রবিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

বেড়েছে এসি ফ্রিজ টিভির চাহিদা

♦ ক্রমেই বড় হচ্ছে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বাজার ♦ বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোও দেশে কারখানা স্থাপন ও অ্যাসেম্বলিং করছে ♦ বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করছে দেশি শিল্প গ্রুপ

শাহেদ আলী ইরশাদ

বেড়েছে এসি ফ্রিজ টিভির চাহিদা

ঈদ সামনে রেখে ইলেকট্রনিক্স হোম অ্যাপ্লায়েন্সের চাহিদা বেড়েছে। ছবিটি ঢাকায় ইলেক্ট্রো মার্ট-এর শোরুম থেকে তুলেছেন আলোকচিত্রী আজহারুল ইসলাম

ইলেকট্রনিক্স পণ্য সহজ করে দিয়েছে মানুষের দৈনন্দিন জীবন। কয়েক মিনিটে তৈরি করা যায় তাজা ফলের রস। গ্যাস না থাকলেও রাইস কুকারে রান্না হচ্ছে ভাত। ইলেকট্রিক কেটলিতে পানি গরম করে চা-কফিও খেতে পারেন। এভাবেই নগরজীবনকে সহজ করে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ডমেস্টিক অ্যাপ্লায়েন্স বা গৃহস্থালি ইলেকট্রনিক পণ্য।

দেশে দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার্য ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বাজার ক্রমেই বড় হচ্ছে। গত অর্ধযুগে এসব পণ্যের বিক্রি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এর মধ্যে টেলিভিশন, ফ্রিজ ও এয়ারকন্ডিশনের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি। মহামারি করোনার অভিঘাত পেরিয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের সঙ্গে সংগতি রেখে দ্রুতই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার্য ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বাজার।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশের তথ্যানুসারে, বর্তমানে দেশে প্রতি বছর ১৫ লাখের মতো নতুন টেলিভিশন বিক্রি হয়। দেশে এখন বিক্রীত টেলিভিশনের মধ্যে অধিকাংশই এলইডি প্রযুক্তির। পাশাপাশি স্মার্ট টিভির চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশে মোট বিক্রি হওয়া ইলেকট্রনিক্স পণ্যের মধ্যে টেলিভিশনের বাজার প্রায় ৩০ শতাংশ বা ৪ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫ সাল নাগাদ দেশের টেলিভিশনের বাজার বেড়ে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও শহুরে মানুষের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার সঙ্গে কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স বাজারের প্রবৃদ্ধি নির্ভরশীল। বাজারে ওয়ালটন, স্যামসাং, সনি, এলজি, মিনিস্টার, সিঙ্গার, ভিশন, যমুনা, কনকা ইত্যাদি ব্র্যান্ডের টিভি জনপ্রিয়। টিভির বাজারের প্রায় ৭০ শতাংশ দেশি কোম্পানির দখলে। বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোও খরচ কমিয়ে বাজার ধরতে দেশে কারখানা স্থাপন করছে।

এ বিষয়ে ইলেক্ট্রো মার্টের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহম্মদ নুরুল আফছার বলেন, ঈদ এবং গরমের কারণে এয়ারকন্ডিশনার এবং ফ্রিজের চাহিদা বেড়েছে। বাজারের ৬০ শতাংশ অংশীদার গ্রি এয়ারকন্ডিশনারের। গত ২৫ বছর ধরে বিশ্বমানের পণ্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। আমাদের পণ্যে সব সময় আন্তর্জাতিক মানের এবং সার্টিফায়েড, ফুড গ্রেড যন্ত্রাংশ ব্যবহার করি। যে কারণে আমাদের পণ্য ভোক্তার কাছে বেশ জনপ্রিয়। এয়ারকন্ডিশনারের পাশাপাশি কনকা ফ্রিজ ও টেলিভিশন বেশ জনপ্রিয়। গত কয়েক মাস আগের তুলনায় এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকেই সব পণ্যের বিক্রি বেড়েছে।

রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ বর্তমান সময়ে প্রাত্যহিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। গ্রাহক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে বাজার বড় হচ্ছে দেশি রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ কোম্পানিগুলোর। বিভাগীয়, জেলা ও মফস্বল শহর ছাড়িয়ে এখন গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে ফ্রিজের বাজার। প্রতি বছর দেশে ৫০ লাখের বেশি ফ্রিজ বিক্রি হচ্ছে। টাকার অঙ্কে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। বাজারসংশ্লিষ্টদের ধারণা, আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশে ফ্রিজের বাজার সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। উদ্যোক্তাদের মতে, ২০১০ সালে বাংলাদেশে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর মার্কেট শেয়ার ছিল ৮০ শতাংশ। সেখানে ২০২৩ সালে চিত্রটা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এখন বাজারের মাত্র ২০ শতাংশ শেয়ার বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর দখলে। সাশ্রয়ী মূল্য, গুণগত মান, দেশের মানুষের চাহিদা ও আবহাওয়া উপযোগী হওয়ার কারণে গ্রাহক দেশি ব্র্যান্ডগুলোর ফ্রিজ কিনতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। শহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মফস্বল ও গ্রাম পর্যায়েও প্রতিনিয়ত ফ্রিজের ব্যবহার বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট সুত্র জানান, এক দশক আগেও দেশে এসির বাজার ছিল উচ্চবিত্ত-কেন্দ্রিক। পরিস্থিতি পাল্টেছে। দেশে এয়ারকন্ডিশনারের (এসি) চাহিদার সঙ্গে বাড়ছে উৎপাদনও। দাম মধ্যবিত্তের নাগালে আসায় বড় হচ্ছে এসির বাজার। অধিকাংশ কোম্পানির এয়ারকন্ডিশনার দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোও বাংলাদেশে এসি উৎপাদনের জন্য কারখানা স্থাপন করেছে। উৎপাদনকারী ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, বছরে ৫ থেকে ৬ লাখ (ইউনিট) এসি বিক্রি হয়। বাসাবাড়িতে ১ থেকে ২ টন ক্ষমতার এসির চাহিদা বেশি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ চাহিদা দেড় টন ক্ষমতার এসির। অন্যদিকে অফিস বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে অনেক বেশি ক্ষমতার এসি ব্যবহৃত হয়। বাজারসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এসির বার্ষিক বাজার প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। এসির বাজারের প্রবৃদ্ধি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। আগামী দুই থেকে তিন বছরে তা ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে বলে প্রত্যাশা। সারা দেশে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তির ইনভার্টার এসি বাজারে এসেছে। ফলে এসি ব্যবহার করা এখন সাধ্যের মধ্যে।

