তাঁর প্রয়াণ আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে, আমাদের নির্বাক করে দিয়েছে। স্যার, আপনাকে বিদায় বলিনি। বলব না কোনো দিন। আপনি আমার সঙ্গে ছিলেন, আমাদের সঙ্গে ছিলেন। অনাগত দিনেও থাকবেন। থাকবেন মাথার মুকুট হয়ে।
গত কুড়ি বছরে বাংলা ভাষার জ্যেষ্ঠ লেখকদের মধ্যে যাঁদের অপত্যস্নেহ পেয়েছি, তাঁদের মধ্যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একজন। সেই তেরো-চৌদ্দ বছর আগে, সাহিত্যের অন্ধিসন্ধি খুঁজে বেড়ানোর দিনগুলোতে, তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। আমি তখন উপন্যাস-সাহিত্যকে ভালোভাবে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছি। উপন্যাস লিখে হাত মকশো করছি এবং বিশ্বসাহিত্যের সেরা উপন্যাসগুলোর পাঠ নিচ্ছি। পাশাপাশি করছি সাংবাদিকতা। কাজ করছি একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে। সেই পত্রিকার জন্য একটি সাক্ষাৎকার নিতে একদিন গেলাম সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কাছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ইংরেজি বিভাগের কার্যালয়ে। সাক্ষাৎকারের ছকবাঁধা প্রশ্নের বাইরে সেদিন আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাংলা ভাষার উপন্যাসগুলো সম্পর্কে। জিজ্ঞেস করেছিলাম পাঠক হিসেবে কোন উপন্যাসগুলো পড়ব সে বিষয়ে। তিনি প্রথমেই বলেছিলেন সৈয়দ শামসুল হকের ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনি’ উপন্যাসটির কথা। বলেছিলেন, পড়ে দেখ। পড়ে বুঝবে হক ভাই আমাদের সময়ের কত বড় লেখক।
তখনো আমি সৈয়দ হকের উপন্যাস ‘খেলারাম খেলে যা’ এবং কবিতা ছাড়া তাঁর কোনো গল্প-উপন্যাস পড়িনি। আমার কৌতূহল জাগল। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মতো সাহিত্যের অধ্যাপক যে উপন্যাসের প্রশংসা করছেন, নিশ্চয়ই সেটি সেরা উপন্যাস। পড়তেই হবে। বিকেলে অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে আজিজ সুপার মার্কেট থেকে ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনি’ কিনে নিয়ে গেলাম। রাতেই পড়তে শুরু করে দিলাম। দুদিনের মধ্যেই পড়ে শেষ করে ফোন দিলাম সৈয়দ শামসুল হককে। উপন্যাসটির পাঠউপলব্ধি জানালাম তাঁকে। জানালাম উপন্যাসটির হদিস যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম দিয়েছেন। হক ভাই বললেন, তুমি মনজুরুলের ‘আজগুবি রাত’ পড়েছ? পড়িনি, বললাম আমি। হক ভাই বললেন, দ্রুতই পড়ে নাও। তুমি উপন্যাস লিখছ। ক্ল্যাসিক উপন্যাসগুলোর পাশাপাশি সমকালীন ঔপন্যাসগুলোও তোমার পড়া দরকার। মনজুরুলের সঙ্গে দেখা হলে আমার শুভেচ্ছা জানিও।
পরদিনই কিনে নিলাম ‘আজগুবি রাত’ উপন্যাসটি। পড়া শুরু করলাম। এরই মধ্যে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে গেল আমার নেওয়া স্যারের সাক্ষাৎকারটি। কয়েক কপি পত্রিকা নিয়ে আবার দেখা করতে গেলাম তাঁর সঙ্গে। স্যার সেদিন ব্যস্ত ছিলেন। হয়তো কোনো ক্লাস নিচ্ছিলেন, কিংবা কোনো মিটিংয়ে ছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর তিনি এলেন। বললাম ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনি’ পড়ার কথা। বললাম তিনি না বললে এই অসাধারণ উপন্যাস পাঠের স্বাদ পেতে যে হয়তো আরও দেরি হয়ে যেত, সেকথা। বললাম তাঁর ‘আজগুবি রাতে’র পাঠ শুরু করার কথাও। বললাম, সৈয়দ হক যে তাঁর এই উপন্যাসের হদিস দিয়েছেন, সে কথাও।
আমি যে পত্রিকায় কাজ করতাম সেই পত্রিকায় ‘সেই সময়’ নামে একটি বিভাগ ছিল। গুণীজনদের বিশেষত লেখকদের শৈশব-কৈশোর নিয়ে লেখা ছাপা হতো। অধিকাংশ লেখা আমিই লিখতাম। সেদিন মনজুর স্যারকে বললাম, স্যার, আমি আপনার শৈশব-কৈশোর লিখতে চাই। স্যার বললেন, ওটা লিখে তুমি কী করবে? আমি বললাম পত্রিকার সেই সময় বিভাগটির কথা। স্যার জানতে চাইলেন, কোন প্রক্রিয়ায় লিখব। বললাম, আপনি বলবেন, আর আমি টেপরেকর্ড করব। স্যার রাজি হলেন। বলতে লাগলেন তাঁর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি, আর আমি রেকর্ড করতে লাগলাম। ‘চতুর্থ শ্রেণী থেকেই স্কুল জীবনের শুরু’ শিরোনামে লেখাটি ছাপা হলো পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আমার ‘খ্যাতিমানদের শৈশব’ বইতেও এই লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়।
প্রথম দিন স্যারের যে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলাম, সেই সাক্ষাৎকারে সম্পাদকের দেওয়া ছকবাঁধা প্রশ্নের বাইরে তাঁকে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তাঁর হাতে সময় ছিল। তিনি আন্তরিক ভঙ্গিতে আমার জিজ্ঞাসার জবাব দিয়ে যাচ্ছিলেন। একটি প্রশ্ন ছিল ভাষা নিয়ে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে মান বাংলা এবং আঞ্চলিক বাংলা নিয়ে খুব কথা হচ্ছে এখন। একজন সাহিত্যিক হিসেবে, সাহিত্যের একজন অধ্যাপক হিসেবে এ বিষয়ে আপনার কী অভিমত?”
