২০১৩ সালে দ্য হোয়াইট রিভিউর এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেছিলেন, ‘যখন আমি কাফকা পড়ছি না, তখন আমি কাফকাকে নিয়ে ভাবি। আর যখন আমি কাফকাকে নিয়ে ভাবছি না, তখন আমি তাকে নিয়ে ভাবনাকে মিস করি।’
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে এক অসুস্থ বন্ধুর বাসায় এসেছেন লাসলো ক্রাসনাহোরকাই।
- হ্যালো, আমি জানিয়ান, নোবেল কমিটি থেকে বলছি। সুইডেনের স্টকহোম থেকে এলো ফোনটা।
-জি।
শান্তভাবে উত্তর দেন ক্রাসনাহোরকাই। কয়েক মুহূর্ত পরই তাঁকে জানানো হয়, তিনি ২০২৫ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
- এটা তো বিপর্যয়ের চেয়েও বেশি!’ হাসতে হাসতে বলেন ক্রাসনাহোরকাই।
সাহিত্য সমালোচকরা মনে করেন, তাঁর নোবেলজয় যেন কয়েক দশক ধরে লেখা এক দীর্ঘ বাক্যের পরিসমাপ্তি। এ স্বীকৃতি প্রমাণ করে, সাহিত্যের অভিনব যে ধারায় তিনি ধীরলয়ে হাওয়া দিচ্ছিলেন, তা রূপ নিয়েছে মহাঘূর্ণিঝড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের লেখক ও সাহিত্য সমালোচক সুসান সনট্যাগ ৭১ বছর বয়সে ২০০৪ সালে মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি, ক্রাসনাহোরকাইকে অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন, ‘সমকালীন সাহিত্যের প্রলয়ের গুরু’ বলে।
এখন ক্রাসনাহোরকাইয়ের বয়স ৭১। নোবেল কমিটিও স্বীকার করে নিয়েছে সুসান সনট্যাগের কথা। তাদের মতে ক্রাসনাহোরকাই শিল্পসংস্কৃতির সীমানা অতিক্রম করে ইউরোপ ও পূর্বের এক সেতুবন্ধ গড়েছেন। কাফকা ও বার্নহার্ডের মধ্য ইউরোপীয় বিষণ্নতা মিশেছে পূর্বের ধ্যানমগ্ন নীরবতার সঙ্গে। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সর্বজনীন। তিনি দেখিয়েছেন, যখন বিশ্বাস টলে যায়, ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তখন শিল্পই থেকে যায় স্বচ্ছতার শেষ আশ্রয় হিসেবে। মানব সভ্যতার ভঙ্গুরতা তুলে ধরার দক্ষতাই তাঁকে অনন্য করেছে। নোবেল সাহিত্য পুরস্কার এমন এক সময়ে এলো, যখন পৃথিবীজুড়ে রাজনৈতিক সংঘাত ও সাংস্কৃতিক বিভাজন ক্রমে বাড়ছে। ক্রাসনাহোরকাইয়ের রচনা সেই অনিশ্চয়তার প্রতিধ্বনি বহন করে।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর গিউলায় জন্ম নেন ক্রাসনাহোরকাই। তাঁর কৈশোর কাটে কমিউনিস্ট শাসনের ঘেরাটোপে। আইনের ছাত্র ছিলেন। আশির দশকে কথাসাহিত্যের জগতে তাঁর আবির্ভাব ঘটে। এর আগে তিনি ছিলেন একজন সম্পাদক। তাঁর প্রথম উপন্যাস সাতানতাঙ্গো (১৯৮৫) একসঙ্গে গ্রামীণ ও প্রলয়ের প্রতিচ্ছবি। এক বৃষ্টিভেজা গ্রাম, যেখানে প্রতারণা, মদ, গুজব ও ভ্রমই জীবনের চালিকাশক্তি। চলচ্চিত্র নির্মাতা বেলাতার এই উপন্যাসটি অবলম্বনে নির্মাণ করেন সাত ঘণ্টার সাদা-কালো চলচ্চিত্র। এটি হয়ে ওঠে ক্রাসনাহোরকাইয়ের স্বাক্ষররীতির দারুণ প্রতিচ্ছবি। এই কাজের মাধ্যমেই তিনি শুরু করেন তাঁর ‘সামাজিক প্রলয়ধর্মী’ মহাকাব্যিক ধারার