ঈশা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জঙ্গলবাড়িতে চলছে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ঢাকা ও ময়মনসিংহ আঞ্চলিক কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে এ খননকাজ পরিচালিত হচ্ছে। খননকাজে উঠে আসছে সুলতানি, মোগল এবং তারও আগে বা পরের সাংস্কৃতিককাল পর্বের ইটের দেয়াল এবং বেশ কিছু মৃৎপাত্রের ভাঙা অংশ। করিমগঞ্জ উপজেলার কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নের নরসুন্দা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে ঈসা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত জঙ্গলবাড়ি দুর্গ। মুঘল শাসনামলে এটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় রাজধানী। ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যেসব শাসক যুদ্ধ করেছিলেন, সেই বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম ছিলেন মসনদ-ই-আলা বীর ঈসা খাঁ। ঈসা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক দুর্গটি অযত্ন আর অবহেলায় প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সম্প্রতি দরবার হলটি সংস্কার করে পুরোনো অবয়ব অনেকটা ফিরিয়ে এনেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। তবে ভিতরের অন্দরমহলটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এটিও সংস্কার করা হবে বলে জানা গেছে। এ বাড়ির বাসিন্দা দেওয়ান জামান দাদ খান আনোয়ার বলেন, তার বাবা দেওয়ান আমিন দাদ খান ছিলেন ঈসা খাঁর ১৪তম বংশধর। সে হিসেবে তিনি ঈসা খাঁর ১৫তম বংশধর। তার বাবার স্বপ্ন ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক এ বাড়িটি যেন সংস্কার করে এর ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা হয়। যেন পরবর্তী বংশধররা তাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস, জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানতে পারে। নিরাশা নিয়েই তার বাবা প্রয়াত হয়েছেন। এখন যে সংস্কার হচ্ছে এটিকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, একসময় আমরা থাকব না; কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে তাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস এবং জীবনধারা। এটা ভেবেই তিনি আনন্দিত। ঈসা খাঁর মূল রাজধানী সোনারগাঁয়ে হলেও জঙ্গলবাড়ি ছিল তার দ্বিতীয় রাজধানী। জঙ্গলবাড়ি দুর্গ থেকেই তিনি বিশাল ভাটি বাংলা শাসন করতেন। জঙ্গলবাড়ি দুর্গের সামনে রয়েছে সেই আমলের খনন করা বিশাল পরিখা, পাশেই মসজিদ ও কবরস্থান। ধারণা করা হয়, ঈসা খাঁর হাতেই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল এবং কবরগুলো তার পরবর্তী বংশধরদের। বিভিন্ন ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, ঈসা খাঁর আদি নিবাস ছিল আফগানিস্তানে। মোগল ও ইংরেজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ বাংলার জমিদাররা তাকে সংবাদ পাঠালে তিনি ১ হাজার ৪০০ ঘোরসওয়ার, ২১টি নৌবিহার ও গোলাবারুদ নিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যে পৌঁছান। ১৫৮৫ সালে কোচ রাজা লক্ষ্মণ হাজরাকে পরাজিত করে জঙ্গলবাড়ি দুর্গটি দখল করে নেন ঈসা খাঁ। দুর্গটি দখলের পর তিনি দুর্গের ভিতরে কিছু স্থাপনা নির্মাণ করেন এবং তিনদিকে পরিখা খনন করে নরসুন্দা নদীর সঙ্গে যুক্ত করে দুর্গটিকে গোলাকার দ্বীপে রূপান্তরিত করেন। তবে মূল দুর্গটি প্রাক-মুসলিম যুগে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। পরে এ দুর্গ থেকেই ঈসা খাঁ সোনারগাঁসহ ২২টি পরগনা দখল করেন। বাংলা ১৩২৬ সনের ভূমিকম্পে দুর্গটির বসতঘর, দরবার হলো ও মসজিদ ছাড়া প্রায় সব স্থাপনাই ধ্বংস হয়ে যায়। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা জানান, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এখানে খননকাজ শুরু করা হয়। দরবার হলের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে একটি ডোবার মতো ছিল। জনশ্রুতি আছে, শুকনো মৌসুমে এখানে ইটের দেয়াল দেখা যায়। মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে এখানে খননকাজ শুরু করা হয়। এ প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে বিবিধ সাংস্কৃতিককাল পর্বের ইটের দেয়াল পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন গর্তে সুলতানি, মোগল এবং আগে-পরেরও বেশ কিছু মৃৎপাত্রের ভাঙা অংশ পাওয়া যাচ্ছে। খননকাজটি হ্যারিস ম্যাট্রিক্স পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে বলে জানান তিনি। এখানে বর্তমানে ১৪ সদস্যের খননকারী দল কাজ করছে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজে বিশেষ অভিজ্ঞ এমন ৮-৯ জন শ্রমিককে উত্তরবঙ্গ থেকে আনা হয়েছে। কাজ করছেন স্থানীয় ৬-৭ জন শ্রমিকও। তিনি আরও জানান, খননকাজটি ধারাবাহিকভাবে কয়েক বছর ধরে চলবে। খননে প্রাপ্ত স্থাপত্য, ধ্বংসাবশেষ এবং প্রত্নবস্তু থেকে ঈসা খাঁ এবং তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়কালের যে সাংস্কৃতিক ইতিহাস, সাংস্কৃতিক চর্চা, জীবনযাত্রা এগুলো জানা ও বোঝার চেষ্টা করব। খনন থেকে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু দ্বারা দরবার হলে একটি প্রদর্শনী করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে এ অঞ্চলের দর্শনার্থী এবং বাইরে থেকে যারা আসেন তারা ঈসা খাঁর সময়কাল বা তার আগে এবং পরের যে সাংস্কৃতিক নিদর্শন আছে এগুলো দেখতে পাবেন।