ষড়ঋতুর বাংলাদেশ। বিভিন্ন ঋতু এখানে নানা রূপবৈচিত্র্য নিয়ে ধরা দেয়। কবি-সাহিত্যিকদের ভিতরের শক্তি জাগিয়ে তোলে ঋতুভিত্তিক নানা উৎসব অনুষ্ঠান। সাহিত্যে ষড়ঋতুর প্রভাব সংবেদনশীল কবিচিত্তের অনুপম উপস্থাপনায় কাব্যিক চিত্রে উপস্থাপিত হয়েছে বারবারই। কবিচিত্তের রূপ-রসে ঋতুচক্রের ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে তাঁদের শিল্প-সাহিত্যে। মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতিকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে শিল্পী, সাহিত্যিক, কবিদের পক্ষে তো নয়ই। তাই তাঁদের রচনায় প্রকৃতি একটি বড় অনুষঙ্গ এবং কাব্য সমৃদ্ধির এক সোনালি উদ্ভাসও বটে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতের প্রভাব দীর্ঘ হলেও হেমন্তের প্রভাব একেবারে কম নয়। হেমন্তের স্বল্প স্থায়িত্ব হলেও বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রভাব কম নয়। বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিক তাঁদের সুনিপুণ হাতের জাদু স্পর্শে শৈল্পিক সৌকর্যে হেমন্তকে অনবদ্য রূপে উদ্ভাসিত করেছেন। ঋতুকন্যা হেমন্তের বৈশিষ্ট্য প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে প্রকৃতির কবি, নিসর্গের কবি, রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশকে। অন্য অনেক কবির কাব্যে হেমন্ত এলেও জীবনানন্দের মতো কেউ এতটা আপ্লুত করতে পারেননি পাঠককে। জনজীবনে হেমন্ত আনন্দ-বেদনার কাব্যের মতো। শুরুতে অভাব-অনটন, শেষটায় সমৃদ্ধির সোনালি উদ্ভাস। আবহমানকাল থেকেই হেমন্ত মানেই কৃষকের মুখে অনাবিল হাসি। ধান কাটা-মাড়াই নিয়ে পরিতৃপ্তির ব্যস্ততা। চলতে থাকে নবান্নের পিঠা-পায়েসের আয়োজন। হেমন্তের রূপ-লাবণ্যে নিমগ্ন কবি জীবনানন্দ দাশের অজস্র কবিতায় কুয়াশাচ্ছন্ন হেমন্ত প্রকৃতির অন্তরঙ্গ অনুভবের সংশ্লিষ্টতায় এক অসাধারণ রূপে উদ্ভাসিত হয়েছে। হেমন্ত তাঁর প্রিয় ঋতু। অনন্য কাব্যিক সুষমায় হেমন্ত তাঁর তুলির আঁচড়ে বাঙ্ময় রূপে ধরা দিয়েছে। আর কোনো কবির কাব্যে এমন রূপক, উপমা অলংকার, নব নব শব্দের বুননিতে হেমন্তের এমন অনবদ্য প্রকাশ চোখে পড়ে না। ‘হেমন্তের কবি জীবনানন্দ দাশ’ প্রবন্ধে নরেশ গুপ্ত লিখেছেন, “জীবনানন্দের কবিতা পড়তে পড়তে অজান্তে কখন আমরা রূপসী হেমন্তের প্রেমে পড়ে যাই। ভেবে অবাক লাগে, কৃষির সোনার কৌটোতে আমাদের প্রাণের ভ্রমরটি যদিও ভরে রাখা আছে, তাহলেও ফলন্ত ধানের ঋতু হেমন্তের গাঁথা বাংলা কবিতায় একরকম ব্যতিক্রম বললেই চলে। হেমন্তের গভীর গম্ভীর রূপ কীটস-এরও মন ভুলিয়েছিল। শেষ পর্বে জীবনানন্দের কাব্যে যখন বাঁকবদল ঘটছে, হেমন্ত তখনো তাঁর উপকরণ হয়েছিল, তার ব্যবহার যদিও তখন ভিন্ন। হেমন্ত প্রথমত শস্যের, তৃপ্তির, বিরতির ঋতু।” হেমন্ত তাঁর চোখে কেবল রূপসজ্জা ও সৌন্দর্যের জৌলুস নয়; হেমন্ত তাঁর কাছে প্রেম-বিরহ-মিলন ও সৃষ্টির এক অপার বিস্ময়। কবি হেমন্তকে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন বিকালের নরম হলুদ রঙের বর্ণবৈভবহীনতা এবং বিরানশূন্য প্রান্তরের বিবর্ণতা। তাই তো কবিকে তাঁর অঘ্রাণ কবিতায় বলতে দেখি- ‘আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি-বিকেলের এই রং-রঙের শূন্যতা/রোদের নরম রোম-ঢালু মাঠ-বিবর্ণ বাদামি পাখি-হলুদ বিচালি/পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে ঘাসে কুড়ানির মুখে তাই নাই কোনো কথা,/ধানের সোনার কাজ ফুরায়েছে জীবনেরে জেনেছে সে কুয়াশায় খালি/ তাই তার ঘুম পায়-ক্ষেত ছেড়ে দিয়ে যাবে এখনি সে ক্ষেতের ভিতর/’ জীবনানন্দ দাশের ‘নির্জন স্বাক্ষর’, ‘পেঁচা’, ‘ধানকাটা হয়ে গেছে’, ‘অঘ্রাণ প্রান্তরে’ ‘হেমন্ত রাতে’ ‘হেমন্ত’ ‘হেমন্ত কুয়াশায়’, ‘হেমন্তের নদীর পারে’ ‘অঘ্রাণ’, ‘গোধূলি সন্ধির নৃত্য’ প্রভৃতি কবিতায় হেমন্ত ঋতু অনবদ্য শিল্প সুষমায় জীবন চিত্রকল্পের চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠেছে অনাবিল নান্দনিক শিল্প সুষমায়। তিনি ষোল আনা হেমন্তপ্রেমী কবি। তাঁর কবিতায় হেমন্ত প্রকৃতি আর আত্মমগ্ন কবি একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছে।