রচনা। তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো, দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮) তাঁর ধারাবাহিক প্রলয়চিত্রকে যেন দার্শনিক ও মহাজাগতিক উচ্চতায় নিয়ে যায়। ক্রাসনাহোরকাইকে বহুদিন ধরে কাফকার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস তাঁকে বর্ণনা করেছে, ‘ভয়াবহ, কাফকাসুলভ তীব্রতার এক লেখক’ হিসেবে। অনুবাদক জর্জ সির্টেস লিখেছেন, ‘তাঁর বইগুলো কাফকার মতো একই মধ্য ইউরোপীয় বন থেকে এসেছে।’ অবশ্য ক্রাসনাহোরকাইয়ের কাছে কাফকা শুধুই প্রভাব নয় বরং এক আত্মিক সঙ্গী, যার চিন্তা ও সৃষ্টি একই সঙ্গে উপস্থিত। ২০১৩ সালে দ্য হোয়াইট রিভিউর এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেছিলেন, ‘যখন আমি কাফকা পড়ছি না, তখন আমি কাফকাকে নিয়ে ভাবি। আর যখন আমি কাফকাকে নিয়ে ভাবছি না, তখন আমি তাঁকে নিয়ে ভাবনাকে মিস করি।’ শুরুর দিকে তাঁর রচনাকে অনেকেই ‘দুর্বোধ্য’ মনে করতেন। এখন এটি পোস্টমডার্ন সাহিত্যকর্মের উদাহরণ। তাঁর উপন্যাসের লিখনকাঠামো জটিল। কখনো কখনো একটি মাত্র অনুচ্ছেদকে তিনি পাতার পর পাতায় বিস্তৃত করেন কোনো রকম যতিচিহ্ন ছাড়াই। প্লট যখন উপস্থিত হয় তখন বাঁধভাঙা বাক্যরাশি জড়ো করেন তিনি। মানুষের আবেগ ও চিন্তার অস্থির প্রবাহের অনুকরণে তাঁর উপন্যাসে থাকে অন্তহীন অনুচ্ছেদ। এগুলো পাঠককে গভীর অস্থিরতার ভিতরে টেনে নিয়ে যায়। বাক্যগুলো মন্ত্রোচ্চারণের মতো এগিয়ে চলে। এগুলো পাক খায়, প্রসারিত হয় কিন্তু শেষ হতে চায় না। তাঁর গদ্যে নিঃশ্বাস নেই, আছে শুধু ছন্দ। তাঁর লেখায় প্রথম প্রহরে সূর্যালোকের মতো ফুটে ওঠে অবক্ষয়, সামাজিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা আর সৌন্দর্যের ক্ষণস্থায়ী সম্ভাবনা। সেটা যে প্রেক্ষাপটই হোক না কেন। হোক এক হাঙ্গেরীয় গ্রাম, জাপানি মঠ বা নিউইয়র্কের আলো জ্বলমলে শহর।
তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে ২০০৩ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘এ মাউন্টেন টু দ্য নর্থ, এ লেক টু দ্য সাউথ, পাথস টু দ্য ওয়েস্ট, এ রিভার টু দা ইস্ট’। উপন্যাসটি জাপানের কিয়োটোর একটি রহস্যময় কাহিনি বর্ণনা করেছে। এই উপন্যাসটির ওপর ভিত্তি করে তিনি বিশাল সাহিত্য সংকলন ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ লেখেন। এতে রয়েছে ১৭টি গল্প। গল্পগুলো বিশেষ বিন্যাসে সাজানো হয়েছে। গল্পগুলোতে এমন এক জগতের সৌন্দর্য ও শিল্পের স্থান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যে জগৎ দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং এটির সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায় না। বইটির গল্পের সূচনা হয় নদীর ধারে অপেক্ষারত একটি সাদা বকের মনোমুগ্ধকর চিত্র দিয়ে। বইটির মূল থিমটি জাপানের একটি পৌরাণিক কাহিনি থেকে এসেছে। যেখানে সেইবো নামের এক দেবী এমন এক বাগান পাহারা দেন। যেখানে