গল্প
ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের রোল কল করতে করতে হঠাৎ থামলাম। দুই মাস অনুপস্থিত থাকায় এক ছাত্রের অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইলাম। ছিপছিপে, রোগা চেহারার রায়হান দাঁড়িয়ে অসুস্থতার কথা জানালো। কী অসুখ জানতে চাইলে সে বিভাগের সভাপতির সুপারিশকৃত আবেদন দেখালো। কৌতূহল থেকে তাকে ডাক্তারের কাগজপত্রসহ আমার রুমে দেখা করতে বললাম। অকারণ অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকটা গায়ে বাতাস লাগিয়ে কাটানো একশ্রেণির ছাত্রের স্বভাব। প্রথম বর্ষের ছাত্র রায়হান। ক্লাস শেষে সে কাগজপত্র নিয়ে যথারীতি আমার চেম্বারে এলো। ডাক্তারদের দেওয়া প্রেসক্রিপশন ও রিপোর্টগুলো নেড়েচেড়ে তার কোনো অসুখ খুঁজে পেলাম না। বললাম-
: কী অসুখে এত দীর্ঘদিন অনুপস্থিত ছিলে?
: স্যার, অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, কেউ আমার কোন রোগ ধরতে পারছেন না।
: সমস্যা কী?
: পেট ব্যথা, বুকে চাপ ধরে থাকা, খাওয়ার ইচ্ছে হয় কিন্তু বেশি খেতে পারি না, অল্প খেলেই বুকের ওপর উঠে থাকে, খাওয়ার পর অস্বস্তিবোধ করি...
প্রেসক্রিপশনগুলোতে চোখ বুলিয়ে দেখলাম সব ডাক্তারই এসিডিটির ওষুধ রেখেছে এক নম্বরে। ব্লাড প্রেসার নরমাল। তবে চোখ আটকে গেল এক জায়গায়, ঘুমের ওষুধ একটার নামও প্রেসক্রিপশনে লেখা পেলাম। অন্যান্য সব ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট নরমাল। রায়হানের লাইফস্টাইল, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করলো। অসুস্থতা নেই এমন অনেক মানুষের একটা বড় অসুখ হলো দুশ্চিন্তা, যা একেক বয়সে একেকভাবে আক্রমণ করে মানুষকে, যেখান থেকে উঠে আসতে না পারলে জটিল রোগকে আলিঙ্গন করতে হয়, নয়তো জীবন প্রদীপ হারাতে হয়। মুখোমুখি চেয়ারে বসিয়ে রায়হানকে কিছু প্রশ্ন করলাম।
: কোন ড্রাগ নাও?
: জি না স্যার। আমি সিগারেটও খাইনি কখনো।
: ভালোলাগা ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক আছে? বিশ্ববিদ্যালয় বা নিজ এলাকা বা ফেসবুকে?
: না স্যার, এগুলো কখনই ছিল না। এখনো নেই। আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই।
: পরিবারে কে কে আছেন?
: বাবা-মা আর আমরা তিন ভাইবোন। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে এলাকাতেই। আমি সবার ছোট।
: বাবা-মা কী করেন? তারা সুস্থ আছেন?
: বাবা কৃষিকাজ করেন, মা গৃহিণী। জি, তারা সুস্থ আছেন।
: মাসে কত টাকা খরচ হয় তোমার?
উত্তর দিতে কিছুটা সময় নেওয়ার চেষ্টা করলো রায়হান। একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন, গড়িমসি করে কিছুক্ষণ পরে বললো- ‘যখন যেমন প্রয়োজন হয়।’ বেশ বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর। খরচের সঙ্গে ড্রাগ অ্যাডিকশনের যোগসূত্র খুঁজতে প্রশ্নটি করেছিলাম। অনুমতি নিয়ে আরও কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্নে ঢোকার চেষ্টা করলাম।
: এখন কত টাকা আছে তোমার কাছে?