শস্যভরা ঋতুকে সবচেয়ে বেশি মহিমান্বিত করেছেন জীবনানন্দ দাশ। তাই তো ‘পিপাসার গান’ কবিতায় লিখেছেন- ‘এদেহ অলস মেয়ে/পুরুষের সোহাগে অবশ/চুমে লয় রৌদ্রের রস/হেমন্ত বৈকালে/উড়ো পাখপাখালির পালে/উঠানে পেতে থাকে কান, শোনে ঝরা শিশিরের ঘ্রাণ/অঘ্রাণের মাঝরাতে।’ কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে হেমন্ত এক অপরূপা সুন্দরী। ঋতুকন্যা হৈমন্তীর প্রেমে হাবুডুবু খায় যেন বাংলার প্রকৃতি। হেমন্তের আগমনে শিশির সন্ধ্যায় শিরশির হিমেল অনুভূতি আসন্ন শীতের বার্তা বয়ে আনে। শস্যহীন রিক্ত মাঠ, বৃক্ষ শাখাচ্যুত হলুদাভাব পত্রের ছড়াছড়ি সর্বত্র। হেমন্তের আগমনে গ্রামীণ পল্লীজীবনে কিষান কিষানির মুখাবয়বে আনন্দের ঝিলিক খেলে যায়। নতুন স্বপ্নে বিভোর এ শ্রেণির মানুষ অনাগত দিনগুলোর সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের নিমিত্তে শস্যভাণ্ডার পরিপূর্ণ করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
‘...সন্ধ্যা আসে সহসা কখন;/শজিনার ডালে পেঁচা কাঁদে নিম-নিম-নিম কার্তিকের চাঁদে (গোলপাতা ছাউনির)’। জীবনানন্দের কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে হেমন্ত এক অপরূপা সুন্দরী। ‘যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে,/...আমার বুকের’ পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল, /তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই! (নির্জন স্বাক্ষর, ধূসর পাণ্ডুলিপি)’ অথবা ‘আজকের মানুষ আমি তবুও তো-সৃষ্টির হৃদয়ে/হৈমন্তিক স্পন্দনের পথের ফসল...’। হেমন্ত ঋতু কবি জীবনানন্দ দাশকে স্পন্দিত করে। চিত্রকল্প নির্মাণেও কবি জীবনানন্দ দাশ রূপসী বাংলার কাছে, হেমন্তের কাছে হাত পেতেছেন। সাধারণ জিনিস নিয়ে কী অপূর্ব চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন তিনি। তিনি বলতেন, চিত্রকল্পই কবিত্ব। আধুনিক কবিতা মানে চিত্রকল্প নির্মাণ। পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের যত বেশি ব্যবহার করে চিত্রকল্প নির্মাণ করা যাবে, কাব্যভাষা বা কাব্যশৈলী ততই উন্নত হবে। তাঁর কবিতার প্রকাশভঙ্গির স্বাতন্ত্র্য সব পাঠককে মুগ্ধ করবে। ফ্যাকাশে মেঘের মতো চাঁদের আকাশ পিছে রেখে (অনেক আকাশ), পাখির মায়ের মতো আমাদের নিতেছে সে ডেকে (অনেক আকাশ), এলোমেলো আঁধারের মতো, ঢেউয়ের ফেনার মতো ক্লান্ত, ঘুমন্ত বাঘের বুকে বিষের বাণের মতো বিষম সে ক্ষত, মেঘের চিলের মতো-দুরন্ত চিতার মতো বেগে ছুটে যাই, পাষাণের মতো হাত, কাচের গুঁড়ির মতো শিশিরের জল, পরী নয়, -মানুষও হয়নি এখনো, যেই কুঁজ-গণ্ডে মাংসে ফলিয়াছে/নষ্ট শসা-পচা চালকুমড়ার ছাঁচে (বোধ) ইত্যাদি উপমা অনন্য।
হেমন্ত অর্থাৎ কার্তিক ও অগ্রহায়ণ নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন জীবনানন্দ দাশ। তাঁর কবিতায় হেমন্তের দারুণ প্রভাব। ‘অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে/হিম হয়ে আসে (পেঁচা)’, ‘মাঠে-মাঠে ঝরে এই শিশিরের সুর-/কার্তিক কি অঘ্রাণের রাত্রির দুপুর/হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে (পেঁচা)’, ‘চড়ুইয়ের ভাঙা বাসা/... শসাফুল...মাকড়ের ছেঁড়া জাল-শুকনো মাকড়সা/’ (মাঠের গল্প)।
জীবনানন্দ দাশ বিংশ শতাব্দীর বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি। বাংলা কবিতায় আধুনিকতার পথিকৃৎদের অন্যতম তিনি। ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে জন্ম নেওয়া এই কবি ১৯৫৪’র ২২ অক্টোবর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কলকাতায় মারা যান।