ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার নিভৃতপল্লীর সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত গ্রামের মেয়েরা খেলবে ফুটবল, হয়ে উঠবে পেশাদার ফুটবলার- এমনটা স্বপ্নেও কেউ কোন দিন ভাবেনি। গ্রামের খেলার মাঠে বিরল একটি দৃশ্য অনেককে অবাক করবে ফুটবল খেলছে গ্রামের মেয়েরা। শুধু খেলছে না, ফুটবলের কলাকৌশল নিজের আয়ত্তে নিচ্ছে তারা কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে। তবে নিজেদের অভাব-অনটন আর সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেছেন ক্ষুদে এই ফুটবল খেলোয়াড়রা।
মেয়েরা বলেন, খেলতে গেলে খাবারের প্রয়োজন, নিয়মিত অনুশীলনের জন্য যদি সরকারি ভাবে খাবার, খেলাধুলার সরঞ্জাম ও একজন ভাল প্রশিক্ষক হত তাহলে এখান থেকে অনেক ভাল খেলোয়ার আছে যারা জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতা রাখে ও খেলতে পারতো। এই মেয়েরা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে জেলায় কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেই টিম রংপুর বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, জাতীয় পর্যায়ে গিয়েও দুইবার রানার্সআপ হয়েছে।
কয়েকজন বিএকেএসপিতে সুযোগ পেলেও অর্থের অভাবে ভর্তি হতে পারেনি বলে জানা গেছে। ফুটবল ফেডারেশন থেকে ২ জন খেলোয়ার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার থেকে ১০ লাখ আর্থিক অনুদান পেয়েছেন। সেই টাকায় তাদের দরিদ্র পরিবার ঘরবাড়ি নির্মাণনহ জমি কিনে ফসল ফলাচ্ছেন। তাদের দেখে এলাকায় মহিলা খেলোয়াড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও অর্থের অভাবে কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খাচ্ছে মহিলা ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক।
তবে ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগে ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা হয়ে উঠেছেন ফুটবলার। আর এলাকার ক্রীড়া অনুরাগী অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম এই সকল নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েদের নিয়ে জেলা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অজপাড়াগাঁয়ে ব্যক্তি মালিকানায় গড়ে তুলেছেন রাঙ্গাটুঙ্গি মহিলা ফুটবল একাডেমী নামে একটি মহিলা ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
ইতোমধ্যে রাঙ্গাটুঙ্গি মহিলা ফুটবল একাডেমীর ৬ জন মেয়ের ঠায় হয়েছে জাতীয় মহিলা দলে। এদের মধ্যে অনুর্ধ ১৬ দলে সোহাগী কিসকু ও মুন্নী আক্তার আদূরী বর্তমানে মিয়ানমারে বাংলাদেশের হয়ে খেলছেন। আর অনুর্ধ ১৫ দলে বিথীকা কিসকু, কোহাতী কিসকু, কাকলী আক্তার, শাবনুর নিয়মিত অনুশীলন করছেন।
শুরুর কথা গল্পের মতোই মনে হতে পারে। ২০১৪ সালে রাণীংশকৈল রাঙ্গাটুঙ্গি এলাকার মাঠে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। খেলার বেশির ভাগ দর্শক ছিল নারীরা। মাঠের পাশেই কয়েকজন মেয়ে ফুটবল নিয়ে খেলছিল। তখন তাদের ডেকে এলাকার ক্রীড়া অনুরাগী অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম ফুটবল খেলার কথা বলেন। তাদের ফুটবল খেলার আগ্রহী দেখে পরের দিন মাঠে অনুশীলনের জন্য আসতে বলেন। প্রথম দিনে ৫ জন, এভাবে বর্তমানে আরও ২৪ জন ক্ষুদে ফুটবলার নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
