর বাটিতে শুকনো মরিচ বেরেস্তা ভাসা ডাল। ওই ভাত ডালই কেবল জায়গা বদল করে হাতে হাতে ঘুরতো। বাকি সব পদ যাতে সবাই নাগালে পেতে পারে এমনভাবে মধ্যে রাখা। আমার পাশে বসে ক্ষিনাঙ্গী বাবলী ভাত নিয়ে পাখির মতো খুঁটাখুঁটি করতে করতে আমার দু’পদ খাওয়া শেষ হয়ে যেত। আর চাচা টেবিলে থাকলে আমার বন্ধুকে গভীর মমতায়, ‘বাবু খাও বাবু খাও’ বলতেই থাকতেন। খাবার পর ফ্রিজ থেকে বেরোলো পুরনো ঢাকার মিষ্টান্ন অথবা খালাম্মার তৈরি ঘন দুধের পায়েশ বা দুধ-কদু।

খাবারের পর হাত ধুতে গেলাম চিকন চাকন আরেকটি বারান্দায়। গ্রিল দেওয়া এ বারান্দাকে বারান্দা বলা ঠিক না। বরং তোয়ালে ঝুলানো আছে বলে একে হাত ধোয়ার ঘর বলা যেতে পারে। এ সিংকও সবুজ, মাপে আধখানা। এরই লাগোয়া তোমাদের দ্বিতীয় রান্নাঘর।

ধারণা করি শীতে, রাতে বা তড়িতে কিছু রান্না করতে লাগলে তা এখানেই হয়। এক পাশে বিদ্যুৎ বা গ্যাসের চুলো। বুঝি এ ঘর খাবারের ভাঁড়ারও। তাকে তাকে নানান টিনে বিস্কুট, বাখরখানি, মুড়ি, নিমকি।

জালি দেওয়া মিটসেফে রান্না। এখানেই দেখেছি পরে কোরবানির ঈদের পর করা হতো মাংস প্রিজার্ভেশন। পিপের মতো বিশাল সব হাঁড়িতে চর্বির তেলে ও কড়া লবণে মাসখানেক ধরে জাল দেওয়া মাংস। গরম গরম থাকলে স্বচ্ছ তেলের নিচে দেখতে পেতাম বিশাল বিশাল কালচে মাংসের টুকরা। সে মাংসে হান্টার বিফের চেয়েও স্বাদু। তার যে কি সুগন্ধ! দেখতে কালো-খেতে নরম-মুখে দিলে দাঁতের গোড়া থেকে বেরিয়ে আসতো অপূর্ব এক মাদকীয় জারক।

 

***

তিনতলায় বাথরুমের পাশে ছিল ফ্যামিলি রুম। সেখানে বনেদি বড় বড় আসবাব ও খাট ছিল। কিন্তু খালাম্মা ও চাচার কাঠের কারুকার্যময় পিলারসহ পালঙ্ক ছিল দারুণ। যেন তার হেলানেই দেখা যাবে নদী, এমন সুন্দর! ফ্যামিলি রুমের দারুণ ডিমান্ড। ওখানেই বাজতো আমাদের আসল জীবন বাজনা। এর একপাশে কাচের দেয়াল আলমারি যার পুরোটাই এলোমেলোভাবে বিদেশি জিনিস দিয়ে ঠাসা। সব যে দর্শনীয় তা না। বরং কিছু কিছু জিনিস দৃশ্যগোচর করার দরকার আছে বলেও মনে হতো না। আলমারির কোমরের কাছে স্লিম এক সেটি। আমি প্রায়ই নানীর পানের বাটা থেকে সুপারি খেতাম আর ওখানে পা দোলাতাম।

এ ঘরেরও বাবলীর ঘরের মতো পিছনে এক সরু ব্যালকনি আছে। সেখানে কি পরিত্যক্ত বাক্স পেটরা ছিল? মনে নেই একদম। দেয়ালের একদিকে সেই সরু সিঁড়ির সঙ্গে লাগোয়া বাবলীর আয়তাকার ঘরের দু’নম্বর দোর। ওর ঘরের অন্য দোর টানা লাল বারান্দা থেকে প্রবেশ করার। কিন্তু সেটা বন্ধই থাকত।