অপ্রস্তুত হয়ে চেয়ারে একটু নড়েচড়ে বসলো রায়হান। স্যারের প্রশ্ন এত ডিরেক্ট হবে তা ভাবতে পারেনি। উত্তর না দেওয়াটাও বেয়াদবির পর্যায়ে পড়ে ভেবে ডান দিকে ঘাড় নামিয়ে অস্ফুট স্বরে বললো- ‘দেড় শ টাকা’।
মাসের কেবল শুরু, অবশিষ্ট দিনগুলো কীভাবে চলবে জানতে চাইলে রায়হান নির্লিপ্ত থাকলো অনেক্ষণ, এদিক ওদিক তাকিয়ে উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা ছিল তার। ফার্মেসিপড়ুয়া মেধাবী ছাত্র রায়হান নিরুত্তর বসে রইলো। অনেক সময় মৌনতা এমন এক ভাষা হয়ে ওঠে যা সমস্ত শব্দকে ম্লান করে দেয়। আমার বুঝতে বাকি রইল না তার অসুস্থতা অন্য কোথাও। স্বাভাবিক উত্তর হতে পারতো- অসুবিধা হবে না স্যার, বাবাকে বললে পাঠিয়ে দেবে, অথবা একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে... ইত্যাদি। নিরুত্তর থাকাটা হলো সবচেয়ে জটিল উত্তর। নিরুত্তরকে কখনো কখনো আবিষ্কার করা কঠিন। সপ্তাহের ছুটির দিন শনিবারে তাকে আসতে বললাম বেলা ১১টায়। আমি আরও কথা বলতে চাই জানালে রায়হান আসতে রাজি হলো।
দুই.
রায়হান এলো যথাসময়ে। আমি আসব কি না তা নিশ্চিত হতে সে মুঠোফোনে অ্যাপয়েনমেন্টের বিষয় স্মরণ করিয়ে দিলো। যদিও আমার তা দিব্যি স্মরণ ছিল। মুখোমুখি বসে আলাপ শুরু করলাম।
: এসএসসি এবং এইচএসসিতে তোমার রেজাল্ট কী?
: এসএসসিতে জিপিএ-৩.৮৪ এবং এইচএসসিতে জিপিএ-৫। (ভাবলাম এইচএসসিতে সাধারণত খারাপ হয়, রায়হানের উল্টো)
: ভর্তি পরীক্ষায় পজিশন কত ছিল?
: রাবিতে ২৫তম, ঢাবিতে ২৭১।
: ঢাবিতে পড়লে না কেন?
: আমাকে ঢাবিতে পড়ানোর মতো সক্ষমতা বাবার নেই।
রায়হানের উত্তরগুলো ক্রমেই আমাকে অবাক করতে লাগলো এবং আমার ভিতরের আগ্রহটা আরও ছাপিয়ে জেগে উঠলো।
: এসএসসিতে খারাপ করার কারণ কী?
: অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনায় সময় দিতে পারিনি। বাবার কৃষিকাজে সাহায্য করতে হতো। বাস্তুভিটাটাই ছিল আমাদের একমাত্র সম্পদ। আমাকে পড়াশোনা করানোর ব্যাপারে বাবার কোনো আগ্রহ ছিল না। তখনো এক বোনের বিয়ে হয়নি। ভোর হলে বাবা আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে বর্গার জমিতে নিয়ে যেত। দেরি হলে রাগারাগী করতো। আমি বাবাকে বাঘের মতো ভয় করতাম। জমিতে কাজ করতে করতে স্কুলের সময় পেরোয়ে যেত। তবে স্কুল আমাকে খুব টানতো। স্কুলে যেতে পারতাম না। আমার মা সোজাসরল, মানুষ, বাড়ির বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে তার কোনো জ্ঞান বা ধারণা ছিল না। জেএসসিতে খারাপ করেছিলাম, পরে একরকম জেদ করেই পড়াশোনার জন্য দিনাজপুর শহরে চলে যাই। একটা টিউশনি করে কোনমতো সেখানে দিন কাটাতাম। এসএসসি পরীক্ষা সেখান থেকে দেওয়া।
: স্কুলের বেতন, মেস ভাড়া, খাওয়া খরচ এগুলো কীভাবে ব্যবস্থা করতে?
