বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

‘টেস্টে ভালো করতে না পারলে ওয়ানডেতেও দুর্বল হয়ে যাব’

মেজবাহ্-উল-হক

‘টেস্টে ভালো করতে না পারলে ওয়ানডেতেও দুর্বল হয়ে যাব’

পোশাকের মতোই ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ রঙিন-জ্বলজ্বলে, টেস্টে বড্ড সাদা-কালো, ফ্যাকাসে! ওয়েস্ট ইন্ডিজে সাকিব আল হাসানদের ভরাডুবি চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল আমরা ক্রিকেটের ‘রাজকীয়’ এই ফরম্যাটে কতটা শ্রীহীন। কতটা বর্ণহীন। কতটা দুর্বল।

না বোলিং, না ফিল্ডিং, না ব্যাটিং -কোনো বিভাগেই আশার আলো দেখা যায়নি। দুই টেস্টের একটিতে হার ৭ উইকেটে, আরেকটিতে ১০ উইকেটে। লড়াই তো দূরের কথা, দুই ম্যাচেই হেসেখেলে জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

বাংলাদেশ দলের সমস্যা কোথায়? টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ২২ বছর পরও কেন আমরা লড়াই করতে পারছি না। উইন্ডিজের মতো মধ্যসারির দলের বিরুদ্ধে চোখ চোখ রেখে লড়াই করতে পারছি না! অধিনায়ক সাকিব আল হাসান বলেছেন, আমাদের এখানে টেস্ট সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। একই সুরে কথা বলেছেন, কোচ রাসেল ডমিঙ্গোও।

স্বয়ং বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বলেছেন, টেস্ট সংস্কৃতি গড়ে উঠতে সময় লাগবে! কারণ, ভারতের মতো দলের প্রথম টেস্ট জিততেও নাকি ২৬ বছর লেগেছিল!

আসলে এই টেস্ট সংস্কৃতিটা আসলে কি? এটা তৈরি হতে কত দিনইবা লাগবে?

ক্রিকেট বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) ক্রিকেট উপদেষ্টা নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলেন, ‘বল কিভাবে ছাড়তে হবে? কখন ডিফেন্স করতে হবে? কিভাবে লম্বা সময় ব্যাটিং করতে হবে? কিভাবে বড় ইনিংস খেলতে হবে? কিভাবে পার্টনারশিপকে বড় করতে হবে? কিভাবের ঘণ্টার পর ঘণ্টা উইকেট থাকার পরও মনোসংযোগ নষ্ট হবে না -এসব কিছু ঘরোয়া ক্রিকেটেই শিখতে হবে। এটাই হচ্ছে সংস্কৃতি। আরও অনেক বিষয়ই আছে। এই সংস্কৃতিটা আমাদের এখানে নেই। এখানে ঘরোয়া ক্রিকেটে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। দল নিয়ে কারও ইমোশন নেই। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দল নিয়ে মালিকানা থাকার কারণে কেউ দলকে ‘ওন’ করতে পারছেন না। আর এই প্রভাবটাই পড়ছে পরবর্তীতে জাতীয় দলে। কারণ এখন যারা, ঘরোয়া লিগে খেলছেন তারাই তো এক সময় জাতীয় দলে খেলবেন বা খেলছে।’

সাকিব আল হাসান বলেছেন, টেস্ট সংস্কৃতি গড়তে অন্তত এক দেড় বছর লাগতে পারে! এ ব্যাপারে ফাহিমের ভাষ্য, ‘এটা ১ বছরও লাগতে পারে। আবার ১০ বছরে নাও হতে পারে। এটা নির্ভর করছে আমাদের অ্যাপ্রোচের ওপর। আমরা কিভাবে পরিকল্পনা করছি তার ওপর। কিভাবে ক্রিকেটারদের প্রস্তুত করছি তার ওপর। আমরা প্রস্তুতির সময় চিন্তা করি, ডট বল দেওয়া যাবে না। ব্যাটসম্যানরা কেবল ওয়ানডে জন্যই প্রস্তুত হয়। টেস্টের চিন্তা দেখি না। আবার, আমাদের কোনো স্পিনার যদি ফ্লাইড দেয় সেই বলটা যদি মার খায় আমরা তাকে বলি এভাবে ফ্লাইড দেওয়ার দরকার নেই। যাতে না মারতে পারে। কিন্তু ফ্লাইড দিয়ে যেটা হয়, একটা বলে ছক্কা হতে পারে, আবার ব্যাটসম্যান মিস করলে আউটও হতে পারে। আমরা এভাবে কোনো স্পিনারকে এনকারেজ করছি না। এখন যে বলা হচ্ছে লেগ-স্পিনার নাই, কিন্তু কেন নাই? লেগ-স্পিন বোলিংয়ের সংস্কৃতি নেই। আমি দুই একটি ছক্কা হজম করার পর উইকেট নেব, এই পরিবেশটা নাই। বিশ্বসেরা লেগ-স্পিনার শেন ওয়ার্ন তার প্রথম টেস্টে ১৫০ রান দিয়েছিল। তাই আগে লম্বা ভার্সনের সংস্কৃতিটা গড়ে ওঠা জরুরি।’