আমার কাছে ওর ঘরকে একটা গুহার মতোই লাগত। ভিতরে বই ভরা দেয়াল আলমারি, র‌্যাকভরা ম্যাগাজিন, কার্পেটে ও টেবিলের নিচে বই, খাতা, কলম আর বিছানার ডানপাশি পাশে একটা ফিলিপস রেডিও। ওর ঘরে প্রবেশমাত্রই সে গুহার দরজা পাথর করে দিত। আর আলী বাবার ডাকাত না হলে সে পাথর দরোজা খুলত না। নক করতে হতো। তুমি ও রেন্টু কতক্ষণ দরোজার বাইরে ঘোরাঘুরি করে, দরোজায় কান পেতে আমাদের হাসাহাসি শুনে পাঁচ মিনিট পর পর নক করতে থাকতে। আমরা কেন এত হাসি, কি নিয়ে হাসি এ নিয়েই তোমাদের অদম্য কৌতূহল। আসলে কি করতাম জান? আমরা আকাশবাণীর নাটক, রবীন্দ্রসংগীত শুনতাম, রাজিয়া খান আমিনের ধারাবাহিক উপন্যাস একসঙ্গে পড়ে পড়ে উত্তেজিত হতাম, আর বিশ্ববিদ্যালয়ে কে কি করল বলল বা করল তা নিয়ে হাসতাম। কিন্তু তোমরা দুজন ছাড়া এ বিশাল বাড়ির অর্ধশত মানুষের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না।

বিজলীর জন্ম হলে আমরা দুই সরলমতী ক্লাস পালিয়ে বঙ্গবন্ধু এভিন্যুতে গিয়ে ওর জন্য ছোট ছোট কোলবালিশ আর মশারি কিনেছি। বাবলী প্রায়ই কিনেছে ছোট ছোট জামা। ৯ হায়দর বক্স লেনের বাঁধা দর্জি এলে বাবলীর সঙ্গে তৈরি হয়েছে আমারও খদ্দরের জামা, ব্লাউজ। খদ্দর বলাতে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ তত দিনে শুরু হয়ে গেছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের অসহযোগ আন্দোলন। আমরা সব পাকিস্তানি পণ্য বয়কট করেছি। দাঁত মাজছি পিয়া টুথপেস্ট দিয়ে।

 

***

ছাদের বাংলো প্যাটার্নের ঘরগুলোর সামনে নেমে যাওয়া বারান্দা ও বেগুনি বাগান বিলাস দুপুরের কড়া রোদে যেন ঘুঘু ডেকে আনতো। ওটা আমার আর তোমার বোনের বড় প্রিয়স্থান ছিল। দুপুরের খাবারের পর আমরা যখন ছাদে উঠে যেতাম চৈত্রের আকাশে উড়তো বর্ণালী ঘুড়ি। আমরা রেলিংয়ে হেলান দিয়ে আনমনা হয়ে যেতাম। তখন দূর থেকে শব্দ আসতো, বকাট্টা লু...ট! আমরা সম্বিত ফিরে পেতাম। তখন ঢাকাই শাড়ির নীল আঁচলে ঘূর্ণা মেরে বাবলী বলত, চল এবার নিচে যাই। চা খাব। আমি তার অপেক্ষায়ই থাকতাম। উর্দু রোডের এই বিকালের চা পর্বে চাচা থাকতেন আর ট্রলি ভরা থাকত পুরনো ঢার সব ডেলিকেসি। চা হতো মালাইয়ে। মিষ্টি আসতো কুমিল্লার। কিন্তু চা পানের আসরে একজনই বক্তা। এবং আমি ও খালাম্মা প্রশ্নোত্তরকারী আর বাদ বাকিরা নীরব খাদক।

চাচা কোনো দিন বোর্ড গেইম খেলতে বসতেন, কোনো দিন খুলে বসতেন তার সদ্য বিদেশ ফেরা আমাদের জন্য আনা উপহারের সুটকেস। আমি ও বাবলী বেঞ্চে বসে পা দোলাতাম। সামনে একা একা চলতো টেলিভিশন। কেউ দেখত না।

