নারীদের হাতের তুলিতে সাজানো গোছানো গ্রামের তকমা পেয়েছে আলপনা গ্রাম। উত্তরের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। আর বরেন্দ্র অঞ্চল ও কিংবদন্তি ইলামিত্র খ্যাত উপজেলা হলো নাচোল।
এই নাচোলের নেজামপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম টিকইল। এখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বসবাস বেশি। এ গ্রামটি নারীদের বদৌলতে সারা দেশসহ পৃথিবীতে আলপনা গ্রাম নামে পরিচিতি পেয়েছে। বর্তমানে টিকইল গ্রামের নাম আলপনা গ্রাম না বললে মানুষ চিনতেই পারেন না। কেন গ্রামের নাম আলপনা তার রয়েছে নানা কাহিনি। বলা যেতে পারে, এ গ্রামের প্রায় সব নারীই যেন এক একজন কারুশিল্পী। অনন্তকাল ধরে এ গ্রামের নারীরা নিজেদের মাটির তৈরি বাড়িঘর পরিপাটি রাখতে বিভিন্ন গাছের পাতাসহ খড়িমাটি দিয়ে মাটির দেয়ালগুলোতে পাখি ও ফুল এঁকে কারুকার্য ফুটিয়ে তোলেন। বংশ পরম্পরায় বছরের পর বছর গ্রামের নারীরা বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে আলপনা এঁকে আসছেন। কিন্তু প্রচার প্রচারণার অভাবে তা বাইরের মানুষের তেমন নজর কাড়েনি। তবে বর্তমানে পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চলতে থাকায় গ্রামটি এখন আলপনা গ্রাম নামে পরিচিতি পেয়েছে। তাদের শিল্পকর্মের ছোঁয়া সেখানকার প্রতিটি বাড়িঘরে দেখা যায়। হিন্দু-অধ্যুষিত এ গ্রামের প্রতিটি বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে শোভা পায় হাতে আঁকা নানা আলপনা। এ গ্রামের প্রতিটি বাড়ির দেয়ালই যেন একেকটি ক্যানভাস।
মাটির তৈরি এসব বাড়ির ভিতরের-বাইরের কোনো দেয়ালই বাদ পড়ে না তুলির আঁচড় থেকে। রান্নাঘর থেকে শোয়ার ঘর, তুলসীতলাসহ প্রতিটি দেয়ালই মেয়েরা ভরে ফেলেন হাতে আঁকা আলপনায়। টিকইল তথা আলপনা গ্রামের সনাতন নারীরা দেয়ালে দেয়ালে আলপনা এঁকে বাড়ির সৌন্দর্যবর্ধনের সঙ্গে সঙ্গে দেবতার আশীর্বাদও কামনা করেন। তবে এ গ্রামের গৃহিণী ও নারীরা দেয়ালগুলোতে সবচেয়ে বেশি আলপনা আঁকেন পূজা-পার্বণ উপলক্ষে। আর এসব বর্ণিল আলপনা বছর ধরে শোভা পায় দেয়ালজুড়ে। টিকইল গ্রামের দেয়ালে দেয়ালে কারুকাজ দেখে ২০১৯ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক গ্রামটির নাম আলপনা গ্রাম নামে ঘোষণা করেন এবং অবহেলিত এ গ্রামে ২৯টি সোলার প্যানেলের মাধ্যমে গ্রামটিকে আলোকিত করেন। স্থানীয়দের মতে, সুদূর অতীত থেকেই এ গ্রামে আলপনা আঁকার রীতি চলে আসছে। অনেক আগে বিভিন্ন পূজা-পার্বণে এখানকার হিন্দু পরিবারের বধূরা বাড়ির দেয়ালে সাদা রঙের তিনটি ফোঁটা এঁকে তার নিচ দিয়ে দাগ দিয়ে খুব সুন্দর আলপনা আঁকতেন। এ ছাড়াও আগের দিনে ছেলের জন্য পাত্রী দেখার সময় পাত্রীর বাড়িতে আলপনার সৌন্দর্যও দেখতেন মুরব্বিরা। তারপর থেকেই ঘরের দেয়ালে আলপনা অঙ্কনের প্রচলন শুরু হয়। তবে এখন আর তিন ফোঁটার সাদা আলপনা নয়, কল্পনার সব রংই এখন ব্যবহার করা হয়। কল্পনার নানান চিত্র ও ছবি উঠে আসে আলপনায় রঙের ছটায়। দেখতে যেন পরীর দেশের মতো। এখানে রং-তুলিতে আঁকা হয় নানান রকমের চিত্র। লাল, নীল, সাদাসহ হরেক রকমের সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করা হয়। এ গ্রামের মেয়ে ও বধূরা আলপনায় প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করেন। আলপনা গ্রামের মূল কারিগর বেখন বর্মণ জানান, বাড়ির দেয়ালে আঁকা আলপনা স্থায়ী করতে রংও তৈরি করেন অনেক গৃহিণী। শুকনা বরই, আম আঁটির শাঁস চূর্ণ, চকগুঁড়া, মানকচু ও কলাগাছের কষ বিভিন্ন রঙের সঙ্গে মিশিয়ে তারা নিজেদের মতো রং তৈরি করেন। আর ওই রঙে আঁকা আলপনা সারা বছর টিকে থাকে মাটির দেয়ালে। ওই গ্রামের তরুণ আলপনা শিল্পী কৃষ্ণা রায় জানান, মা এবং দাদির আঁকা দেখে আলপনা আঁকতে শিখেছেন তিনি। কোনো উৎসব এলেই তার ব্যস্ততা বেড়ে যায় রং-তুলি নিয়ে। তার বয়সি গ্রামের অনেক মেয়েকে আলপনা আঁকার কাজটিও শেখান তিনি।
এদিকে লোকজ গবেষক ড. মাজহারুল ইসলাম তরু আলপনা গ্রাম সম্পর্কে বলেন, আলপনা একটি রুচিশীল শিল্পের পরিচয় বহন করে। আর এ গ্রামের মানুষ সব সময় পরিপাটি আলপনা এঁকে বাড়ি ঘরের সৌন্দর্যবর্ধন করে থাকেন। তাই এ গ্রামের কোনো শিশুর জন্ম হলে সেও রুচিশীলতার মধ্যে বড় হতে থাকে বলে বড় হয়ে সেও একজন রুচিশীল মানুষে পরিণত হয়ে একসময় আলপনা আঁকতে থাকে। তাই শিল্প মাধ্যমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে বংশ পরম্পরায় গ্রামটি আলপনা গ্রাম হিসেবে গড়ে উঠেছে। বর্তমানে গ্রামটি আলপনা গ্রাম হিসেবে গড়ে ওঠায় এ গ্রামেরই বাসিন্দা দাসু বর্মণের বাড়িতে দর্শনার্থীদের জন্য একটি পরিদর্শন খাতা রাখা হয়েছে। যেখানে আলপনা গ্রামের সৌন্দর্য দেখে দর্শনার্থীরা পরিদর্শন খাতায় তাদের মন্তব্য লিখে রেখে যান। গ্রামটি দর্শনীয় স্থান না হলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ সাজানো গোছানো আলপনায় আঁকা গ্রামটি দেখতে আসেন।