গল্প
সাগরিকা ও সাজ্জাদ একই সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক পাস করল। দুজনই এ প্লাস।
সাগরিকা ভাবছে সাজ্জাদকে ফোন করবে। হঠাৎ মোবাইলে শব্দ। সাজ্জাদই ফোন করেছে।
-হ্যালো, সাজ্জাদ। কেমন আছ?
-এই তো। তুমি কেমন?
-হ্যাঁ, আমিও ভালো।
সাজ্জাদ হাসতে হাসতে বলল-
-তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
-আমাকে বুঝি দেখনি?
-না, তা নয়। তবু একবার দেখতে চাই।
সাগরিকা বলল,
-এবার মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা। জীবনের বড় পরীক্ষা মনে হচ্ছে এটাই।
-হ্যাঁ, বড় পরীক্ষা তো বটেই। কেমন প্রিপারেশন হচ্ছে?
- তোমার যেমন, আমারও তেমনটিই।
দুজনে এক প্রতিষ্ঠানেই তো কোচিং করলাম। বাড়তি আর কী পড়ব? মাথায় কিছুই ঢুকতে চায় না। কী যে হবে শেষ পর্যন্ত!
সাজ্জাদ সাহস দিয়ে বলল,
-আরে না। এত চিন্তা কর না।
-হুঁ, তাই তো, সেই অপেক্ষায় আছি। আচ্ছা অনেক রাত হলো। রাখছি। ভালো থেকো।
সাগরিকা আনমনে কি সব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে নাশতা খাওয়ার পর মনে পড়ল। বইমেলা চলছে। সাগরিকা তাড়াতাড়ি সাজ্জাদকে ফোন করল।
-হ্যালো, সাজ্জাদ। বইমেলায় যাবে বলেছিলে।
- হ্যাঁ, বলেছিলাম। বিকেল ৪টার দিকে চলে এসো।
সাগরিকা লাইন কেটে দিল। ভাবল, ফাগুনের বিকেল। তাই বেছে বেছে হলুদ শাড়িটাই পরল। হাতভরে হলুদ রেশমি চুড়ি। কানে ছোট হলুদ দুল। আয়নায় নিজেকে ঘুরেফিরে দেখল।
-কিরে এত সাজগোজ করে কোথায় যাচ্ছিস? মায়ের জিজ্ঞাসা।
-বইমেলায় যাব। সাজ্জাদের সঙ্গে ঘুরব। মা বললেন-
- বেশি রাত করবি না। দিনকাল ভালো না।
-না, একটুও দেরি করব না। সাগরিকা মায়ের গলা জড়িয়ে আদর করল।
বইমেলায় দুজন। কিছু বইয়ের স্টলে ঘোরাফেরা করল। সাগরিকা রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ কিনে দিল সাজ্জাদকে। সাজ্জাদও নজরুলের ‘সঞ্চিতা’ কিনে দিল সাগরিকাকে। কিছুক্ষণ পর ক্যান্টিনে ঢুকে ফুচকা, কফি খেল। গল্প করল। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা। খাওয়া-দাওয়ার পর সাগরিকা মোবাইল নিয়ে বসল। অনেকক্ষণ এটা ওটা নিয়ে সাজ্জাদের সঙ্গে কথা বলল। হেসেখেলে দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল দুজনার। যথাসময়ে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা হয়ে গেল।
সাগরিকা চান্স পেল। সাজ্জাদ পেল না। সাগরিকা সাজ্জাদকে সান্ত্বনা দিল। কী আর করবে। আহ্ছান উল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হলো সাজ্জাদ। ক্লাস শুরু হয়ে গেল দুজনেরই। আগের মতো আর দেখা হয় না। কথা হয় না। দুই দিগন্তে জীবন দুজনের। মোবাইলে কথাবার্তা হলে দুজনেরই মনটা খচ্খচ্ করত। একদিন আগে থেকে কথা বলে দুজনে রমনা পার্কে বেড়াতে আসল। একটা গোলাপ ঝোঁপের আড়ালে বসল। কিছুক্ষণ দুজনই চুপচাপ।
সাজ্জাদ বলল,
-কী ব্যাপার, কথা বলছ না যে।
-কী বলব।
-বারে। কয়দিন দেখা হয়নি বলে সব কথা ফুরিয়ে গেল নাকি?
-না। ফুরিয়ে যাবে কেন? তোমার লেখাপড়া কেমন হচ্ছে?