: একদিন মাগরিবের নামাজ শেষে দোয়া করি- আল্লাহ এ বিপদ থেকে আমাকে রক্ষা করো। দোয়া শেষে হাউমাউ করে চিৎকার করে কাঁদতে থাকি। মেসে কয়েকজন ছিল, তারা ছুটে এলো, মহিলা মেস মালিকও ছুটে এলেন। কেউ-ই সান্ত্বনা দিয়ে আমার কান্না থামাতে পারলো না। অনেক পরে আমি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ভদ্রমহিলার আন্তরিক জিজ্ঞাসায়, মেস মালিককে আমার আর্থিক ও পারিবারিক অবস্থা খুলে বললাম। তিনি আমার মাসিক সিট ভাড়া মওকুফ করে দিলেন। পরে মেসের দেখাশোনার দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত করলেন। মেসের কে কোথায় গেলো, কী করলো, মাসিক ভাড়া কার বাকি রইলো ইত্যাদি বিষয় আমাকে দেখভাল করতে হতো।
: মহিলা মালিকের স্বামী কী করতেন?
: আংকেল কিসে যেন চাকরি করতেন, অবসর গ্রহণের পর মাঝেমধ্যেই অসুস্থ থাকতেন। সংসারের কর্তৃত্ব আন্টির হাতে ছিল। আন্টির কথার বাইরে আংকেলের কিছু বলার থাকতো না। আরও পরের দিকে আন্টি তার পরিবারের বাজার করা, বিদ্যুতের বিল দেওয়া, মেসের টাকা তোলাসহ কিছু কাজ আমাকে দিয়ে করিয়ে নিতেন।
: এসএসসিতে রেজাল্ট খারাপ হওয়ার কারণ কি এগুলো?
: না, আমার প্রস্তুতি ভালো ছিল, কিন্তু করোনা মহামারির কারণে অটো পাসের সিদ্ধান্ত হলে মনটা খারাপ হয়ে গেল। জেএসসির রেজাল্ট থেকে ম্যাপিং করে আমার রেজাল্ট এলো ৩.৮৪। পরীক্ষা হলে আমি জিপিএ-৫ পেতাম। এই রেজাল্ট বাবাকে বললে আমাকে আর পড়াশোনা করতে দেবে না। কিছুই করার ছিল না, এবার আমি মাকে বলে একরকম গোপনে আবার শহরে এক মিশনারি কলেজে ভর্তি হলাম। যেখানে আমি ফ্রি স্টুডেন্টশিপ পেলাম। নিজে প্রাইভেট পড়াতাম আর সায়েন্সের সাবজেক্টগুলো কলেজের স্যারদের কাছে পড়তাম। স্যারেরা সার্বিক অবস্থা জেনে আমাকে ফ্রি পড়াতেন।
: ভর্তির সময় একটা মোটা অংকের টাকার প্রয়োজন হয়, কে সাহায্য করলো?
: বাবা আমাদের তিনটা ছাগল ত্রিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে আমাকে দিয়েছিল। ভর্তিতে সর্বসাকুল্যে দশ-এগারো হাজার টাকার মতো লেগেছে। বাকি টাকায় ছয় মাস আমার খরচ চালিয়েছি।
: তারপর?
