মাঠের পূর্ব পাশে ফুটবল খেলছেন ধোনি, কোহলি, রায়নারা। দেখে মনে হচ্ছে কোপা আমেরিকা কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা নেওয়ার আগে শেষবারের মতো নিজেদের প্রস্তুত করে নিচ্ছেন! ধোনি-কোহলিরা যখন সিরিয়াস ফুটবল খেলায় ব্যস্ত, তখন গ্যালারিতে একা দাঁড়িয়ে পতাকা নাড়িয়ে যাচ্ছেন সুধীর গৌতম। ব্রাহ্মণদের মতো মাথার পেছনে টিকি এবং পুরো শরীর ভারতীয় পতাকায় পেইন্টেড সুধীরের। দুই ম্যাচ হেরে বিধ্বস্ত ভারতীয় ক্রিকেট দলের একমাত্র ভরসা এখন তিনিই! সুধীরের আÍবিশ্বাসেই যেন শেষ ওয়ানডের কঠিন হার্ডল ডিঙাতে চাইছে ধোনিবাহিনী!
মাঠের পশ্চিম পাশে একই সময় ভাঙা আঙুলে ব্যান্ডেজ বেঁধে স্প্রিন্ট টানছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। ৪-৫টি করে শর্ট স্প্রিন্ট টানছেন একটানা। এরপর দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। দেশসেরা ব্যাটসম্যান, অথচ খেলছেন না চলতি সিরিজে। কিন্তু বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোয়ার্টার ফাইনালে তার ক্যাচ নিয়েই শুরু দুই দলের বৈরিতা। মাহামুদুল্লাহ খেলছেন না, কিন্তু দলের সঙ্গে আছেন অশরীরিভাবে। স্প্রিন্ট টানার ফাঁকে ম্যাচের ফল কি হতে পারে, জানতে চাওয়া মাত্র বৃদ্ধাঙুলি উঁচিয়ে দেখিয়ে দিলেন ‘গুড সাইন’। যার দুটি অর্থ হতে পারে। প্রথমত, শারীরিক অবস্থা এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো এবং দ্বিতীয়ত, আগের দুটির মতো টাইগাররা তৃতীয়টিও জিতবে সহজে। প্রথম দুই ম্যাচে টাইগাররা জয় পেয়েছে তাতে বাংলাধোলাই এখন অপেক্ষা বলা যায়। পাকিস্তানের পর ভারতকে বাংলা ধোলাই করলে বাংলাদেশের ক্রিকেট আরও উঁচুতে উঠে যাবে। দেশবাসীর প্রত্যাশা টাইগাররা আজও জয়ের আনন্দে ভাসবে। ভোরের আলো যখন আজ দিগন্ত রাঙাবে, তখনই প্রস্তুতি নিতে শুরু করবে দুই দল শেষ ওয়ানডের। দুই দলের ক্রিকেটাররা পরিকল্পনা মনে গেঁথে নিতে থাকবেন ময়দানি লড়াইয়ে জেতার। প্রথম দুই ওয়ানডেতে তরুণ মুস্তাফিজের কাটারে যেভাবে নাকাল হয়েছে বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপের ভারত, আজ কোহলিদের আবারও যমদূত হয়েই দেখা দিতে পারেন বাঁ হাতি এই তরুণ! যমদূতের মরণকাটারে বাংলাওয়াশের হাত থেকে বাঁচতে আজ শতভাগ নিংড়ে মাঠে নামবেন ধোনিরা। কোনো সন্দেহ নেই। কাল মেঘলা আবহাওয়ায় কঠোর পরিশ্রমই তার ইঙ্গিত। নিকট অতীতে এতটা সিরিয়াস অনুশীলন দেখা যায়নি ধোনিদের। ভারত এখন যতটা চাপে, ঠিক ততটাই নির্ভার বাংলাদেশ। প্রথমবার সিরিজ জিতে চাপমুক্ত মাশরাফিরা উড়ছেন প্রজাপতির ডানায় চড়ে। উৎসব, উচ্ছ্বাস, সবই করছেন। না বললেও ছোট্ট একটা চাপ কিন্তু থাকছেই। টানা দুই জয়ে সিরিজ নিশ্চিতের পর বাংলাওয়াশের সূক্ষ্ম একটি চাপ থাকছে। এমন সুবর্ণ সুযোগ আবার কবে আসবে, বলতে পারছে না কেউ। তাই সুযোগ হেলায় হারাতে চাচ্ছে না কেউ। সময়ের কাজ সময়ে করা ভালো ভাবনায় মাথার উপর বাড়তি চাপ কাজ করছে।
তবে এই চাপের কথা মানছেন না অধিনায়ক মাশরাফির সেরা অফ স্পিনার নাসির হোসেন, ‘আমরা বাংলাওয়াশের কথা মাথায় রেখে খেলব না। আমরা মাঠে নামব জয়ের জন্য। জেতার জন্যই খেলব। তবে বাংলা ধোলাই করতে পারলে অবশ্য ভালো লাগবে।’ বাংলাদেশ নামবে বাংলাওয়াশের টার্গেটে। ভারত খেলবে মান বাঁচাতে, লজ্জা এড়াতে।