দেশে দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার্য ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বাজার ক্রমেই বড় হচ্ছে। গত অর্ধযুগে এসব পণ্যের বিক্রি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এসব পণ্যের মধ্যে টেলিভিশন, ফ্রিজ ও এয়ারকন্ডিশনের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি...

এ বিষয়ে র‌্যাংগ্স ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকরাম হোসেন বলেন, ইলেকট্রনিক্স সেক্টর বাংলাদেশের দ্রুতবর্ধনশীল একটি ক্ষেত্র। পরিসংখ্যানগতভাবে সারা দেশে ইলেকট্রনিক্স সম্পর্কিত ব্যবসায়গুলোতে নিযুক্ত ব্যক্তিদের সমন্বয় করে ৩ হাজারের বেশি ব্যবসায় চালু রয়েছে এবং প্রতি বছর এ খাতটি ১৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে যা ১ কোটির বেশি লোকের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স বাজারের প্রায় ৬৫ শতাংশ অংশীদার দেশি ব্র্যান্ডের কোম্পানিগুলো। যেখানে টেলিভিশন শিল্প প্রায় ৪২% অংশীদার। একসময় আমদানির ওপর নির্ভরশীল হলেও বর্তমানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হচ্ছে এমন টেলিভিশন ব্র্যান্ডগুলো ধীরে ধীরে স্থানীয় বাজারের বড় অংশ অর্জন করছে। বর্তমানে দেশি ব্র্যান্ড সময়োপযোগী ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের কারণে বাজারে ক্রেতার কাছে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এলইডি টেলিভিশনের বিভিন্ন সংস্করণ যেমন ফোরকে, স্মার্ট, অ্যান্ড্রয়েড, গুগল টিভি, ভয়েস কন্ট্রোল টিভি ইত্যাদি এখন বাজারের প্রধান ব্র্যান্ডগুলোর দ্বারা উৎপাদিত এবং সংযোজিত হয়। তাই আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পাশাপাশি স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো ধীরে ধীরে বাজারের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে নিচ্ছে। বাজার প্রতিযোগিতামূলক থাকায় প্রাতিষ্ঠানিক ক্রেতারা দেশি ব্র্যান্ডের প্রতি ঝুঁকছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ দ্রুতবর্ধনশীল ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতির বাজার গত এক দশকে প্রায় তিন গুণ বেড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। সুবিশাল বাজার তৈরির পাশাপাশি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বাজার গবেষকদের মতে, ডিজিটাল বাংলাদেশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এর সহযোগী শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন উৎপাদন কর এবং শুল্কের সরকারি নীতি থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য দেশি এবং বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর দ্বারা তাদের উৎপাদন ধীরে ধীরে স্থানীয়করণের মাধ্যমে আরও বিনিয়োগ বাড়াবে। ফলে এই অভ্যন্তরীণ বাজার বাড়ানোর পাশাপাশি রপ্তানির উদ্দেশ্য ও উৎপাদকদের বিনিয়োগ বাড়বে। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে টেলিভিশন, ফ্রিজ, এসি, ওয়াশিং মেশিন এবং অন্যান্য হোম অ্যাপ্লায়েন্সের বাজার ২০২৫ সালের মধ্যে বার্ষিক ১০ বিলিয়ন ডলারে পরিণত হবে। বোস্টন কনসালটিং গ্রুপের (বিসিজি) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ, যা ২০২৫ সালে গিয়ে ৩ কোটি ৪০ লাখে দাঁড়াবে। প্রতি বছর এ শ্রেণিতে গড়ে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ যোগ হচ্ছে, যা ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের চেয়ে বেশি। মূলত এ সম্ভাবনার বিষয়টি বিবেচনা করেই স্থানীয় বড় ব্যবসায়িক গ্রুপগুলো ইলেকট্রনিক্স খাতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছে। পাশাপাশি বাজার ধরে রাখতে বেশ কিছু বিদেশি ব্র্যান্ডও বাংলাদেশে তাদের কারখানা স্থাপন করেছে। কভিডের পর কনজিউমার ডিউরেবলসের প্রবৃদ্ধি কিছুটা থমকে গেলেও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে গতি ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে এ খাতেও প্রবৃদ্ধি বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সর্বশেষ খবর