: আমার অসুস্থতা এখানেই শুরু। টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়ে মাসখানেক আমি দিনে একবার অর্থাৎ শুধু রাতে খেয়েছি। আমার ওজন ৬৭ থেকে কমতে কমতে ৫২-তে ঠেকেছে। দুর্বল হয়ে পড়তে থাকলাম, কোন কাজে মন বসাতে পারতাম না। পরে ক্লাস ফাইভের একটা টিউশনি পেলাম, দেড় হাজার টাকা মাস। আমি কী করব, কীভাবে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা চালিয়ে নেব, বাবার কাছে টাকা চাইলে তিনি স্রেফ বলে দেবেন তোর পড়ার দরকার নেই, বাড়ি চলে আয়। এমন কথা আমি কলেজে থাকাকালীন বহুবার শুনেছি। এমন রাশি রাশি দুশ্চিন্তা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরলো। রাতে ভালো ঘুমাতে পারতাম না। পড়াশোনার প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমাকে ফিরে যেতে হবে হয়তো, এসব ভেবে আমি একা একা কেঁদেছি...বলতে বলতে রায়হানের টলমল করা দু’চোখ ভারী হয়ে গাল বেয়ে দু’ফোঁটা জল নেমে আসতে লাগলো। সে চট করে ডান হাতের তালু দিয়ে জল মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো আবার।
আমি তাকে সান্ত্বনা দিলাম, ভেঙে না পড়ার পরামর্শ দিলাম। শিক্ষক হিসেবে আমি তোমার বাবার মতোই অভিভাবক বলে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। যে কোন বিপদে তার পাশে থাকবো বলে আশ্বস্ত করলাম। নানাভাবে সাহস দিয়ে, অভয় দিয়ে অবশেষে রায়হানকে শান্ত করতে পারলাম। তাৎক্ষণিক কিছু টাকা দিতে চাইলে সে কিছুতেই নিতে চাইলো না। অনেক পীড়াপীড়ির পর রাজি হলো।
তিন.
কাউন্সেলিং করলে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে এই ধারণা থেকে পরের শনিবার রায়হানকে আবারও ডাকলাম। মনের চাপা কষ্ট আমার সঙ্গে শেয়ার করে রায়হান কিছুটা স্বস্তি পেলো বলে মনে হলো। শিক্ষক-বন্ধুসহ কেউ কেউ তাকে ইন্ডিয়া বা ঢাকায় ভালো চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দিয়েছিল। পরামর্শের প্রতিক্রিয়ায় সে আমাকে বলেছিল- ‘আমার কি এরকম উন্নত চিকিৎসার সামর্থ্য আছে স্যার! কেউ-ই আমার কথা আপনার মতো করে এত সময় নিয়ে শুনতে চায়নি। সবাই ডিগ্রিধারী ভালো ডাক্তার হলেও কেউ-ই আমাকে ২-৩ মিনিটের বেশি সময় দিয়ে কথা বলেনি।’
আমার নিজের উপলব্ধিও রায়হানের মতোই। সিম্পটোমেটিক ট্রিটমেন্টে এ ধরনের অসুখ ভালো হয় না। মেন্টাল সাপোর্টের পাশাপাশি মোটিভেশন ধীরে ধীরে এ অসুখ সারিয়ে তুলতে পারে। আমাদের আলাপ শুরু হলো আবার।
: তোমাদের গ্রামে সচ্ছল কোনো মানুষ নেই?
: স্যার, ধনী মানুষ অনেকেই আছে। তথাকথিত সমাজসেবক অনেকেই আছে। তবে সমাজের মানুষের সেবা করার কেউ নেই। তারা আরও বড় সমাজসেবক হতে চায়, স্যার। সততার বালাই নেই কারও। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহও নেই। স্মাগলিং ব্যবসার সুবাদে অনেকে ছনের বাড়ি থেকে তিন-চার তলা বিল্ডিংয়ের মালিক। ভারতীয় সীমান্তবর্তী আমাদের গ্রাম নন্দনপুর, বাড়ি থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে কাঁটাতারের বেড়া দেখা যায়, প্রতি সন্ধ্যায় রাস্তার মোড়ে চলে টাকার ভাগাভাগি, চেঁচামেচি আর গন্ডগোল। আমার বাবা এগুলোতে আপত্তি জানালে শুরু হয় বিপত্তি। অসৎ উপার্জনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায় বাবাকে গ্রামের মানুষ শত্রু মনে করে। আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া মানুষ আমাদের বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত করার হুমকি দেয়। আমি রাবিতে ভর্তি হওয়ার পর এর মাত্রা আরও বাড়তে থাকে। আমাদের নানাভাবে বিরক্ত-বিদ্রƒপ করে, গ্রামছাড়া করার হুমকি দেয়।
: বাবার সঙ্গে কথা হয়?
