শচীন টেন্ডুলকার তো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরেছেন। নিজের হাতে কেউ কি শচীনের পাতে ইলিশ তুলে দিয়েছিলেন ? হ্যাঁ দিয়েছেন।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল অনেকটা ধূমকেতুর মতো। ২০০১-এ প্রথম চালু হয়েছিল এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। বাংলাদেশ তখন খেলছিল পাকিস্তানের মাটিতে। করাচিতে বছর সতেরোর মোহাম্মদ আশরাফুলকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা। তিনি তখন ওয়াসিম আকরাম, ইনজামাম-উল-হকদের অটোগ্রাফ নিতে ব্যস্ত ছিলেন।
করাচির পর কলম্বো। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে আশরাফুলকে নামিয়ে দেওয়া হল সিংহলিজ স্পোর্টস গ্রাউন্ডে। সবাইকে বিস্ময় উপহার দিয়ে তিনি টেস্ট ক্রিকেটে সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে সেঞ্চুরি করে ফেললেন। ক্রিকেটবিশ্বকে জানান দিলেন, ‘আমি এসে গিয়েছি।’ বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে আশরাফুলের নাম তখন ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ক্রিকেট বিশ্বে। শুরুটা দুরন্ত হলেও মাঝে ছন্দ কেটে যায়। প্রত্যাশার চাপ সামলাতে পারেননি আশরাফুল। দল থেকে একসময়ে বাদ পড়তে হয়। বাদ পড়লেও হার মানেননি আশরাফুল। দাঁতে দাঁত চেপে শপথ নিয়েছিলেন, ফিরে আসতেই হবে। যেমন ভাবনা, তেমনই কাজ। আবার দলে প্রত্যাবর্তন ঘটে আশরাফুলের। বাংলাদেশের নেতৃত্বের আর্মব্যান্ড ওঠে তাঁর হাতে। এখানেও বিধি তাঁর বাম। দলকে ভালো কিছু উপহার দিতে পারেননি।
২০১৩ সালে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) ম্যাচ ফিক্সিংয়ের কালির ছিটে এসে লাগল আশরাফুলের গায়ে। নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল তাঁকে। শুরুটা যাঁর ছিল এমন চোখধাঁধানো, তাঁকেই দেখতে হল অন্ধকার! আশরাফুলের জীবনে আলো-অন্ধকার হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে। কখনও মেঘ তাঁর জীবনে। কখনও আবার রোদ।
আশরাফুলের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা এখন উঠে গিয়েছে। জাতীয় ক্রিকেট লিগের পর ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে খেলছেন তিনি। আশরাফুল জানান, ‘১২ তারিখ থেকে ঢাকা লিগ শুরু হয়েছে। আমি কলাবাগানের হয়ে খেলছি। মাস তিনেক আগে জাতীয় লিগেও খেলেছি। এখন এই লিগটাকেই ফোকাস করছি।’
আশরাফুল এখন তেত্রিশের কাছাকাছি। বাংলাদেশে বত্রিশ-তেত্রিশের পর ক্রিকেটাররা চলে যান বাতিলের খাতায়। যদিও বিশ্বসেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্বরা বয়সকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন। বলছেন, ‘বয়স কেবলমাত্র একটা সংখ্যা।’ আশরাফুল অবশ্য বয়স বা জাতীয় দলের কথা চিন্তা না করে নিজের খেলাটা খেলে যেতে চান। বলছেন, ‘এখন জাতীয় দল নিয়ে কোনও চিন্তাভাবনাই করছি না। জাতীয় দলে ফেরার স্বপ্ন দেখি। এখনই তো আর সেটা হবে না। যেখানে সুযোগ পাই, সেখানেই পারফর্ম করতে চাই।’
সব ঠিকঠাক থাকলে আশরাফুলকে এখন জাতীয় দলেই দেখা যেত। তার পরিবর্তে আকাশ থেকে খসে পড়া তারা হয়ে রয়ে গিয়েছেন আশরাফুল। সেই দুঃসহ স্মৃতি আর মনে রাখতে চান না আশরাফুল। এক বুক যন্ত্রণা ঢেকে শুধু বললেন, ‘এরজন্য আমি পুরো জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছি। এখন আর ওটা নিয়ে চিন্তা করি না। যা হয়েছে, তার জন্য আমি তো চার বছর ধরে খেলার জগতের বাইরে। পুরনো ঘটনা মনে পড়লে খারাপই লাগে। সব ঠিকঠাক থাকলে এখনও হয়তো খেলা চালিয়ে যেতাম।’ দুঃসহ যন্ত্রণার কথা বলতে গিয়ে মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে পড়ছিলেন আশরাফুল। হয়তো স্মৃতিতে উঁকি দিচ্ছিল ২০০৫-এর কার্ডিফ বা ২০০৭-এর বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা দুই ক্রিকেটশক্তিকে বধ করতে আশরাফুলই যে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাংলাদেশকে।
ভারতে এখন আইপিএল-এর ভরা মরসুম। আইপিএল প্রসঙ্গ উঠতেই মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আশরাফুলের। কথা কেড়ে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলতে থাকেন, ‘মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স-এর হয়ে খেলা আমার জীবনের সেরা পাওয়া। আমার রোল মডেল শচীন টেন্ডুলকার। টেন্ডুলকারের সঙ্গে একই ড্রেসিংরুমে ৪৫ দিন ছিলাম। এটা আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।’
বাংলাদেশের প্রাক্তন অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুলও পছন্দের ক্রিকেটার আশরাফুলের। ২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল আইপিএল। সে বার একটা ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন আশরাফুল। সেই ম্যাচে ব্যাট হাতে যখন নেমেছিলেন আশরাফুল, তখন ক্রিজে ছিলেন ‘মাস্টার ব্লাস্টার’। সেই স্মৃতি এখনও আশরাফুলের মনে জীবন্ত। এক নিঃশ্বাসে তিনি বলে চলেন, ‘ওই ম্যাচের কথা আমার মনে আছে। রান করতে পারিনি। ২ রান করেছিলাম। আমি যখন উইকেটে যাই টেন্ডুলকার স্ট্রাইকে ছিল।’
আইপিএল-এর পর বাংলাদেশ সফরে আসে ভারত। ওয়ানডে দলে ছিলেন না টেন্ডুলকার। পরে টেস্ট দলে যোগ দেন ‘মাস্টার ব্লাস্টার’। হরভজন সিংহ এক দিন মজার ছলে আশরাফুলের কাছে আবদার করে বসেন,‘তোমার বাড়িতে নিয়ে যাবে না?’ আশরাফুল সেই প্রসঙ্গে বলতে থাকেন, ‘আমার কাছে ওটা অন্যরকম একটা মুহূর্ত ছিল। টেন্ডুলকার আমার বাড়িতে এসেছিল।’
টেন্ডুলকার-হরভজনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন আশরাফুল। সেদিন তাঁর বাড়িতে যেন নেমে এসেছিল আকাশের চাঁদ। শচীন-ভাজ্জির পাতে ইলিশ তুলে দেন আশরাফুল। সেই মুহূর্তটি এখনও দাগ কেটে আছে আশরাফুলের মনে। বলছিলেন, ‘ওই মুহূর্ত ভুলে যাওয়ার নয়। শচীন টেন্ডুলকার আমার বাড়িতে এসেছিল, এ আমার সারাজীবন মনে থাকবে।’
সূত্র: এবেলা