-ভালো। তোমার?
-ভালো। কিন্তু জানো সাগরিকা, কারও কাজল টানা চোখের কথা মনে পড়লে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। মনে হয় সাগরিকাকে ছাড়া বেঁচে থেকে কী লাভ? সাজ্জাদের কথা শুনে সাগরিকা খিল খিল করে হেসে উঠল। তার দিকে তাকিয়ে সাজ্জাদ অবাক হয়ে গেল। মানুষ এত সুন্দর করে হাসতেও পারে। সাজ্জাদ সাগরিকার দিকে তাকিয়েই রইল।
সাগরিকা এবার লজ্জা পেল।
বলল,
-কী দেখছ আমার দিকে অমন করে?
-দেখছি তোমাকে।
-আমাকে কি আজকেই প্রথম দেখছ?
-না, তুমি বুঝবে না। সাগরিকাকে যে ভালো বেসেছে, সেই একমাত্র আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে।
-থাক থাক। আর কিছু বলতে হবে না। চলো, রাত হয়ে যাচ্ছে। সাজ্জাদ আবার বলল,
-আচ্ছা সাগরিকা। তুমি কি আমাকে আগের মতোই ভালোবাসো?
-কেন, সন্দেহ হচ্ছে?
-সন্দেহ নয়, ভয়।
সাগরিকা শক্ত করে সাজ্জাদের হাত ধরে বললো এই চলো। আমরা কাজীর অফিসে গিয়ে আজই বিয়ে করে ফেলি। তাহলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।
-তারপর? তারপর কী হবে?
-তারপর আর কী? সাগরিকা খিল খিল করে হেসে উঠল। না, এমনি বললাম। তোমার মনের কথা জানতে চেয়েছিলাম।
সাজ্জাদ অবাক হয়ে বলল,
-এতদিনে আমার মনের কথা জানতে চাইলে। এতদিনে আমাকে সন্দেহ করছ?
সাগরিকা বলল,
-রাগ করলে?
সাগরিকা সাজ্জাদের হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল, চলো- যাওয়া যাক।
-হ্যাঁ, চলো।
ওরা হাত ধরাধরি করে উঠে দাঁড়াল। সাগরিকাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে সাজ্জাদ চলে আসলো হোস্টেলে। সাজ্জাদের বুকটা ধড়ফড় করতে লাগল। মনে হলো কী যেন হাত থেকে ফসকে গেল। হৃদয়টা শূন্য হয়ে গেল। বেশ কিছুদিন পর একদিন ক্লাস শেষ করে সাগরিকা সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। লাইব্রেরিতে যাবে।
এমন সময় পেছন থেকে নিজের নামটা শুনল। কে যেন ডাকছে। এই যে সাগরিকা দাঁড়ান, আপনার সঙ্গে কথা আছে। সাগরিকা দাঁড়িয়ে পড়ল। জিজ্ঞেস করল-
-কিছু বলছেন আমাকে?
-জি আপনাকেই বলছি।
-কিন্তু আমি যে লাইব্রেরিতে যাচ্ছিলাম। নোট করব। কাল টিউটোরিয়াল জমা দিতে হবে।
-হ্যাঁ, আমিও তো লাইব্রেরিতে যাব। চলুন, একসঙ্গে যাই।
-তা, চলুন।
লাইব্রেরিতে দুজন একই টেবিলে মুখোমুখি বসল। সাগরিকা বলল,
-কী বলবেন আমাকে?
-না, মানে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করল। তাই।
-কথা বলার লোকের তো অভাব নেই।
-না, আপনাকে আমার ভালো লেগেছে তাই। আমার নাম সবুর।
-ও, আচ্ছা।
সাগরিকা আর কোনো কথা বলল না। নোট করায় মন দিল। সবুরও নোট করল। সাগরিকা বলল,
আজ চলি।
-এখনই যাবেন? চলুন ক্যান্টিনে যাই। এক কাপ কফি খেতে খেতে আলাপ করা যাবে।
সাগরিকা বলল, হ্যাঁ, চলুন।
ক্যান্টিনে সবুর জিজ্ঞাসা করল।
-আপনার কে কে আছেন?
-আমার মা আছেন। বাবা নেই, ভাইবোন নেই। মা স্কুল টিচার।
-কোথায় থাকেন?
-কলাবাগানে একটা ভাড়া বাসায়।
সবুর বলল,
- আমার কথা তো কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।
সাগরিকা বলল,
-এত তাড়া কীসের? একদিন সবই জেনে যাব হয়তো।
সবুর বলল,
-আমি সেগুনবাগিচায় থাকি। বাবা আর ছোটবোন থাকে। মা নেই। ছোটবোন এইচএসসি পড়ে। বাবা রিটায়ার করেছেন। লেখাপড়ার সুবিধার কথা ভেবে আমি হোস্টেলেই থাকি।
-ও, আচ্ছা। ভালোই তো। আজ উঠি। লাজুক চোখে সাগরিকা সবুরের দিকে তাকাল। সবুরের চোখে বিস্ময়। সামনা সামনি এমন করে কখনো কেউ তাকায়নি। একটু পরে বলল, আচ্ছা চলুন, ওঠা যাক।
সাগরিকা বাসায় ফিরে সোজাসুজি নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ভাবল, কাকে সে পছন্দ করবে। সবুর নাকি সাজ্জাদ? সাগরিকার মাথা ধরে গেল। উঠে একটা প্যারাসিটামল খেয়ে আবার শুয়ে পড়ল। দশ-বিশ মিনিট পর মা চা-নাশতা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।
চা-নাশতার পর সাগরিকা পড়ার টেবিলে বসল। কিন্তু পড়তে বসে বারবার অন্যমনস্ক হতে থাকল। সবুরের চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পাশাপাশি সাজ্জাদের চেহারাও। সাগরিকা ভেবে অস্থির হয়ে গেল। মনে মনে বলল, সবুর তুমি আমার সামনে আর এসো না। সাজ্জাদকে আমি স্কুল থেকেই ভালোবাসি। আমার কৈশোর-যৌবনের সাথী। আমি সাজ্জাদকেই ভালোবাসি।
সকালে মায়ের সঙ্গে নাশতা খেল। মা জিজ্ঞাসা করলেন,
-কীরে রাতে খাবার খাসনি কেন?
-এমনি, মা। খেতে ইচ্ছে করছিল না।
-কেন রে। হঠাৎ শরীর খারাপ করেনি তো? জ্বর আসেনি তো? সাগরিকা। মার প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে বলল-
-ও সব কিছুই না। তোমাকে এত চিন্তা করতে হবে না। আমি ঠিক আছি, মা।
মা স্কুলে চলে গেলেন। সাগরিকাও কলেজে গেল। কলেজ গেটে ঢুকতে ঢুকতে সাগরিকা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিল। ভাবছিল, সবুরের সঙ্গে আবার দেখা হয়ে না যায়! কিন্তু সাগরিকা যা ভাবল, তাই। সবুর আগে থেকেই গেটের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সাগরিকাকে ডাক দিল।
-সাগরিকা দাঁড়াও। একসঙ্গে যাই। সাগরিকা মুচকি হাসল। আচমকা ‘তুমি’ সম্বোধনে শিহরিত হলো।
বলল,
-আমি একাই যেতে পারব।
-সঙ্গে গেলে দোষ কী?
-না, তেমন কিছু নয়। তবে চলুন।
-চলুন নয়। চলো।
সবুর আর সাগরিকা লজ্জিত হাসি মুখে নিঃশব্দে ক্লাসে ঢুকল। দুজন পাশাপাশি বসল। দিন যায়। মাস যায়। বছর ঘুরে এলো। সবুরের সঙ্গে ক্লাস করে। সাগরিকার মনে নতুন দোলা লাগল। বসন্তের ফুলের দোলা। আজকাল সাজ্জাদও বেশি খোঁজ নেয় না। লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
একদিন ফোন করল।
সাগরিকা বলল,
-হ্যালো, সাজ্জাদ। কী ব্যাপার খোঁজখবর নেই যে তোমার।
-আমার খোঁজখবর আছে। তুমিই নিখোঁজ হয়ে গেছ। একটা ফোনও করো না। সব খবরই রাখি সাগরিকা। আমার পাখি খাঁচা ভেঙে উড়ে গেছে...। আমি এখন একা থাকতেই ভালোবাসি। হয়তো সারা জীবনই নিঃসঙ্গ থাকতে হবে। সাগরিকার বুকটা শুকিয়ে গেল। মনে একটু জোর এনে বলল, না, সাজ্জাদ ভুলব কেন? আসলে লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তা, কেমন আছ?
-ওই যে বললাম, একাই থাকতে হবে।
-কী যে বলো না, তার ঠিক নেই।
-চলো একদিন কোথাও বেড়াতে যাই। কালই আসো। আমাদের স্মৃতি জাদুঘর রমনায়।
-সাজ্জাদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল- দেখি।
সাগরিকার বুকটা ধড়ফড় করতে লাগল। এক জীবনে দুই পাশে দুজন। হিসাব মিলাতে পারছে না। সে এখন কী করবে। দুজনের মন রক্ষা করবে কেমন করে?
দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই সাগরিকা আসল রমনা পার্কে। সাজ্জাদও আসল। সাগরিকা নীল শাড়ি পরেছে। হাতভরে নীল রেশমি চুড়ি। খোঁপার পাশে নীল রঙের ফুল। কত দিন এই রূপটা সাজ্জাদ দেখেনি। আমার সাগরিকা, আমি আর ভাবতে পারছি না। মরে গেলেও এ রূপ ভুলে থাকা যাবে না। দুজন পাশাপাশি বসল। কিন্তু দুজনই চুপচাপ অনেকক্ষণ। এক সময় সাজ্জাদ আর চুপ থাকতে পারল না। বলল, সাগরিকা কিছু বলছ না যে! একদিন তুমি বলেছিলে, চলো, আমরা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করি। সেদিন এ কথার গুরুত্ব দিইনি। আজ আমি বলছি, চলো সাগরিকা, আমরা আজই বিয়ে করি। সাজ্জাদের কথা শুনে সাগরিকা চমকে উঠল। বলল, না, এখন কী করে তা সম্ভব? লেখাপড়ার অনেক চাপ। অন্য কথা বলো।
-অন্য কী কথা সাগরিকা। তুমি অনেক বদলে গেছ। আমার সাগরিকাকে চিনতে পারছি না। সাজ্জাদ কিছুক্ষণ পর বলল, সাগরিকা, তোমার খোঁপার পাশে একটি ফুল গুঁজে দিই। সাগরিকা শুকনো গলায় বলল,
-দাও।
-না থাক। যদি কোনো দিন আমার সাগরিকা হয়ে আসো, তবেই সব হবে। আমার জীবনটা ভরে যাবে। আজ থাক, চলো যাই। সাগরিকা কিছু না বলে বাধ্য মেয়ের মতো উঠে দাঁড়াল। কিন্তু সাজ্জাদের হাত ধরল না। কেমন যেন সব এলোমেলো লাগছে। সাজ্জাদ বলল, চলো। তোমাকে পৌঁছে দিই। সাগরিকা ছোট্ট করে বলল, চলো। এরপর অনেক দিনরাত, জোয়ার-ভাটায় পাঁচ বছর কেটে গেল। ইন্টার্নশিপও শেষ হলো। সবুর একদিন সাগরিকাকে বলল, চলো, আমরা বিয়ে করে ফেলি।
সবুরের কথা শুনে সাগরিকা চমকে ওর মুখের দিকে তাকাল। সাগরিকা ভাবল এমন করে এ কথাটা একদিন সাগরিকা সাজ্জাদকে বলেছিল। একদিন সাগরিকাকে বলেছিল সাজ্জাদও। একটু চুপ থাকার পর সাগরিকা বলল, না, এখন নয়, পরে হবেক্ষণ। শুধু ডাক্তারি পাস করলেই হলো। এফসিপিএস করব। তারপর ডক্টরেট করতে যাব লন্ডনে। তোমার ইচ্ছে করে না?
সবুর উদাস চোখে সাগরিকার দিকে তাকাল। সাগরিকাও সবুরের দিকে। কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর সাগরিকা হেসে ফেলল, সবুরও। বলল,
-ঠিক আছে। তুমি যা বলবে, যেদিন বলবে তাই হবে।
সাগরিকা বলল, তুমি তোমার বাবাকে নিয়ে একদিন আমাদের বাসায় এসো। মায়ের সঙ্গে পরিচয় হবে।
-হুঁ, ঠিকই বলেছ। একদিন বাবাকে নিয়ে তোমাদের বাসায় যাব।
সাজ্জাদও ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বিদেশ গিয়ে এমএস করার চিন্তা করল।
এদিকে সাগরিকার সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয় না, কথা হয় না। হঠাৎ সাগরিকাকে ফোন করল সাজ্জাদ। সাগরিকা ফোনে চোখ রাখল।
-হ্যালো, সাজ্জাদ কেমন আছ?
-তুমি বুঝতে পার না?
সাগরিকা চুপ করে রইল। সহসা কোনো কথা বলতে পারল না।
-সব খবর রাখি, সাগরিকা। এখন সাজ্জাদ নয়, সবুর তোমার হৃদয়জুড়ে। তাই না?
-না তা কেন? এত দিন পড়াশোনার চাপে সেভাবে ফোন করা হয়ে ওঠেনি।
-বেশ, তুমি তোমার লেখাপড়া নিয়ে থাক, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে না। মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে আমাকে। বলতে বলতে সাজ্জাদের কণ্ঠ বুজে এলো। ওপাশ থেকে চোখে জল নিয়ে সাগরিকাও বলল, আচ্ছা রাখি সাজ্জাদ। অন্যদিন কথা হবে।
লাইনটা কেটে গেল। সাগরিকার আত্মাটা ধক করে উঠল। সাজ্জাদের সঙ্গে সে প্রতারণা করেছে। কিন্তু সবুর। সবুরকে তো সাগরিকা মনের আড়াল করতে পারবে না। ছয়-সাতটা বছর সবুর সঙ্গ দিয়েছে। একসঙ্গে ক্লাস করা, লাইব্রেরি, বেড়াতে যাওয়া সব কিছুই তাকে যেন ঘিরে রয়েছে। সাগরিকা যেন দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেল। সাগরিকা শেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। সবুরকেই বিয়ে করবে। সে আরও ভেবে দেখল, জীবনে সব কিছু পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যাবে না। অনেক কিছু পাওয়ার বাকি থেকে যায়। অনেক বাধা বিপদ পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়।
আরও কিছুদিন পরের কথা। সবুর ও সাগরিকা এফসিপিএস করে ফিরেছে। একদিন শুভক্ষণে ধুমধাম করে ওদের বিয়েটাও হয়ে গেল। দুটি প্রাণ, দুটি মন এক হয়ে গেল।
সাজ্জাদের বন্ধু রাশেদ সাগরিকার সব খবরাখবর দেয় সাজ্জাদকে। জানতে পারল সবুরের সঙ্গে সাগরিকার বিয়ের খবর। মুহূর্তে হৃদয়টা শূন্য হয়ে গেল। সে অনুভব করল ভালোবাসার প্রজাপতিটা কোথায় যেন উড়ে গেল।
এদিকে সাগরিকা ও সবুরের লন্ডনে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। সাজ্জাদ রাশেদের কাছে খবর পেল দুই দিন পর সাগরিকা লন্ডন চলে যাবে। দুপুর ৩টায় ওদের ফ্লাইট। সাজ্জাদ পাগলের মতো হয়ে গেল। রাশেদকে রাজি করিয়ে দুজন বিমানবন্দরে গেল। ওরা একটু আড়াল নিয়ে বিমানবন্দরের গেটে অপেক্ষা করতে লাগল। দেখল কিছুক্ষণ পর একটা সাদা গাড়ি থেকে সাগরিকা আর সবুর নামল। সঙ্গে সবুরের বাবা ও সাগরিকার মা। আড়াল থেকে সাজ্জাদ দুচোখ ভরে সাগরিকাকে দেখতে লাগল। সাগরিকার পরনে লাল শাড়ি, খোঁপার পাশে সাদা গোলাপ। হাতে সাদা রেশমি চুড়ি। টানা টানা চোখে কাজল। সব মিলিয়ে এক সমুদ্র সুন্দরী সাগরিকা। একটু পরই ওরা বিমানবন্দরের প্রবেশপত্র অতিক্রম করল। সবুর আর সাগরিকা তাদের মা-বাবাকে হাত নেড়ে বিদায় জানাল। সাগরিকা ও সবুর চোখের আড়াল হয়ে গেল। মুহূর্তে সাজ্জাদের মনটাও শূন্য হয়ে গেল। এই শূন্যতার ভার বইতে পারল না তার দুর্বল হৃৎপিণ্ড। জ্ঞান হারিয়ে শেকড় উপড়ানো গাছের মতো লুটিয়ে পড়ল। মাথা ফেটে রক্তে ভেসে গেল দুধশাদা টাইলসের মেঝে। সাগরিকাকে বহন করা উড়োজাহাজের সঙ্গে উড়ে গেল সাজ্জাদের প্রাণ পাখিটাও। ওর সেই মূর্ছা আর ভাঙল না...