: হয়, তবে টাকার কথা বলতে পারি না। শুধু বলি আমি ভালো আছি, আমার পড়াশোনা ঠিকমতো চলছে।
এক সুবোধ ছেলে রায়হান। বাবা শুনলে বিচলিত হয়ে উঠবেন ভেবে নিজের কষ্টগুলো চেপে রাখে, মা-বাবাকে শেয়ার করে না। তোমার বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসে এবং পড়াশোনাও করাতে চায়। না হলে তার ছাগল বিক্রি করতো না। আমার এমন মন্তব্যে সে আবারও নিশ্চুপ হয়ে গেলো। গলাটা চেপে এলেও সামলে নিল। ওর অব্যক্ত উত্তর আমাকে নিজের মতো করে পড়ে নিতে হলো।
: ঈদে বাড়ি গিয়েছিলে?
: গিয়েছিলাম, ঈদের পর পর-ই চলে এসেছি। বাড়ি গেলে কারো সাথে মিশতে ভালো লাগে না।
: তোমার চাচা ফুফা, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন?
: চাচা রাজনীতি করতেন। ভোট করতে করতে সম্পদ নষ্ট করে ফেলেছেন। দুই গ্রাম পরে ফুফার বাসা, ফুফাতো ভাই ঢাকায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ে। সে আমার মা-বাবাকে ফোন করে বারবার আমাকে ফার্মেসি পড়াতে নিষেধ করে। ফার্মেসি পড়ে কী হবে, শুধু টাকা নষ্ট, পরে বেকার হয়ে বসে থাকতে হবে... ইত্যাদি।
অন্তত উৎসাহ দিয়ে হলেও রায়হানকে সহযোগিতা করার কেউ ছিল না। মনের শক্তি ছাড়া কেউ-ই কখনো দুর্জয়কে জয় করতে পারেনি। মানুষের শরীর এক জাদুর বাক্স, যেখানে নিত্যদিন নতুন নতুন জাদুর খেলা চলে মনের শক্তিতে। যার মনের শক্তি যত বেশি তার পরাজিত হওয়ার শঙ্কা তত কম। ফুফাতো ভাইয়ের রায়হানকে নিরুৎসাহিত করার কারণ আমার এবং রায়হানেরও জানা।
: প্রথম বর্ষ প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা কেমন হয়েছে?
: আলহামদুলিল্লাহ ভালো হয়েছে।
: তুমি মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গে এসে কথা বলো, অন্তত সপ্তাহে একবার।
: জি স্যার।
রায়হান চলে যায়। আমি অফিসে ডেকে নিয়ে অথবা সেলফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে থাকি, খোঁজখবর নিই প্রতি সপ্তাহেই। তার বিষণ্নতা, অবসাদগ্রস্ততা দূর হতে থাকে ধীরে ধীরে। একদিন দুই ক্লাসের মধ্যবিরতিতে একরকম ছুটে আসে রায়হান আমার অফিস রুমে। এত উজ্জ্বল, হাসিমাখা, আর ঝিলিক ছড়ানো মুখ এর আগে দেখিনি। কখনো পায়ের পাতার সামনের অংশে ভর করে দাঁড়ায় আবার কখনো গোড়ালিতে ভর করে। শ্রাবণে ধানের কচি পাতায় ঢেউ খেলানো দমকা হাওয়ার দোলা যেমন, ঠিক তেমনি গা দুলিয়ে সে আমাকে জানালো- ‘রেজাল্ট হয়েছে স্যার।’
: কেমন করেছ?
: সেমিস্টার ফাইনালে ৩.৯৪ পেয়েছি। (আউট অফ ৪)।
: সাব-বাস! ব্রেভো, ব্রেভো!
আমি তাকে সাবাসি দিলাম কয়েকবার। খুশিতে আমিও কেঁপে উঠলাম যেন তার সাথে সাথে। এই ছোট্ট অনুপ্রেরণাই রায়হানের সাথী হবে হয়তো আগামী দিনের।
রায়হানরা এগিয়ে যায় প্রাণের অদম্য শক্তি নিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার প্রত্যয়ে।