বর্ষা এলেই সিলেটে দেখা দেয় টিলাধস আতঙ্ক। প্রতি বছরই জেলার কোথাও না কোথাও টিলাধসে প্রাণহানি ঘটে। মাটিচাপায় পুরো পরিবারের মৃত্যুর মতো ট্র্যাজেডিও ঘটছে। কিন্তু মৃত্যুর ভয়ও টলাতে পারে না টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী লোকজনকে। সিলেট জেলা প্রশাসনের হিসাবমতে জেলার ১৩ উপজেলার ৮টিতে টিলা রয়েছে। এসব উপজেলার ঝুঁকিপূর্ণ ১৬৯টি টিলায় ৩৮৩টি পরিবার বসবাস করছে। যদিও সরকারি এ হিসাবের সঙ্গে একমত নন পরিবেশবাদীরা।
তাঁদের মতে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের কারণে অনেক টিলাকে তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। ঝুঁকিপূর্ণ টিলাগুলোয় বসবাসকারী পরিবারের তালিকা থাকলেও কী পরিমাণ জনসংখ্যা বসবাস করে সে হিসাব নেই প্রশাসনের কাছে। তবে বেসরকারি একটি সংস্থার হিসাবে সিলেটে টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী লোকজনের সংখ্যা ১০ হাজারের ওপরে। পাহাড় ও টিলাবেষ্টিত জেলা সিলেট। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভারসাম্যের ধারক হিসেবে একসময় এগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু ভূমিখেকোদের দৌরাত্ম্যে দিনদিন এসব পাহাড়-টিলা অস্তিত্ব হারিয়েছে। নানান কৌশলে মাটি কেটে সমতল করে ফেলা হয়েছে পাহাড়-টিলা। টিলার দখল ধরে রাখতে প্রভাবশালীরা পাদদেশে কাঁচা ও আধাপাকা ঘর তৈরি করে থাকতে দেন বাস্তুহারাদের। আবার কেউ কেউ তুলনামূলক কম দামে জায়গা কিনে বাড়িঘর তৈরি করেন এসব ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে। ১ জুন সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মণাবন্দ ইউনিয়নের বখতিয়ারঘাট গ্রামে টিলা ধসে একই পরিবারের চারজন নিহত হন।
এর আগে গত বছরের ১০ জুন সিলেট মহানগরের মেজরটিলা চামেলিবাগে টিলাধসে একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়। ২০২২ সালের ৫ জুন একইভাবে জৈন্তাপুর উপজেলার সাতজনি গ্রামে টিলাধসে একই পরিবারের চার সদস্য নিহত হন। এ ছাড়া প্রতি বছরই কোথাও না কোথাও টিলাধসে প্রাণহানি ঘটছে। সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে জেলায় ১৬৯টি ঝুঁকিপূর্ণ টিলার পাদদেশে ৩৮৩টি পরিবার বসবাস করছে। জেলায় সবচেয়ে বেশি ৭৬টি ঝুঁকিপূর্ণ টিলা রয়েছে গোলাপগঞ্জে। টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি সদর উপজেলায়। এখানের ৬০টি ঝুঁকিপূর্ণ টিলায় বসবাস করছে ২৩৫ পরিবার। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের হিসাবমতে গোলাপগঞ্জে ৭৬ টিলার নিচে ৯২, বিয়ানীবাজারে ৯ টিলায় ৯, কানাইঘাটে ১ টিলায় ৩, ফেঞ্চুগঞ্জে ১২ টিলায় ৩৮ ও বিশ্বনাথে ১ টিলায় ৬ পরিবার বসবাস করছে। তবে জেলা প্রশাসনের এ তথ্য পরিপূর্ণ নয় বলে দাবি করছেন পরিবেশবাদীরা।
সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের প্রধান নির্বাহী আবদুল হাই আল হাদী জানান, সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় অনেক টিলা রয়েছে। অথচ জেলা প্রশাসনের তালিকায় সেগুলোর উল্লেখ নেই। এ ছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় টিলার যে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। আবদুল হাই আরও জানান, কয়েক বছর আগে তাঁর সংস্থার পক্ষ থেকে একটি জরিপ করা হয়েছিল। ওই সময় সিলেটের টিলাগুলোয় ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী লোকজনের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার ছিল। প্রশাসন টিলা কাটা ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় দুর্ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. শের মাহবুব মুরাদ জানান, সিলেটের যেসব উপজেলায় ঝুঁকিপূর্ণ টিলা রয়েছে সেসব স্থান থেকে জনসাধারণকে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করে সতর্ক করা হয়েছে। টিলাগুলোয় লাল পতাকা টানানো হয়েছে। এর পরও কেউ কেউ সতর্কবার্তা না মেনে ঝুঁকিপূর্ণভাবে টিলার পাদদেশে থেকে গেছেন। যে কারণে দুর্ঘটনা ঠেকানো যায়নি।