রোজার দিনে চাচা বাসায় থাকলে তিনি সবার সঙ্গে খেতে, ইফতার করতে, চা খেতে পছন্দ করতেন। আমরা বসতাম পাটিতে সবুজ খাবার ঘরের সামনে মাটিতে। তিনি বড় এক বোলে নিজে মুড়ি মাখা করতেন আর আমরা ক্ষিদেভরা পেটে জুল জুল করে তাকিয়ে দেখতাম। আজান ভেসে আসতো জেলখানার কাছের পুরনো মসজিদ থেকে, আমরা মুখে তুলে নিতাম তোকমা দেওয়া বরফ কুচোর লাল ডালিম রঙা শরবত।

কোনো কোনো দিন চা শেষে উল্টোদিকের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতাম তিনতলায়। পথে পড়ত তোমার বাবা-মার মার্বেল পাথরগাঁথা বেডরুম। সে বেডরুমের বাইরে রাস্তামুখো চাপা এক ঝুল বারান্দা আছে। যা আমার আর বাবলীর অনেক প্রিয়। কত সন্ধ্যা যে ওখানে দাঁড়িয়ে রাস্তার কোলাহল শুনতাম, নিচে তাকিয়ে গলির গাড়ি ও রিকশার বিপরীতমুখী চলাচলে আটকে যাওয়া ও নিজেদের দেহ ছাড়িয়ে নেওয়া দেখতাম। কখনো আমাদের সঙ্গে থাকত বকুল। সে যেদিন থাকত আমাদের তিন তরুণীর কলশব্দে মার খেয়ে যেত ভুলুর ভেউ ভেউ। কখনো তখন ব্যাগভরা খাস্তা বাখরখানি ও সুতা কাবাব নিয়ে নিঃশব্দ পায়ে পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসত আমাদেরই সমান বয়সী তোমার কাজিন, পাতলা জয়নাল। যদি কোনো দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সতীর্থ রাইসুল দা থাকত তখন এই কভিডের মতোই আমাদের হাসির ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ত সারা বাড়িতে। সেরকম সময় যদি তোমার প্রতাপশালী বাবা, বঙ্গবন্ধুর বন্ধু মোজাম্মেল হক ওরফে অদু মিয়ার গাড়ির হংকিং শোনা যেত সব স্তব্ধ হয়ে যেত। চাচা ছিলেন সে সময়ে কুমিল্লা জেলার বাঞ্ছারাম উপজেলার দড়িকান্দির এমপি। সেখানে সবাই তাঁকে অদুমিয়া বলে জানে।

 

***

একদিন নিচের তলায় দেশি শাড়ি কাপড় বিক্রেতা এলো। আমি আর বাবলী দুড়দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসতে আসতেই নাকে লাগছিল কাপড়ের গাঁট খোলা নতুন তাঁতের শাড়ির আকুল করা মাড়ের গন্ধ। আমরা সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নির্দেশিকা তুলে তুলে শাড়ি নির্বাচন করছি, বিক্রেতা তখন সেটা বের করে ভালো করে দেখার জন্য হাতে তুলে দিচ্ছেন। আমাদের টাকার চিন্তা করতে নেই। খালাম্মা তার বুকের ভিতর থেকে টাকা বের করে জয়নালের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেবেন। যখন আঙ্গুল তুলেই ‘ওইটা, না না এইটা, ওই যে ফিরোজা রঙের গোলাপি পাড়টা করছি’। তুমি আর রেন্টু মিলাদের মতো বুকের কাছে হাত ভাঁজ করে অদম্য কৌতূহলে নিচে দাঁড়িয়ে দেখছ। এমন সময় তোমার ফর্সা মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ছোট্ট আঙুল তুলে একটা হলুদ শাড়ি দেখিয়ে লেপ্টে যাওয়া উচ্চারণে বললে, ‘ছামাপা তুমি ওইটা নিবা’? এতদিন পর আজ অবাক হই ভেবে- তখনই সুন্দর ডিজাইন দেখলে ওই ছোট্ট চিনার চোখ চকচক করে উঠত কেন? হয়তো ভবিষ্যতে সে বাংলাদেশের এক বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার হবে বলে। কে জানে!