২০১৪ সালের পর থেকে রাঙ্গাটুঙ্গি মহিলা ফুটবল একাডেমীকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাকি মেয়েদেরও স্বপ্ন জায়গা করে নিতে হবে জাতীয় দলে। সেই সঙ্গে ঠাকুরগাঁওয়ের নাম ছড়িয়ে দিবে বিশ্বব্যাপী। সেই লক্ষ্যে ক্ষুদে এই খেলোয়াড়রা কোচ জয়নুল ইসলাম, শুগা মরমু ও পরিচালক অধ্যক্ষ তাজুল ইসলামের অধীনে অনুশীলন করছে প্রতিদিন।
আজ বিভিন্ন গ্রাম থেকেও খেলতে আসছে মেয়েরা। জেলা থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে, সেখান থেকে জাতীয় পর্যায়ে খেলছে। মেয়ে ফুটবলাররা জানান, “যখন মহিলা ফুটবল শুরু হয় তখন গ্রামের মানুষের অনেক আপত্তি ছিল কেন মেয়েরা হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলবে? এমনও হয়েছে মাঠে খেলা শুরুর পরও আমাদের উঠে আসতে হয়েছে। সেই অবস্থা থেকে উঠে এসে এখন আমাদের বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জের মেয়েরা ফুটবল খেলছে। সত্যিই এখন অনেক ভালো লাগে।” কিন্তু তাজুল স্যারের প্রচেষ্টায় অনেকটা এগিয়ে গেলেও অর্থের কারণে অনেক সময় নিয়মিত অনুশীলন করতে পারছি না। খেলতে গেলে খাওয়ার প্রয়োজন, নিয়মিত অনুশীলনের জন্য যদি সরকারিভাবে খাবার, খেলাধুলার সরঞ্জাম ও একজন ভাল প্রশিক্ষক হত তাহলে এখান থেকে অনেক ভাল খেলোয়ার আছে যারা জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতা রাখে ও খেলতে পারতো।
ক্রীড়া অনুরাগী অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম জানান, অনেক কষ্ট করে গ্রামের মেয়েদের ভাল ফুটবলার তৈরিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। নিজ উদ্যোগে একটি একাডেমী তৈরি করেছি। সরকারি বা কোন অর্থশালী ব্যক্তি যদি এগিয়ে আসে তাহলে এখান থেকে দেশের ভাল মানের নারী ফুটবলার তৈরি হবে। তারা এলাকার ও দেশের সুনাম বয়ে নিয়ে আসার ক্ষমতা রাখে।
তিনি আরও বলেন, রাঙ্গাটুঙ্গি মহিলা ফুটবল একাডেমীর ৬ জন খেলোয়ার জাতীয় দলে খেলছে। ২ জন ১০ লাখ করে অনুদান পেয়েছে তাদের পরিবার লাভবান হয়েছে। আশা করি বাকিরাও পাবে। তবে বাফুফের উচিত লোকালয়ে যে সকল খেলোয়াড় তৈরীর প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে তাদের প্রতি সহযোগীতার হাত বাড়ানো। লোকালয়ের প্রতিষ্ঠান না থাকলে জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়ার তৈরী হবে না। খেলোয়াড়দের পাশাপাশি খেলার প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা না করলে এক সময় মহিলা ফুটবল পুরুষ ফুট বলের মত হতে পারে। নিজের অর্থ ব্যয় করে রাঙ্গাটুঙ্গি মহিলা ফুটবল একাডেমীকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু
অর্থের অভাবে ইচ্ছে থাকলেও সবার চাহিদা পূরণ করতে পারছি না। কয়েক জনকে বিকেএসপিতে ভর্তি নিতে চাচ্ছে কিন্তু অর্থের অভাবে তাদেও ভর্তি করতে পারছি না। প্রথমে সরকারি ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার থেকে কিছু সহযোগিতা পেলেও এখন আর পাইনা।
জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান বাবু বলেন, রাঙ্গাটুঙ্গি মহিলা ফুটবল একাডেমীর মেয়েরা আমাদের গর্ব। সেই একাডেমী থেকে ৬ জন জাতীয় দলে খেলছে আশা করি ভবিষ্যতে আরও অনেকে খেলবে। আগে সাধ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করা হয়েছে আগামীতেও ব্যবস্থা করা হবে।
বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