উত্তরে স্যার বলেছিলেন, “এই ব্যাপারে আমার একটা পরিষ্কার অবস্থান আছে। আমি আঞ্চলিক ভাষায় খুব বিশ্বাসী। নিজেও আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করি। আবার একই সঙ্গে আমি একটা মানসম্পন্ন ভাষাতে বিশ্বাস করি। কারণ, এই ভাষাটা একটা সুশৃঙ্খল ভাষা। শৃঙ্খলা না থাকলে আমি দর্শনের বিষয়গুলো, বিজ্ঞানের বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে পারব না। শৃঙ্খলা ভাষার একটা পরিভাষা। পরিভাষা সর্বসম্মত হয়। বহুজনের একটা স্বীকৃত ভাষা, যে ভাষা আমাদের মেধা ও মননের প্রকাশ ঘটাবে। আমি যখন একটা আনুষ্ঠানিক কথা বলতে যাব, আমি সেই সর্বজনের গ্রহণযোগ্য একটা মানসম্পন্ন ভাষায় কথা বলব। কবিতা তো একটা পরিশীলিত প্রকাশ। সেই কবিতাতে যদি আমি ‘আইছলাম, খাইছলাম’ ইত্যাদি ভাষা ব্যবহার করি, তাহলে কয়জন পড়বে?
ফলে আমার একটা ভাষার দরকার। একইসঙ্গে আঞ্চলিক ভাষাও চর্চা হবে। যখন আমি উপন্যাস লিখছি সংলাপে আঞ্চলিক হোক না, অসুবিধা কী? কিন্তু দর্শনের, বিজ্ঞানের প্রকাশের জন্য একটা ভাষা লাগবে না? একজন ফরাসি লেখক তো ফরাসি-জার্মান ভাষা মিলিয়ে বিকৃত করেননি। আমি কেন বাংলা ভাষার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে বিকৃত করব? আপনি খেয়াল করবেন, হিন্দি সিনেমাতে কিন্তু এসব চলে না। সেখানে একদম পরিশীলিত হিন্দি ভাষা ব্যবহার হয়। যত দায় বাংলা ভাষা নিয়ে। এটা আমাদের হীনম্মন্যতা, এটা দাসত্ববোধের একটা প্রকাশ। বিশ্বমিডিয়া আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে, আমাদের ভাষা নিষ্ক্রিয় করে দেবে তারা, আমাদের বুদ্ধি রহিত করে দেবে। স্খলিত ভাষায় কোনো সাহিত্য হয় না, স্খলিত ভাষায় কোনো পরিষ্কার চিন্তা হয় না। ফলে তারা আমাদের একটা নির্বুদ্ধি জাতি তৈরি করে পশ্চিমের যত কিছু আমাদের ওপর চাপিয়ে দেবে। সেটা মোবাইল ফোনই হোক আর ফেয়ার এন্ড লাভলি ক্রিমই হোক।”
উপন্যাসে ভাষার ব্যবহার নিয়ে আমার ভেতরে যে দোদুল্যমানতা ছিল, স্যারের এই কথাগুলো শোনার পর সেই দোদুল্যমানতা কেটে গিয়েছিল। ভাষার প্রশ্নে দিশাহারা আমি একটা দিশা খুঁজে পেয়েছিলাম। আমার উপন্যাসের ভাষা কেমন হবে, কোন ভাষাকে আমি উপন্যাসে প্রয়োগ করব এবং কীভাবে করব সে ব্যাপারে আমি একটা স্পষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছিলাম। অর্থাৎ তিনি আমাকে পথ দেখিয়েছেন। না দেখালে সঠিক পথটি খুঁজে পেতে আমার হয়তো আরও অনেক সময় লেগে যেত।
সেই থেকে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কের শুরু। ধীরে ধীরে সম্পর্কটি একটা মাত্রায় উন্নীত হয়েছিল। স্যারের সঙ্গে প্রায়ই আড্ডা হতো। কখনো আমার বাসায়, কখনো কথাসাহিত্যিক মোজাফ্ফর হোসেনের বাসায়। আড্ডায় আমাদের কথা হতো সাহিত্য নিয়ে, শিল্প নিয়ে, সাহিত্যের কলাকৌশল নিয়ে। আমি নানা বিষয়ে প্রশ্ন করতাম। স্যার সুন্দর করে উত্তর দিতেন। কখনো বিরক্ত হতেন না, আনন্দের সঙ্গে আমাদের প্রশ্নসমূহের উত্তর দিতেন। আমার মনে হতো, আমার প্রশ্নসমূহের উত্তর দেওয়ার মানুষ একজনই আছেন, তিনি সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
