দেড় দশক আগের কথা। গল ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে দুরন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে লঙ্কানরা এক তরুণকে মাঠে নামিয়ে দেয়। প্রোটিয়ারা তখন শন পোলকের নেতৃত্বে এক দুর্দান্ত দল। সেই দলে জ্যাক ক্যালিস, ল্যান্স ক্লজনার, গ্যারি কার্স্টেন, মার্ক বাউচার আর জন্টি রোডসদের মতো কিংবদন্তিরা ছিলেন। এমন এক দলের বিপক্ষে অনভিজ্ঞ তরুণ কুমার সাঙ্গাকারা একটু বেশিই বেমানান ঠেকেছিল। তার উপর ব্যাট হাতে দেখা গেল টেস্ট ক্রিকেটে এ সত্যিই এক বালক মাত্র। তবে লঙ্কানরা তখন রমেশ কালুভিথারানার বিকল্প খুঁজে বেড়াচ্ছিল দেশময়। পরবর্তী প্রজন্মে কালুভিথারানার দায়িত্ব পালন করবেন কে? প্রসন্নকে দিয়ে কাজ চালানো গেলেও দীর্ঘ মেয়াদে তাকে উইকেটের পিছনে রাখাটা ঝুঁকিপূর্ণই হয়ে যাচ্ছিল। সেই মুহূর্তেই লঙ্কান ক্রিকেট আকাশে উদয় কুমার সাঙ্গাকারার। ২০০০ সালের জুলাইয়ে গল ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষেক। ক্যারিয়ারের প্রথম ইনিংসে ২৩ রান করে ব্যর্থ মনোরথে মাথা নিচু করে ফিরছিলেন প্যাভিলিয়নে। ১৫ বছর পর দীর্ঘ ক্যারিয়ারের শেষ বিন্দুটা গল স্টেডিয়ামের উইকেটে রেখে আসার সময় কুমার সাঙ্গাকারার সেই মাথা এতটাই উঁচুতে যেখানে কেবল একজন কিংবদন্তির পক্ষেই পৌঁছা সম্ভব।
গল টেস্ট জয়ের জন্য ভারতের সামনে প্রধান বাধা ছিলেন কুমার সাঙ্গাকারা। এই বাধা দূর করার জন্য একের পর এক বোলিং তোপ দাগাচ্ছিলেন অশ্বিনরা। সফলতা পেতে খুব বেশি দেরি করতে হয়নি। লঙ্কানদের দ্বিতীয় ইনিংসের নবম ওভারেই কুমার সাঙ্গাকারা অশ্বিনের বলে স্লিপে ক্যাচ দেন বিজয়কে। সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় দীর্ঘ পনের বছরের টেস্ট ক্যারিয়ার। শেষ হয়ে যায় ক্রিকেটে একজন কিংবদন্তির পথচলা। স্ত্রী ইয়েহেলি মুখ ঢেকে ফেলেন। ভারত প্রথমদিকে উইকেট শিকারের স্বাভাবিক উৎসব করলেও একজন কিংবদন্তিকে বিদায় দিতে দ্রুতই ছুটে আসে। সবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে সাঙ্গাকারা যখন বাউন্ডারি লাইনের দিকে হাঁটতে শুরু করেন সতীর্থরা ব্যাট উঁচিয়ে তৈরি করেন গেটওয়ে। ক্রিকেট মাঠের বাউন্ডারিতে প্রবেশের সময় কী অপরিচিতই না ছিলেন সাঙ্গাকারা। আর ক্যারিয়ারের শেষ মুহূর্তে তিনি একজন ক্রিকেট বীর। যার ব্যাট থেকে ফুল হয়ে ঝরেছে ১৩৩ টেস্ট ম্যাচে ১২৩৫০ ও ৪০৪ ওয়ানডে ম্যাচে ১৪২৩৪ রান। ক্রিকেটের দুই ফরম্যাটে মোট ৬৩টা সেঞ্চুরি করেছেন। শচীন টেন্ডুলকারের পর বুঝি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কুমার সাঙ্গাকারার নামই উচ্চারণ করবে। তবে ক্যারিয়ারের শুরুটা যেমন ইনিংস ব্যবধানের জয় দিয়ে করেছিলেন শেষটা তেমন হলো না। গল টেস্টের শেষদিনে জয়ের জন্য লঙ্কানদের প্রায় অসম্ভব একটা লক্ষ্য স্পর্শ করতে হবে (আরও ৩৪১ রান!)। সেই তুলনায় বরং সুবিধাজনক স্থানে আছে ভারত। আর আটটা উইকেট শিকার করলেই কাঙ্ক্ষিত জয়ের দেখা মিলবে তাদের। সাঙ্গাকারা কী তবে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারটা পরাজয় নিয়েই শেষ করতে চলেছেন!
সাঙ্গাকারা এমন এক নাম, যার জন্য জয়-পরাজয়টাই আসলে গৌণ হয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কা হারল কি জিতল, এরচেয়েও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তার বিদায়। গ্যালারির দর্শকরা 'কিংবদন্তিরা বেঁচে থাকে' আর 'সাঙ্গাকারা আমরা তোমাকে ভুলব না' স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে হাজির ছিল গল ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে। অথচ লঙ্কানরা টেস্ট ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে! গ্যালারির দর্শকদের মতো ক্রিকেটের সাবেক ও বর্তমান রথী-মহারথীরা সাঙ্গাকারার বিদায়কে এক নক্ষত্রের বিদায় বলেই অভিহিত করেছেন। আর কুমার সাঙ্গাকারা নিজের প্রতি এত ভালোবাসা দেখে টুইটারে লিখেছেন, 'আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আমার সৌভাগ্য যে আমি দেশের জন্য খেলতে পেরেছি অসংখ্য দর্শকদের সামনে।'
কুমার সাঙ্গাকারা ক্রিকেট জীবন শেষ করে চলে যাচ্ছেন পুরোপুরি ঘরোয়া জীবনে। যেখানে তার জন্য অপেক্ষায় আছে স্ত্রী ইয়েহেলি আর জমজ সন্তান সুইরি-ক্যাভিথ। স্ত্রী-সন্তান আর সামাজিক কাজ নিয়েই আপাতত ব্যস্ত থাকবেন সাঙ্গাকারা। শ্রীলঙ্কায় তিনি এইচআইভি এইডস নিয়ে জনসচেতনতামূলক কাজের সঙ্গে জড়িত। এছাড়াও বেশ কয়েকটা সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন এ লঙ্কান গ্রেট।