ম্যাচের আগে বাংলা ধোলাই এড়ানোই টার্গেট বলেন রবীচন্দ্রন অশ্বিন, ‘বাংলাদেশ খুব ভালো ক্রিকেট খেলছে। তারা ভালো ক্রিকেট খেলেই সিরিজ জিতেছে। আমরা শেষ ম্যাচ জিততে চাই। জেতার জন্য সর্বোচ্চটাই দিয়ে খেলব।’ বিশ্বকাপ ক্রিকেট থেকে শুরু দুই দলের বৈরিতা! এই বৈরিতা এতটাই তীব্র, যে মাঠের বাইরের বিষয়গুলোও চলে এসেছে আলোচনায়। দ্বিতীয় ম্যাচ জেতার পর একদল ক্রিকেটপ্রেমী ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থক সুধীরকে লক্ষ্য করে কিছু একটা বলেন। সেটাকে গত দুদিন ভারতীয় মিডিয়া এতটাই ফলাও করে প্রচার করছিল যে, মনে হচ্ছিল ক্রিকেট এখানে মুখ্য নয়। গৌণ একটা বিষয়। সুধীরকে নিয়ে তাদের যে প্রচারণা, সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে দিনশেষে।
বিশ্বকাপের আগে ভারতীয় বিজ্ঞাপনের জবাব দ্বিতীয় ওয়ানডে জিতে দিয়েছে মিরপুরের ক্রিকেটপ্রেমীরা ‘মওকা’, ‘মওকা’ বলে। দুই দলের ক্রিকেট লড়াই এখন ছড়িয়ে পড়েছে মাঠের বাইরে। সিরিজ শুরুর আগে অতি বড় ক্রিকেটপ্রেমীও সাহস করেননি, বাংলাদেশকে ফেবারিট বলতে। মাশরাফিরাও ফেবারিট দাবি করেননি নিজেদের। অথচ সিরিজ শুরুর পর প্রতিবেশী দেশকে ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং-তিন বিভাগকেই দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে। ভারতীয়দের ক্রিকেট আভিজাত্যকে একাই ধসিয়ে দিয়েছেন ১৯ বছরের তরুণ মুস্তাফিজুর রহমান। প্রথম ম্যাচে কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ৫ উইকেট নেন। তার বোলিং জাদুতে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোয়ার্টার ফাইনালের প্রতিশোধ নেন মাশরাফিরা। পরের ম্যাচে ‘লাগ ভেল্কি লাগ’ বলে মুস্তাফিজ ভেঙেচুড়ে দিয়েছেন ধোনি, কোহলিদের সব দর্পগুঁড়িয়ে নিয়েছেন ৬ উইকেট। দেশকে প্রথমবারের মতো উপহার দিয়েছেন সিরিজ।
নিকট অতীতে কোনো ক্রিকেটারকে সিরিজে এতটা প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায়নি। যতটা করেছেন মুস্তাফিজ। ভারত এখন যতটা না বাংলাদেশ ভয়ে ভীতু, তারচেয়ে বেশি কাবু মুস্তাফিজ জুজুতে। মুস্তাফিজও তার ‘স্টক বল’ কাটারে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের নিয়ে এমন ছেলেখেলায় মেতেছেন যে, ধোনিবাহিনী দিন পার করছে তার রহস্য উন্মোচনে। দুই দল যখন প্রস্তুত তৃতীয় ওয়ানডে লড়াইয়ের। তখন ক্রিকেট বোর্ডের একটি মেসেজ জন্ম দেয় বিস্ময়ের। সিরিজে না থাকার পরও তৃতীয় ওয়ানডেতে নেওয়া হয়েছে জুবায়ের হোসেনকে। লেগ স্পিনার জুবায়ের এখন পর্যন্ত ওয়ানডে খেলেছেন দুটি। তারপরও তার উপর আস্থা রেখে দলে নিয়েছেন কোচ চন্ডিকা হাতুরাসিংহে। জুবায়েরকে নেওয়ার পেছনে হয়তো কারণ রয়েছে। বিশ্রাম দেওয়া হতে পারে অধিনায়ক মাশরাফিকে। ২৯ বছরে ১৭ নম্বর ওয়ানডে সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ। ভারতকে সিরিজ হারালো প্রথম। আজ জিতলে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশের তেতো স্বাদ দেবে ভারতকে। এখন পর্যন্ত ১০ বার প্রতিপক্ষকে বাংলা ধোলাই করেছে টাইগাররা। সংখ্যা বাড়াতে আজ জিততেই হবে মাশরাফিদের।
বিডি-প্রতিদিন/২৪ জুন, ২০১৫/মাহবুব