গত জানুয়ারিতে মিরপুরের একটি স্কুলে প্রথম প্লে শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে মাহিন। বয়স কেবল পাঁচে পড়লেও চোখে মাইনাস পাওয়ারের চশমা উঠেছে তিন বছরেই। তাই বেশি সময় ধরে টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকতে নিষেধ করেছেন চিকিৎসক। মাহিনের মা হোসনে আরা বেগম বলেন, ছোটবেলা থেকেই ছেলেটা ভীষণ দুষ্টু। কখনো স্থির হয়ে বসত না কিছু খেত না। শুধু টিভিতে কার্টুন দিলে হা করে দেখত। এ সময় সবটুকু খাবার খাইয়ে দিলেও না করত না। এভাবে আস্তে আস্তে মোবাইলে গেমস খেলার নেশা হলো। না দিলে কান্নাকাটি করত তাই দিতাম। কিন্তু এটুকু বয়সেই মাইনাস দশমিক ৫০ পাওয়ারের চশমা দিয়েছেন ডাক্তার। আর বলেছেন এভাবে চলতে থাকলে পাওয়ার আরও বাড়তে পারে।
শুধু মাহিন না শহরে বসবাসকারী ৭০ শতাংশ শিশু চোখের বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে বলে জানান চিকিৎসকরা। সারা দেশে ঠিক কত শিশু এমন সমস্যায় ভুগছে, তা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো গবেষণা নেই। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, মাসে হাসপাতালটিতে গড়ে ৩ হাজার ৭০০ শিশু আসে। এদের ৭০ শতাংশ দূরের জিনিস ভালো দেখতে পায় না। বেসরকারি হাসপাতাল বাংলাদেশ আই হসপিটালের তথ্যও একই। এই হাসপাতালেও চিকিৎসা নিতে আসা ৭০ শতাংশ শিশু একই রোগে ভুগছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ডাক্তারি ভাষায় রোগটিকে বলা হয় মাইয়োপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা। আরও সুনির্দিষ্টভাবে এই রোগকে বলা হচ্ছে ‘কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম’। বাংলাদেশ আই হসপিটালের চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম নজরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে শিশুদের চোখের কাজ বেড়ে গেছে। একদিকে পড়াশোনা আর অন্যদিকে কম্পিউটার, ট্যাব, মোবাইল স্ক্রিনে বেশি সময় ধরে তাকিয়ে থাকায় চোখের সমস্যা বাড়ছে। তারা দূরের জিনিস ঝাপসা দেখে। তখন আমরা তাদের পাওয়ার চশমা দিয়ে থাকি। আর রাতে ডিমলাইট জ্বেলে ঘুমালে দীর্ঘমেয়াদে গিয়ে চোখের সমস্যা হয়। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, তবে শহরের শিশুদের তুলনায় গ্রামের শিশুরা চোখের দৃষ্টিজনিত সমস্যায় কম ভোগে। যশোর কমিউনিটি আই হসপিটালে আমি রোগী দেখার সময় শিশুদের চোখে সমস্যা পাই হাতেগোনা দু-একটা। আর ঢাকাতে প্রতিদিন অসংখ্য অভিভাবক আসে শিশুর চোখের সমস্যায় চিকিৎসা নিতে। শিশুদের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার এবং জীবনযাপনের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুদের প্রযুক্তির খেলাধুলায় আগ্রহী না করে মাঠে খেলতে পাঠানোর ব্যাপারে অভিভাবকদের পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।
মিরপুরের আই ভিউ গ্লাস নামে চশমার দোকানের কর্মচারী সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমি প্রায় ২০ বছর হলো চশমার দোকানে কাজ করছি। আগে দেখতাম চোখের সমস্যার জন্য যারা চশমা বানাতে আসতো তাদের অধিকাংশেরই বয়স ৩৫ এর বেশি। এরপর আস্তে আস্তে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। আর ৭-৮ বছর ধরে দেখছি ৩ বছর থেকে শুরু করে ১৬ বছর পর্যন্ত শিশুরাই বেশি আসে চশমা বানাতে। আগে মানুষের চোখের সমস্যা ছিল খুবই সাধারণ কিন্তু এখন এমন জটিল রকমের সমস্যা দেখে নিজেরাই অবাক হয়ে যাই। এই জটিল রোগগুলো শিশুদের মধ্যেই বেশি দেখি।
২০১৩ সালে ল্যানসেট এশিয়ায় ক্ষীণদৃষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে গবেষণা প্রবন্ধ ছাপে। ওই প্রবন্ধে বলা হয়, এশিয়ার দেশগুলোয় গত ৪০ বছরে ক্ষীণদৃষ্টিতে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ বা তিনগুণ হয়েছে। ১৯৫৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় ২০ বছর বয়সী তরুণদের ১৮ শতাংশ ক্ষীণদৃষ্টিতে ভুগত, ২০১১ সালে এই সংখ্যা ৯৬ শতাংশে দাঁড়ায়। হংকং, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানে এই সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ।
শিশুদের চোখের সমস্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা বলছেন, শিশুদের অতিমাত্রায় কম্পিউটার, মুঠোফোন এবং টেলিভিশন দেখার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া, স্কুল, কোচিং এবং বাসা মিলিয়ে অতিরিক্ত সময় ধরে পড়াশোনা করা, অনেক রাতে ঘুমাতে যাওয়া ও খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা। এসব কারণে ব্যাহত হচ্ছে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ এবং বাড়ছে চোখের নানা ধরনের সমস্যা। শুধু তাই নয়, প্রতিযোগিতার জন্য শিশুদের অতিরিক্ত চাপ দিয়ে পড়ালেও চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়। তাই বাংলাদেশের অভিভাবকদের ‘টাইগার মম অ্যাটিচ্যুড’ (অতিরিক্ত চাপ দেওয়া মায়েদের বোঝানো হয়) থেকে বেরিয়ে আসতে বলেছেন চিকিৎসকরা।