টেস্ট ক্রিকেট সংস্কৃতি গড়ে না উঠলেও বোর্ড সভাপতি বলেছিলেন, আমাদের টেস্ট ক্রিকেট ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। কিন্তু ফাহিমের মত ঠিক উল্টো। তিনি মনে করেন, ওয়ানডে ক্রিকেট যে এগিয়েছে এ নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট আরও পিছিয়েছে। ফাহিম বলেন, ‘২০-২২ বছর আগে দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট নিয়ে আমাদের ক্রিকেটারদের মধ্যে কিংবা ফ্যানদের মধ্যে যে ধারণা ছিল আমরা সেখান থেকে অনেক পিছিয়ে গেছি। ২০ বছর আগের একজন ক্রিকেটার বা ফ্যান যেভাবে টেস্টকে ব্যাখ্যা করতে পারবে, আজকের নতুন ক্রিকেটার বা ফ্যান সেভাবে টেস্টকে ব্যাখ্যা করতে পারবে না। তখন আমাদের টেস্টের মানসিকতা ছিল। প্রথম টেস্টে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ১৪৫ রানের ইনিংসটি। সেটি কিন্তু সম্পূর্ণ টেস্টের আমেজে করা এক সেঞ্চুরি ছিল। কিন্তু এখন কি দেখছেন।’

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টেস্ট দুটিতে দেখা গেছে, ব্যাটসম্যানরা ঠিকঠাক ডিফেন্স করতে পারছেন না। যে বল ছাড়ার কথা সেটি বাউন্ডারি হাঁকানোর চেষ্টা করছেন। বোলাররা একই লাইনলেন্থে বোলিং করতে পারছেন না। একের পর এক ক্যাচ মিস হচ্ছে। এর পেছনে বড় কারণ হচ্ছে, ক্রিকেটারদের মধ্যে টেস্টের  মেজাজ নেই। ফাহিম বলেন, ‘কাউকে ভালো ক্রিকেটার হতে হলে কিংবা ভালো ক্রিকেট খেলতে হলে লম্বা ফরম্যাটে ভালো করা জরুরি। ক্রিকেটের অনেকগুলো মৌলিক বিষয় আছে। লম্বা ফরম্যাটে যে যত চ্যালেঞ্জ ফেস করবে সেটা টেস্টে তো কাজে লাগবেই ওয়ানডে কিংবা টি-২০তেও দারুণ কাজে লাগবে। লম্বা ভার্সনে একজন ক্রিকেটারকে অনেক বেশি চাপের মধ্যে থাকতে হয়। আর চাপের মধ্যে যখন কোনো ক্রিকেটার নিজেকে মেলে ধরতে পারে, তার নিজের প্রতি আস্থা তত বাড়ে। আত্মবিশ্বাস বাড়ে। সেটা অন্য ফরম্যাটেও কাজ দেয়।’

সংগঠকদের পরিকল্পনা, ক্রিকেটারদের ভাবনা এমনকি ফ্যানদের ভাবনাও কেবল শর্টার ভার্সন ক্রিকেটকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। কোনো ক্রিকেটার বেশি বল হজম করলে ফ্যানরা তার প্রতি বিরক্ত হচ্ছেন। এমন আরও অনেক ঘটনা আছে।

ফাহিম মনে করেন, রাজকীয় ফরম্যাট টেস্টের প্রতি বাড়তি নজর না দিলে এক সময় সেই প্রভাবটা ওয়ানডেতেও পড়তে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা টেস্টে দুর্বল, আরও দুর্বল হয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। এভাবে চলতে থাকলে ওয়ানডেতেও দুর্বল হয়ে যাব। অন্যান্য দেশের দিকে তাকান, তারা টেস্ট ক্রিকেটকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। টেস্টে তারা ভালো করছে। তারা কিন্তু ওয়ানডেতেও অনেক এগিয়ে যাবে। আর আমরা টেস্টকে গুরুত্ব কম দেওয়ার কারণে ওয়ানডেতেও এক সময় খারাপ করতে পারি।’

আশার কথা হচ্ছে, টেস্টে বাংলাদেশের দুর্বলতার বিষয়টি খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। কোচ রাসেল ডমিঙ্গোও সমস্যার কথা সরাসরি বলেছেন। বোর্ড কর্তারাও বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন। বিশ্লেষকরা অভিজ্ঞতা থেকে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছেন।

ফাহিম বলেন, ‘এখন থেকে তিন বা পাঁচ বছর পর যারা জাতীয় দলে খেলবেন তাদেরকে নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা করতে হবে। বাংলাদেশ দল এখন টেস্টে যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে সে একই রকম আবহ ঘরোয়া লিগেও তৈরি করতে হবে। ঘরোয়া লিগে এই আবহ তৈরি করতে পারলে টেস্টে আমাদের আর সমস্যা হবে না।’

সবার প্রত্যাশা একটাই, দ্রুত টেস্ট সংস্কৃতি গড়ে উঠুক এবং ওয়ানডের মতো টেস্টেও শক্তিশালী দল হয়ে উঠুক বাংলাদেশ। ক্রিকেটে রাজত্ব করতে হলে রাজকীয় ফরম্যাট টেস্টে যে ‘রাজা’ হতে হবে।

সর্বশেষ খবর