প্রতি তিন হাজার বছর পর অমরত্বের ফল ধরে। তাঁর গল্পগুলো শিল্প সৃষ্টির প্রক্রিয়া নিয়ে অনুসন্ধান চালায়। কখনো কখনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা এই শিল্প সৃষ্টিকে প্রভাবিত করে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ‘সৌন্দর্য যত ক্ষণস্থায়ীই হোক তা পবিত্রতার প্রতিফলন। আমরা হয়তো তা সহ্য করতে পারি না কিন্তু তা আমাদের মধ্যেই জ্বলে।’ এ বৈপরীত্য, হতাশার সঙ্গে বিস্ময়ের যুগলবন্দি ক্রাসনাহোরকাইকে করে তুলেছে বিরল এক ঔপন্যাসিক হিসেবে। যিনি নৈরাশ্যের ভিতরেই মুক্তির দরজা খুলে দেন। ক্রাসনাহোরকাইয়ের গল্প যেমন গভীর তেমনি রসিকতায় ভরা। তাঁর চরিত্রদের দীর্ঘ মনোলগে কৌতুকের ছদ্মবেশে আসে হতাশা। ব্যারন ভেনকহেইম’স হোমকামিং (২০১৬)-এ এক পরাজিত অভিজাত ব্যক্তি নিজ শহরে ফিরে আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন বিশৃঙ্খলা, গসিপ, উন্মাদনা। দ্য ব্যাফলর পত্রিকা এটিকে বলেছিল, ‘তাঁর সবচেয়ে দীর্ঘ, অদ্ভুত এবং সম্ভবত শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। নৈরাশ্যে ভরা তবু দারুণ।’ ক্রাসনাহোরকাইয়ের জার্মান ভাষার উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ সম্পর্কে নোবেল কর্তৃপক্ষ বলছে, এটি জার্মান সমাজের অস্থিরতাকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। এতে জার্মানির একটি ছোট শহরে সামাজিক অস্থিরতা, হত্যা ও অগ্নিসংযোগের কারণে বিপর্যস্ত জীবনের গল্প তুলে ধরা হয়। সংক্ষিপ্ত রচনাগুলোর মধ্যেও তাঁর স্বতন্ত্র স্বর ধরা পড়ে। স্পেডওয়ার্ক ফর অ্যা প্যালেস (২০১৮)-তে দেখা যায়, নিউইয়র্কের এক গ্রন্থাগারিকের চোখে সাহিত্যিক হেরম্যান মেলভিলের স্মৃতি ও উন্মাদনা মিশেছে।
মধ্য ইউরোপীয় মহাকাব্যিক লেখক, ঐতিহ্যের ধারক এই হাঙ্গেরীয় ঔপন্যাসিক ২০১৫ সালের ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেসময় কোনো একক বইকে নয়, তাঁর পুরো সাহিত্যকর্মকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তাঁর উপন্যাসে মেলে কবিতাসুলভ ছন্দ। অনুবাদক জর্জ সির্টিস ও ওটিলি মুলজেট হাঙ্গেরীয় ভাষার সে অন্তহীন ছন্দ ইংরেজিতে রূপান্তর করেন ছন্দ না ভেঙেই। তাঁর বই ৩০টির বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। প্রায় চার দশক ধরে বিশ্বসাহিত্যে এক ধীর, গভীর ও দার্শনিক ভাষার ভিতর দিয়ে মানুষের অস্তিত্ব, সময় ও পতনের গল্প লিখে চলেছেন তিনি। তাঁর উপন্যাসগুলোতে উন্মোচিত হয় এক ঝুলন্ত প্রলয়। কোনো বিস্ফোরণ নয়, ধীরে ধীরে। বৃষ্টি কখনো থামে না, আলো কখনো বদলায় না। তবু সবকিছু অসহনীয় তাৎপর্যে পূর্ণ। ক্রাসনাহোরকাই আকৃষ্ট হন সেই মুহূর্তে যখন পতনের ঠিক আগমুহূর্তে চিন্তা পচতে শুরু করে আর বিশ্বাসের আলো নিভে আসে। পচন ও ক্ষয়ের বর্ণনা দিতে দিতেও তিনি লেখেন যেন এখনো যা রক্ষা করা সম্ভব, তা বাঁচিয়ে রাখছেন। হোক তা একটি শব্দ, একটি অঙ্গভঙ্গি বা শৃঙ্খলার এক ঝলক।