সব রাজনৈতিক দলের সম্মতি নিয়ে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরই অংশ হিসেবে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক চলছে। বৈঠকের টেবিলে দলগুলোর পক্ষ থেকে বিকল্প নানা প্রস্তাব আসছে। পাশাপাশি সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে দলগুলো একাধিক বিকল্পের কথা বলছে।
উল্লেখযোগ্য যেসব বিষয়ে বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সেসবের মধ্যে রয়েছে- দেশের সাংবিধানিক নাম, সংসদ, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, রাষ্ট্রের মূলনীতি, বিচারপতি নিয়োগ, প্রার্থী হওয়ার বয়সসীমা, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন প্রক্রিয়া, নতুন দলের কার্যক্রম পরিচালনার ফর্মুলা ইত্যাদি। এসব বিকল্প প্রস্তাব সম্পর্কে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, ‘আমাদের দেওয়া সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের বাইরে অনেক রাজনৈতিক দল বিভিন্ন ইস্যুতে নানা ধরনের বিকল্প প্রস্তাব দিচ্ছে। এসব নিয়ে আমরা ভাবছি। পথ খুঁজছি।’
‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নাম পরিবর্তন করে ‘পিপলস ওয়েলফেয়ার স্টেট অব বাংলাদেশ’ বা ‘বাংলাদেশ জনকল্যাণ রাষ্ট্র’ নামকরণের প্রস্তাব দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সংবিধানের মূলনীতিতে বহুত্ববাদ রাখার সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ। দলটির বক্তব্য বহুত্ববাদ শব্দটি আল্লাহর একাত্মবাদের বিপরীত শব্দ। তবে এ শব্দটি বাদ দিয়ে দলটি বহুমত বা বহুপথ রাখার প্রস্তাব করেছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বহুত্ববাদের স্থলে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা’ পুনর্বহালের সুপারিশ করেছে। বহুত্ববাদের বদলে ‘ধর্মীয় সম্প্রীতি’ যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে গণঅধিকার পরিষদ। সংসদ, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ চার বছর করার সুপারিশ করেছে কমিশন। কিন্তু বেশ কয়েকটি দল মেয়াদ পাঁচ বছর রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কতবার হতে পারবেন এ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে রয়েছে নানা মত। একজন সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের এমন প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছে বিএনপি। দলটির প্রস্তাবে বলা আছে, দুবারের পর বিরতি দিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ আছে। আবার একজন সর্বোচ্চ তিনবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন বলে মত দিয়েছে আমজনতার দল। সে ক্ষেত্রে দুবারের পর অবশ্যই একবার বিরতি দিতে হবে। জাতীয় নাগরিক পার্টি তাদের প্রস্তাবে বলেছে, যিনি একবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তিনি পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার নয়, বরং মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার সেটার প্রস্তাবনা দিয়েছি।
এদিকে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) নিয়ে নানা ধরনের মত দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। কাউন্সিলের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়ে গণঅধিকার পরিষদ জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ রাখার কথা বলেছে। এনসিসি বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছে আমজনতার দল। ভবিষ্যতে যাতে বিতর্কিত কোনো ব্যক্তি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ না হতে পারেন সেজন্য আপিল বিভাগের সিনিয়র মোস্ট বিচারপতিদের মধ্যে কমপক্ষে দুই-তিনজনের মধ্য থেকে নিয়োগের পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি। সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে গণভোটের প্রস্তাব করেছে জাকের পার্টি। অন্যদিকে সংস্কার কার্যক্রমের আইনি বৈধতা নেওয়ার জন্য জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট চেয়েছে গণঅধিকার পরিষদ। সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের বিষয়ে দলটির নেতা নুরুল হক নুর বলেন, ভবিষ্যতে যেন কেউ সংস্কার কিংবা জাতীয় সনদকে আইনি বা কোনোভাবে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে, বাতিল করতে না পারে, সেজন্য আমরা বলেছি যে এর পক্ষে গণভোট নিয়ে চূড়ান্ত করতে। গণভোটের পর জাতীয় নির্বাচনের আশা করে দলটি। সংসদ সদস্য নির্বাচন করার ক্ষেত্রে কোনো দল ২১ আবার কোনো দল ২৩ বছর বয়স নির্ধারণের সুপারিশ করেছে। এসব প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই সনদ হবে আগামীর বাংলাদেশের পথরেখা। নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে জুলাই সনদের বড় ভূমিকা থাকবে। তিনি বলেন, আলোচনায় আমরা দুই দিকে বসলেও দুই পক্ষ নয়, আমরা সবাই এক পক্ষ। আমরা পথ খুঁজছি, যাতে করে আমাদের লক্ষ্যগুলো অর্জনের পথ সুনির্দিষ্ট করতে পারি। একত্রে অগ্রসর হতে পারি।
গত ২০ মার্চ থেকে শুরু হওয়া আলোচনায় এ পর্যন্ত ২১টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে কমিশনের সুপারিশগুলোর স্প্রেডশিট আকারে ৩৯টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ৩৫টি দল তাদের মতামত জমা দিয়েছে। ওই হিসাবে আরও অন্তত ১৩টি দলের সঙ্গে আলোচনায় বসবে কমিশন।