আগামী বছর এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানসংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, মধ্য মার্চ পর্যন্ত রোজা, এপ্রিলের দাবদাহ, বজ্রপাত, ঘূর্ণিঝড়সহ নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার কারণে ওই সময় উৎসবমুখর ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে কোনো কারণে আসছে ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে সেটি পিছিয়ে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন অনেকে।
তবে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতের আমির এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণায় জাতি আশ্বস্ত হয়েছে এবং ঘোষিত সময়ের মধ্যেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে জাতি আশা প্রকাশ করছে’। এনসিপি বলেছে, ‘জুলাই সনদ, ঘোষণাপত্র ও সংস্কারের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলে’ ঘোষিত সময়ে নির্বাচনের বিষয়ে তাদের আপত্তি নেই। গতকাল এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক খান মুহাম্মদ মুরসালীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কোটি কোটি জনতা তো একটি বৃহৎ দলকে নামকা ওয়াস্তে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় বসানোর জন্য রাজপথে নামেনি। নির্বাচন হওয়ার বিষয়ে দ্বিমত নেই। তবে তার আগে জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ ঘোষণা করতে হবে। সংস্কারের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। নয়তো যে ম্যান্ডেটের ওপর দাঁড়িয়ে এই সরকার গঠিত হয়েছে, তার বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। পক্ষান্তরে এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল-বিএনপি। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর ওই দিন রাতেই বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক বসে। বৈঠকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সভায় প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন বিএনপি নেতৃবৃন্দ। সভা শেষে এক বিবৃতিতে দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হলে একদিকে আবহাওয়ার সংকট এবং অন্যদিকে রমজানের মধ্যে নির্বাচনি প্রচারণা ও কার্যক্রম এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে যা নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে’। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘এই সভা রমজান, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বা সমপর্যায়ের পরীক্ষা এবং আবহাওয়া ইত্যাদি বিবেচনায় ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব পুনর্ব্যক্ত করছে’। এ ছাড়া ডিসেম্বরের মধ্যে কেন নির্বাচন করা যাবে না তার কোনো কারণ প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে তুলে ধরেননি বলেও অভিযোগ করেন তারা। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ সম্পর্কে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, জনগণের মতামত ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। বাস্তবে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ সম্পর্কে জনদাবি উপেক্ষিতই হয়েছে। ডিসেম্বরে কেন জাতীয় নির্বাচন করা যাবে না তাঁর ভাষণে এর সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। এ ছাড়া নির্বাচন কেন আগামী বছরের এপ্রিলে নিতে হবে তারও গ্রহণযোগ্য কোনো বক্তব্য নেই। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যে নির্বাচনকে উৎসবের আনন্দে নজিরবিহীন করতে চান তার জন্য জাতীয় নির্বাচন এ বছরের ডিসেম্বর বা তার আশপাশেই অনুষ্ঠিত হওয়াটাই উত্তম।
এদিকে নির্বাচন বিলম্বের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে- এমন অভিযোগ তুলে বিএনপি নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে কঠোর অবস্থান নিলেও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পরামর্শে দলটি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে। বর্তমানে দলটি প্রতীক্ষায় রয়েছে আগামী শুক্রবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকের দিকে। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে নির্ধারিত এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে লন্ডনের ডরচেষ্টার হোটেলে স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত।
গতকাল রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই বৈঠক প্রসঙ্গে বলেছেন, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পলিটিক্যাল ইভেন্ট। অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। অনেক কিছু সহজ হয়ে যেতে পারে। নতুন ডাইমেনশন তৈরি হতে পারে এ বৈঠকে। তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত নির্বাচনের সময়টি ভোটের জন্য ঠিক নয়। রমজানের আগে প্রচার-প্রচারণায় অনেক সমস্যা হবে। প্রতিদিনই ইফতার মাহফিল করা লাগবে। নির্বাচনি ব্যয় দ্বিগুণ হবে। প্রচণ্ড গরমের কারণে সমাবেশে লোকজন আনা যাবে না।
রাতে প্রোগ্রাম করতে হবে। এর আগে ৩০ মে জাপান সফরকালে দেওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এক বক্তব্য নিয়েও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। একটি বিশেষ দল ছাড়া আর কেউই ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় না- প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পর দেখা গেল, বিএনপি ছাড়াও বেশির ভাগ দলই ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে অনড়। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত সব দল ছাড়াও অনিবন্ধিত দলগুলোও চায় ডিসেম্বর কিংবা সম্ভব হলে তারও আগে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করুক। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৯ দলের প্রায় সবাই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানায়।
এ ছাড়া আরও শতাধিক অনিবন্ধিত দলের অধিকাংশই ডিসেম্বর কিংবা তারও আগে সংসদ নির্বাচনের দাবি তোলে।