স্যারের সঙ্গে সর্বশেষ আড্ডাটি হয়েছিল তাঁর প্রয়াণের কয়েক মাস আগে, কথাসাহিত্যিক ওয়াসি আহমেদের বাসায়। তিনি সেদিন ছিলেন আনন্দমুখর। আমাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে রসিকতা করছিলেন। তার মাসখানেক আগে আড্ডা হয়েছিল মোজাফ্ফরের বাসায়। কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামালও ছিলেন সেই আড্ডায়। স্যার সেদিন সাহিত্য বিষয়ে এত গভীরের কথা বলছিলেন যে, আমরা মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমি বলেছিলাম, স্যার, আমি যদি আপনার ছাত্র হতাম, আপনার ক্লাসগুলোতে অংশ নিতাম, তবে কত কিছুই না শিখতে পারতাম।
স্যার হাসলেন। সেই বিনয়ের হাসি। হায়! সেদিন কি একবারও ভেবেছিলাম আর বেশি দিন যে তাঁর সঙ্গে আড্ডা দেওয়া হবে না! একবারও কি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম আর বেশি দিন যে শিল্পসাহিত্য বিষয়ে তাঁর কোনো গভীরের আলাপ শুনতে পাব না! ভাবতে পারিনি। আন্দাজ করতে পারিনি। আমাদের কল্পনাতেও ছিল না স্যার এত জলদি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন সমকালীন বাংলা সাহিত্যের প্রধান গল্পকারদের একজন। তাঁর অগ্রজ গল্পকাররা তাঁর আগেই চলে গেছেন। তিনি ছিলেন। ছিলেন আমাদের দিশারি হয়ে। তিনি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কখনো কখনো অগ্রজদের অনুপ্রেরণার দরকার হয়। অনুপ্রেরণা পেলে অনুজরা নতুন নতুন দিগন্ত আবিষ্কারে এগিয়ে যেতে পারে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সেই অগ্রজ, সর্বদা যিনি অকুণ্ঠচিত্তে অনুজ লেখকদের অনুপ্রাণিত করতেন। স্যারের কোনো সভা-সেমিনারে আমি কিংবা মোজাফ্ফর উপস্থিত থাকলে তাঁর বক্তৃতায় তিনি আমাদের এড্রেস করতেন। আমাদের নাম উল্লেখ করে প্রশংসা করতেন, আমাদের লেখার প্রশংসা করতেন। এটা তিনি না করলেও পারতেন। করতেন আমাদের উৎসাহিত করার জন্য, অনুপ্রাণিত করার জন্য, পাঠকমহলে পরিচিত করে তোলার জন্য।
তাঁর একটি কথা লোকে খুব পছন্দ করেছিল। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো বিজ্ঞানী নেই, গবেষক নেই, দার্শনিক নেই। যেদিকে তাকাবেন শুধুই প্রশাসক।’ কথাগুলো পড়ে মনে হয়েছিল আমি একটি আয়না দেখলাম। সেই আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম নিজের মুখ, জাতির মুখ। লেখকরা এভাবেই বুঝি আয়নার কাজ করেন। এভাবেই জাতির বোধের উদয় ঘটিয়ে দেন।
স্যার হঠাৎ করেই অসুস্থ হলেন। আমাদের প্রত্যাশা ছিল তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। আবার আমরা আড্ডায় বসব, আবার আমরা মেতে উঠব শিল্পসাহিত্য নিয়ে। অথচ তিনি ফিরলেন না। কখনো কখনো নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুও হৃদয় স্পর্শ করে না। আবার কখনো কখনো অনাত্মীয়ের মৃত্যুতে হৃদয় থরথর করে কেঁপে ওঠে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন আত্মীয়ের অধিক আত্মীয়। তাঁর প্রয়াণ আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে, আমাদের নির্বাক করে দিয়েছে।
স্যার, আপনাকে বিদায় বলিনি। বলব না কোনো দিন। আপনি আমার সঙ্গে ছিলেন, আমাদের সঙ্গে ছিলেন। অনাগত দিনেও থাকবেন। থাকবেন মাথার মুকুট হয়ে।