শিরোনাম
শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

আলোর পথ দেখাচ্ছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জাকারিয়া

আবদুল বারী, নীলফামারী

আলোর পথ দেখাচ্ছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জাকারিয়া

জাকারিয়া হোসাইন (৩১)। আলোর পথ দেখাচ্ছেন জেলার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের। ব্রেইল পদ্ধতিতে পাঠদান করাচ্ছেন নয় শিক্ষার্থীকে। শুধু শিক্ষক হিসেবেই নয়; পরীক্ষক হিসেবেও একমাত্র তিনি।  তিনি নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাখুলি গ্রামের মৃত মকবুল হোসেনের ছেলে। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি।  সমাজ সেবা অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম’-এ অস্থায়ী ভিত্তিতে হাউস প্যারেন্টস কাম শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জাকারিয়া। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানে নয়জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীকে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ানো হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের একমাত্র ভরসা জাকারিয়ার হাত ধরে নিজেদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে এখানকার শিক্ষার্থীরা।  নয়জনের মধ্যে পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে দুজন, নীলফামারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে দুজন ও কালেক্টরেট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে দুজন এবং বাকি তিন জনকে সমাজ সেবার এই কেন্দ্রে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ানো হচ্ছে।  নীলফামারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত জলঢাকা উপজেলার বালাগ্রাম ইউনিয়নের চাওড়াডাঙ্গি গ্রামের এরশাদ আলীর ছেলে মোহাম্মদ মাসুম বলেন, আমি চোখ দিয়ে দেখি না ঠিকই কিন্তু আমার মনের চোখ তো বন্ধ নেই।  আর দশজনের মতো আমি চলাফেরা পড়াশোনা করতে না পারলেও আমিও স্বপ্ন দেখছি ভালো মানুষ হওয়ার এবং পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটি চাকরি করার। নিশ্চয়ই আমি সফল হব।  কালেক্টরেট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ডিমলা উপজেলার নাউতারা ইউনিয়নের বাবলা রহমান জানান, আমি হতাশ নই। আমার মা বুলবুলি বেগম, বাবা শাহান উদ্দিন ও খালা মোহনা বেগম দু’চোখ দিয়ে দেখতে পারেন না কিন্তু তাদের সংসার তো চলছে।  আমিও পিছিয়ে থাকছি না, আমি যেখানে থাকি, আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় সহযোগিতা পাচ্ছি। নিশ্চয়ই পড়াশোনা শেষ করে আমি ভালো কিছু করতে পারব।   স্যার জাকারিয়া যেভাবে আমাদের পড়াশোনা করাচ্ছেন, দেখভাল করেন তাতে পরিবারের মতো মমতা ভালোবাসা দিয়ে করে থাকেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমে চারজনের পদ থাকলেও মাত্র একজন নৈশ প্রহরী ছাড়া স্থায়ী আর কেউ নেই এখানে।  সমাজ সেবা অধিদফতরের প্রবেশন কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন রিসোর্স টিচার পদে অতিরিক্ত রয়েছেন এখানে। বাকি দুজনের মধ্যে জাকারিয়া হোসাইন হাউস প্যারেন্টস কাম টিচার ও তাহেরা বেগমকে বাবুর্চি হিসেবে শিল্প উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ‘নীলসাগর গ্রুপ’ মাসিক সম্মানি দিয়ে পরিচালনা করছে।  হাউস প্যারেন্টস কাম টিচার জাকারিয়া হোসেন বলেন, ‘যখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি তখন ক্রিকেট খেলতে গিয়ে চোখে বলের আঘাত লাগে।  এরই মধ্যে চোখে ব্যথা শুরু হলে ২০০৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাতে আমার দুটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। তখন থেকে আর পৃথিবীর আলো দেখতে পারিনি।  ২০১০ সালে লালমনিরহাট সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি, একই কলেজ থেকে ২০১৩ সালে প্রথম শ্রেণিতে ডিগ্রি (বিএসএস) এবং পরবর্তীতে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে ২০১৫ সালে  মাস্টার্স সম্পন্ন করি।’  তিনি বলেন, সমাজ সেবা অধিদফতর নীলফামারীর তৎকালীন উপ-পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক ২০১৬ সালে আমাকে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম ও ছাত্র সংগ্রহের দায়িত্বের পাশাপাশি পড়াশোনায় সহায়তার জন্য দায়িত্ব দেন।   দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে আমি লালমনিরহাটে ব্রেইল পদ্ধতি রপ্ত করি এবং সেটির ব্যাপকতা ঘটাই এখানে।  জাকারিয়া বলেন, আমার তো বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে সরকারি চাকরির। এখানে দায়িত্বে থেকে ব্যাচেলর অব স্পেশাল এডুকেশন কোর্সটি (বিএসএড) সম্পন্ন করতে পারিনি। কয়েকটি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছি কিন্তু চাকরি হয়নি।  অনেক হতাশা নিয়ে দিনযাপন করছি, ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছি আমি।  সমাজ সেবা সূত্র জানায়, ৭ থেকে ১৩ বছর বয়সী দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের নেওয়া হয় এই শিক্ষা কেন্দ্রে। সরকারি খরচে থাকা-খাওয়া এবং আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে এতে।  পড়ানো হয় ব্রেইল পদ্ধতিতে। শিক্ষার্থীরা এখানে ব্যবহার করেন রাইটিং ফ্রেম, স্টাইলাজ, টকিং ডিভাইস, গণিতের জন্য টেইলার ফ্রেম ও অ্যাবাকাস, দ্রুত গতিতে লেখার জন্য পারকিংস প্রভৃতি।  প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিসোর্স টিচার ও সমাজ সেবা অধিদফতরের প্রবেশন কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন জানান, চারজনের পদ রয়েছে এখানে। কিন্তু স্থায়ীভাবে রয়েছে মাত্র একজন। যিনি নৈশপ্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।    

সর্বশেষ খবর