 

***

চিনা, এতটুকু লিখে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম বেশ কতক্ষণ। বিলেতের শেষ হেমন্ত। আমার লন্ডনের ফ্ল্যাটের সামনের বার্চ গাছের পাতা প্রায় শূন্য। সিলভার বার্চের বাকল উঠে যাচ্ছে। মনটা কেমন করে উঠল! জীবনের হেমন্তে বসে বহুদূর বিদর্ভ নগরের যক্ষের মতো আমার ঢাকার জীবন-বসন্ত কঁকিয়ে উঠেছে। আমি উর্দু রোডের চারতলা সেই বাড়িটির ওমের কথা ভাবছি। যে বাড়ি একদিন আমাকে অবিচ্ছেদ্য শুশ্রƒষা দিয়েছিল। আহা এতদিনে আমার স্মৃতি জলে তার গোড়া আরও শক্ত হয়েছে, সে বাড়ি দৈর্ঘ্য হয়েছে দ্বিগুণ। সে বাড়ির চলে যাওয়া মায়ার মানুষগুলো খালাম্মা, চাচা, পিন্টুর কথা বড় বেশি মনে হচ্ছে চিনা। মনে হচ্ছে খালা গিজিত, ফুপু এমনকি মুক্তিযোদ্ধা মনিদাদার কথাও। সবাই আমার বুকে একটা সুশক্ত জায়গা নিয়ে গেঁড়ে বসে আছেন। আমি তোমাদের বাড়ির আরেকটি মেয়ে ছিলাম, আর বাবলী ছিল আমার যমজ। তোমাদের পরিবারে আমি যুক্ত হওয়ার পর চাচা বিদেশে গেলে জোড়ায় জোড়ায় জিনিস কিনতেন, শাড়ি, ব্যাগ, কলম। এমনকি একবার পাকিস্তান থেকে নিয়ে এসেছিলেন মিষ্টি পানও। সে পান সবার ভাগেরটা খাবার পর আমারটা ছিল তোমাদের সেই জায়েন্ট ফ্রিজে রাখা। সেবার তিন দিন পর উর্দু রোডে যেতেই তুমি আমাকে টেনে নিয়ে গেছিলে ফ্রিজের কাছে। বাবলী খিলিটা দিতেই ঘর আতরের মতো সুবাসিত হয়ে গেল। মুখে পুরে দিয়ে তো আমার জবান বন্ধ। এত রস, এত স্বাদ এত আস্বাদ! বুঝতেই পারছিলাম না সাচি পানে মুড়ানো সুপারি খাচ্ছি না শাহী হালুয়া চিবুচ্ছি। রসনা ভরে গেছিল অপূর্ব স্বাদে, নাক ভরে গেছিল চমন বাহারের ঘ্রাণে।

চিনা, মন ভারি লাগছে। আর লিখতে ইচ্ছা করছে না। এ দেশে এখন আবার শুরু হয়েছে দ্বিতীয় দফার লকডাউন। মন ভালো নেই। ভয়ও লাগছে। কভিড-১৯ নামের মারাত্মক এই ভাইরাসে গোটা পৃথিবী আজ পর্যুদস্ত। বহুদূর চীন দেশের উহান নামের প্রদেশে এ অভূতপূর্ব ভাইরাসের জন্ম হয়েছে। কিন্তু ছেয়ে ফেলেছে গোটা বিশ্ব। এ ভাইরাস শত বছর আগের মহামারি স্প্যানিস ফ্লুর চেয়েও মারাত্মক। বিষাক্ত ও মারাত্মক ছোঁয়াচে এ রোগের ভয়ে সব এতটাই বদলে গেছে যে বিলেতি হ্যান্ডশেকও উঠে গেছে। আলিঙ্গন, ঠোঁটে-চুম্বন, গালে গাল ঘষা, একজনের কাঁধে অন্যজন ঝুঁকে থাকা, হাতে হাত আংটার মতো আটকে রাখা, আলতো করে চুলের স্পর্শ নেওয়া সব শেষ। এ রকম সময়ে বাংলাদেশে আমার বসন্ত দিনের স্মরণ আমাকে ব্যথাতুর করে তুলছে।

তিন দশক আগে আমি দেশান্তরী হয়েছি। এখন তোমরাও সবাই নানা দেশে বা নানা স্থানে। শুনেছি উর্দু রোডের সে বাড়িতে কেউ আর থাকে না। দৈবাৎ যদি কভিডের হাত থেকে বেঁচে যাই তবে ঢাকায় যাব, তোমাদের উর্দু রোডের সেই বাড়িটা দেখে আসব। মানুষ তো ফেরার জন্যই বসে থাকে। তাই না? ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিও।

 

ইতি

তোমারই ছামা’পা।

অক্টোবর ২০২১

লন্ডন

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর