গল্প
হেমন্তের নরম রোদ এসে পড়েছে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের দুই পাশে। মুক্তাগাছা মুন সিনেমা হলের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম, দেখলাম- সাদা পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পরা এক বৃদ্ধ মাথায় চারাগাছের ঝাঁপি নিয়ে বিকেলের হাটে যাচ্ছেন। সাথে সাথে তার দ্বিগুণ লম্বা ছায়াও যাচ্ছে। একটা হাত ঝাঁপির ওপর তুলে আর একটা হাত দ্রুত সামনে-পিছনে যাওয়া-আসা করছে। নরম রোদে ধানগাছগুলো হেসে যাচ্ছে। দেখলে যে কারও মনে খুশির বান ডাকবে। ঝিরিঝিরি বাতাসে ধানগাছগুলো দুলছিল। হেমন্তের নরম সোনারাঙা রোদ ধানের শীষগুলো আমাকে ডাকছিল। আমার বামপাশে রীনা আপা বসেছিলেন, তিনি সেই ডাক শুনতে পাননি। যেমন আমার আব্বার ডাক অনেকেই শুনতে পেতেন না। এই তো সেদিন বুধবার সকাল বেলা, আমি যখন আব্বার কাছে গেলাম, তার মুখজুড়ে হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল। আব্বার মুখে আমার হাত রাখতেই সেই হাসির কিছু হাসি মুক্তোর দানার মতো ছড়িয়ে পড়ল ঘরের মেঝেতে। কিছু রহস্যমিশ্রিত হাসি হেসে জানালা দিয়ে চলে গেল। আমি আব্বার মুখ ও গলায় হাত দিয়ে ছোট বাচ্চার মতো আদর করতে লাগলাম। তারপর আমার হাত আব্বার হাতের আঙুল ধরে একটু ওপরে তুলতেই পুরো হাতটা অশক্ত হয়ে, হালকা থেকে হালকা হয়ে আমার হাত থেকে পড়ে গেল। তখনো তিনি হাসছিলেন। তার মুখ, ঠোঁটের কোণা, নাকের দুই পাশ, এমনকি বন্ধ হয়ে থাকা দুই চোখের কিনারাও সুগন্ধি ছড়িয়ে হাসছে।
বুকের ওপর থেকে পাতলা কাপড়টা সরাতেই, মৃদু হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে গেল আব্বার শিয়রে রাখা সাদা ফেব্রিকে সাদা সুতোয় হাতের কাজ করা পাঞ্জাবিটা। উড়িয়ে নিয়ে যেতে শুধু দেখলাম। আটকানোর মতো কিছুই করতে পারলাম না। সাদা পাঞ্জাবি সাদা আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো ওপরে উড়ে গিয়ে মিলিয়ে গেল।
আব্বাকে ডাকতে যেয়ে শক্তি পাচ্ছিলাম না। আমার ভিতর থেকে ‘আব্বা আব্বা’ ডাকতে চাইছিলাম। কিন্তু কিছুতেই সেই ডাক গভীরভাবে ডাকতে পারছিলাম না। ফিসফিস করে শুধু ‘আব্বা’ বলে বারবার ডাকছিলাম। পাশের ড্রয়িংরুমে মেজো ভাই কারও সাথে কথা বলছিলেন। আমি আব্বার প্রশস্ত বুকের দিকে তাকিয়ে বললাম, ভাই আব্বা তো কথা বলে না। আব্বার বুক থেকে খুশবুর ঢেউ আমাদের বিমোহিত করে রাখছিল। অন্য রুম থেকে আম্মা এসেই প্রিয়জনকে প্রিয় নাম ধরে ডেকে, মাথার নিচ থেকে বালিশটা সরিয়ে রাখলেন। আমি অবাক হলাম, আব্বার মাথার বালিশ তারই প্রিয়সঙ্গিনী সরিয়ে দিল! যাকে বাসর রাত থেকে সঙ্গিনী পেয়ে একসঙ্গে সাতষট্টি বছর সুখে-দুঃখে পার করলেন। শুধু দেখেই যাচ্ছিলাম। আমার কী করণীয়। আম্মা ভাইকে বলছে- পাগুলো সোজা করে দে। পাগুলো সোজা করতেই আমার মনে পড়ে গেল আমার শৈশবের কথা। আমাকে কোলে করে আব্বা হেঁটে হেঁটে স্কুলে নিয়ে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। আর একবার আমাকে সাথে নিয়ে পিকনিকে গিয়েছিলেন। মধুপুরে অনেক গাছ-গাছালির ছায়ার নিচ দিয়ে আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন। আজ সেই পা নিথর। আম্মার মুখ থেকে হাহাকার সুর একটু পরপর বের হচ্ছে। আবার বললেন- মাথাটা উত্তরমুখী করে দে। আম্মা যা-যা করতে বলছেন ভাই সেভাবে তাই করছেন। কেউ প্রেসার দেখছে। কিন্তু প্রেসারের মেশিনে কোনো কালো রিডিং কাজ করছে না। ছোট ভাই ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসল।
আম্মা নিজেই আব্বার মুখটা পশ্চিমমুখী করে দেন। আম্মা কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে বলছেন, পাখি হয়ে উড়ে গেলা। একটা বার ডাকলা না। কতই না ডাকতা। কত যত্নে আগলাইয়া রাখতা। কাগজে ‘ভালোবাসি’ কোনো দিন লেখ নাই। কোনো দিন ছবিও তোল নাই। কিন্তু পরম আদরে, আলিঙ্গনে, সম্মানে একসঙ্গে থেকেছি।
ভাই বললেন, আম্মা ডাক্তার সাব এসেছেন। আম্মা বরাবরের মতো মাথার কাপড়টা টেনে অন্য রুমে চলে যান। আমি আব্বার আঙুল থেকে প্রেসার মাপার মেশিনটা বের করে বললাম, এটা নষ্ট তাই কাজ করছে না। হাসপাতালেও এ রকম কয়েকবার হয়েছিল, দেখেছিলাম। ডাক্তার বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে আমি সব দেখছি। মহিলারা সব রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।
আব্বার বিভিন্ন রিপোর্ট, কাগজের জন্য ডাক্তারের কাছে আমাকেই ডাকত। কিন্তু আজকে ডাকছে না। নিজেই রুমের ভিতর ঢুকলাম। দেখি বেডে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন আব্বা। তাঁর বুকে ডাক্তার এক হাতের ওপর আর এক হাত দিয়ে জোরে জোরে চাপ দিচ্ছেন। তাঁর হাতটা সরিয়ে বললাম, আব্বা তো ব্যথা পাচ্ছেন। আব্বার যে নরম শরীর! সারা জীবন শক্ত কোনো কাজ করেন নাই।
এই বুকে কতদিন আমি ঘুমিয়েছি। আবার সকাল বেলা যখন আম্মা উঠে চলে যেতেন আমি বিছানায় আব্বার তসবি-টুপি নিয়ে খেলা করতাম। খেলতে খেলতে একসময় আমার মাথাটা আব্বার বুকের ওপর রেখে ওপরের ছাদের দিকে তাকিয়ে টিকটিকিদের দৌড়াদৌড়ি দেখতাম, আর হাসতাম। যখন বিছানা থেকে নামিয়ে দিতে বলতাম- ঘুমের চোখে আমাকে নামিয়ে দিয়ে জুতো পরতে বলতেন। সেই বিস্তীর্ণ বুকে এত জোরে জোরে ব্যথা দিচ্ছে।
বড় বোনের ছেলে বলল, নানা ভাই উঠবে। আমি রুম থেকে আবার বের হয়ে আসলাম। সোফাতে বসতেই কেমন জানি কান্না আসছে। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছিলাম না।
এর আগে কোনো দিন এত জোরে কাঁদিনি। আজ আমার এ কী হলো! দেয়ালগুলো ফাঁকা হয়ে ভিতরের আস্তর খোলা লাল ইট আমার দিকে চেয়ে আছে। আব্বার নাতি-নাতনিরা চোখের পানি ফেলতে-ফেলতে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। নাতিদের একজন বলল, নানাভাই উঠবে। তা হলে তো আব্বা হাঁটতে পারবেন। আগের মতো সব ঘুরে ঘুরে দেখবেন। এমন সময় ঘর থেকে শব্দ আসল সবাই সরেন। তাকিয়ে দেখি চাদরে মুড়িয়ে নিচে নিয়ে গেল আব্বাকে। তখনই মসজিদের মিনার থেকে মাইকে ভেসে এলো ঘোষণা। একটি শোক সংবাদ...!
আম্মাকে আব্বা অনেক দূর থেকে এনেছিলেন। আম্মা ছিলেন মফস্বলের মেয়ে। জেলা শহর থেকে মফস্বল যেতে তখন ভালো রাস্তা হয়নি। আব্বা আর তাঁর ছোট বোনের স্বামী বাইসাইকেল চালিয়ে বিয়ে বাড়ি গিয়েছিলেন। দাদা অন্য মুরুব্বিদের নিয়ে আগের দিন চলে গিয়েছিলেন। দক্ষিণপাড়ার এক পুকুরে সাঁতার কেটে গোসল করেন। পাজামা- পাঞ্জাবি পরে, আতর মেখে, পশ্চিমপাড়ার খান বাড়িতে যান কবুল করে বিয়ে করতে।
আম্মা ছিলেন মা-হারা সন্তান। তার এক ভাই ছিলেন। আর প্রাইমারিতে পড়ানো বাবা মাসে বিশ টাকা মাইনে পেতেন। ছোট সংসার চলে যেত। আম্মা খুব ছোট থাকায় তাঁর নানুও থাকতেন একসাথে। আম্মাকে অর্ধেক পথ গরুরগাড়ি দিয়ে, বাকি অর্ধেক পথ পালকি দিয়ে জ্ঞানের ঘাট দিয়ে নতুন শ্বশুরবাড়ি নিয়ে আসেন।
পালকি থেকে নামিয়ে একটি জলচৌকিতে দাঁড় করিয়ে রাখে আম্মাকে। একটা পানিভর্তি বড় গামলা এনে তার মধ্যে পা ভিজিয়ে হাঁটতে বলেন। সেই সময়েই আব্বা এসে উপস্থিত হন। এসব করতে নিষেধ করেন। আব্বার কারণে প্রথম বিপদ থেকে রক্ষা পান মা। কিন্তু ভিতরে ভিতরে দাদি, ফুফুদের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হলো। সারা দিন কাজ করতে হতো। কারণ ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জনের বিশাল পরিবার। দুপুরের খাবার খেতে সময় পেতেন না। বিকেল বেলা এক হাতে পানির গ্লাস ধরে, অন্য হাতে ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে, পানি দিয়ে খালি ভাত গিলতেন। তখন টাইমের কল ছিল। চৌবাচ্চা থেকে পানি টেনে নিয়ে গোসলখানায় জমিয়ে রাখা হতো। শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-দেবরদের গোসল করে রেখে আসা কাপড় ধুতে ধুতে অনেক সময় সন্ধ্যা হয়ে যেত। সন্ধ্যা হয়ে গেলেও বকা দিত। একদিন আব্বা এসে দেখে ফেলেন, দাদা-দাদি খুব খারাপ ব্যবহার করছেন। দাদি ছিলেন মান্নাফ বেপারীর একমাত্র মেয়ে। আব্বার নানা ছিলেন অনেক ধনী। তখন আব্বা আম্মাকে নানার বাড়ি রেখে আসেন। আসার সময় আম্মার হাতে কিছু টাকা দিয়ে আসেন।
আব্বার অনেক প্রশংসার পাশাপাশি গুণের কথাও আম্মা বলতেন। আম্মাকে নানার বাড়ি বেড়াতে পাঠানোর আগেই- আব্বা খবর জানিয়ে দিতেন। আম্মার নানু খবর শুনে আগেভাগে কুয়া থেকে পানি তুলে কিছু পানি গরম করে, জলে ভাসা সাবান এবং গামছা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকতেন। কিছুক্ষণ পরপর আনুখালাকে পাঠাতেন- গাড়ির শব্দ শোনা যায় নাকি। সারা দিনে একটি, দুটি গাড়ি চলত তখন। নতুন রাস্তা। বাড়ির সামনে শুধু ধানখেত। তারপর ষোল মৌহিষের রাস্তা, এরপর আরও অনেক ধানখেত। পুবে মেইন কাঁচাপাকা সড়ক। সূর্য পশ্চিমে যাবে যাবে। আনুখালা বাড়ির ভিতর দৌড় দিয়ে বলে : নানু বুজি আইছে, বুজি আইছে!
আম্মার নানু বোরকা খুলে লেবুর শরবত খেতে দেন। রান্নাঘর থেকে আবার গরম করা পানি কুয়ার পাড়ে নিয়ে নাতিকে গোসল করিয়ে দেন। জলেভাসা সাবান দিয়ে মাথার জট হওয়া চুল ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে দেন।
খাওয়ার পর চুলে তেল দিতে গিয়ে রাগে ফস ফস করে। মওলানা আরিফ রাব্বানী আসুক। তারে কেডা কইছিল বিদেশে বিয়া দিতে। দেশে কি জাতের ছেলেপুলা ছিল না।
এই বলে চিরুনি দিয়ে এমন জোরে চুল আঁচড়ালেন যেন, এক হাত লম্বা চুল তিন হাত হয়ে গেছে। আম্মার চিবুকে হাত দিয়ে বলেন, দেখ কত চুল উঠে পড়ছে।
চুল তো উঠবেই। ফজরের নামাজ পড়ে নিজের ঘর থেকে বের হয়ে মাগরিবের নামাজের সময় নিজের ঘরে ঢুকতেন। অন্য দুই বেলার নামাজ শাশুড়ির ঘরেই পড়তেন। মাথার চুল আঁচড়ানো তো দূরের কথা, নিজের মুখটাও দেখার সুযোগ ছিল না।
আব্বার যেদিন বাড়ি থেকে আম্মাকে নিয়ে আসার কথা থাকত। আম্মা সেদিন কিছুক্ষণ পরপর পাটশোলার বেড়ার ফাঁক দিয়ে সড়কের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।
বেড়ার গা ঘেঁষেই একটা কামিনি ফুলের গাছ ছিল। সেই ফুলের গন্ধ আমাদের প্রিয় ছিল।
আমার বোন আব্বাকে দেখতে নিচে চলে গেলেন।
আব্বা নিজেই তাঁর শেষবেলার সাদা তিন টুকরো কাপড় মদিনা থেকে কিনে এনেছিলেন,
বিশ বছর আগে। ভাদ্র মাস আসলে আমরা শুধু তা রোদে দিতাম। তারপর ভাঁজ করে আবার রেখে দিতাম। আম্মা বড় ভাগ্নের ছেলেকে ভাঁজ করা সেই সাদা কাপড় স্টিলের আলমিরা থেকে বের করে দেন। এর মধ্যেই আরও তিন-চারজন চলে আসে কাপড় নিতে। আব্বা সারা জীবন সাদা পোশাক পরতেন। মামি-চাচিরা বলতেন- ভাইসাহেবের মনও সাদা। সাবান দিয়ে গোসলের আগে মগ, বালতির জন্য দুজন নিচ থেকে ছুটে আসলো। আমার মেয়ে পাশে বসে জিগ্যেস করে- মা বরইপাতা, বাঁশপাতা দিয়ে কী করে? আমার মেয়েকে বললাম, এসব দিয়ে নানাভাইকে গোসল করাবে, সাজাবে। ও বলে, আমি নানাভাইকে দেখব।
আমার নানা বাড়ির সবাই আম্মাকে বুজি ডাকে।
মামা এসে বলেন, বুজি কই?, চলেন নিচে যাই। শেষ দেখা দেখে আসেন। কত সুন্দর লাগছে।
সারা জীবনই তাকে সুন্দর লেগেছে। কোথাও গেলে মানুষ তাকিয়ে থাকত। আম্মা আরও কিছু বলতে যেয়ে আটকে যান। আম্মার সাথে সাথে আমরাও নিচে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        